দেবীপক্ষের শুরুতে সানি লিওনের জন্য কাউন্ট ডাউন, কিন্তু কেন ম্লান হল মহালয়া
যে দিকে নজর যায় সেদিকেই ধ্বংসের ছবি। ভেঙে পড়ে রয়েছে বাড়ি-ঘর। জমি উপরে জমে গিয়েছে পলির আস্তরণ। মহালয়ার দিনেও এই সব এলাকার মানুষের মনে পৌঁছয়নি পুজোর গন্ধ।
আকাশের দিকে চেয়ে দু'চোখের উপর হাত দিয়ে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করছিল বুঁদি। কেউ একজন বলল, 'ও, দিদা, এত সকালে আকাশটাতে কি খুঁজো বলো-তো?' বুঁদি তাঁর শীর্ণকায় হাতটাকে চোখের সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে বলে উঠল, 'আরে দেখতা-সি আকাশে আবার মেঘ আইছে কি না! ' ওদিক থেকে তৎক্ষণাত জবাব, 'হ! তোমার মেঘ, পুজা আই-সি গিল্যা, আজ মহালয়া, আর তোমার মেঘ আইসবক না-ই।'
বয়সের ভারে নুব্জ্য শরীরটাকে কোনওমতে টানতে টানতে ঘরের দাওয়ার দিকে ঘুরে দাঁড়ায় বুঁদি। ঘর! ওটা না বলাই ভাল। ঘরের মতো একটা কাঠামো আছে বটে, কিন্তু তার না আছে কোনও 'ছাদ' না 'শ্রী'। আসলে বন্যার জল তো সবই ধুয়ে-মুছে নিয়ে গিয়েছে। ভিটে-মাটির যেটুকু অবশিষ্ট রেখে গিয়েছে তাতে পড়ে রয়েছে শুধু ঘরের এই কাঠামো। না আছে পরনের যথেষ্ট কাপড়, না আছে খাবার। দিন কুড়ি হল ঘর থেকে জল নেমেছে কিন্তু নতুন করে সংসারের জন্য কিচ্ছুটি-টুকুও নেই বুঁদির কাছে। বয়স গিয়ে ঠেকেছে সত্তরের কোঠায়। সন্তানরা আছে বটে কিন্তু তাঁরা তাঁদের নিজেদের সংসার সামলাতে ব্যস্ত। আর বন্যায় শুধু তো বুঁদির যে সবকিছু শেষ হয়েছে, এমনটা তো নয়, তাঁর সন্তানদের ভিটে-মাটিরও এক হাল।
যে দিন নদীর বাঁধ ভেঙে রাতের অন্ধকারে গ্রামে জল ঢুকেছিল তখন মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছিল বুঁদির। এক বয়সের বারে শরীরটা ঠেলা দায়। তারমধ্যে একা একা গোয়াল থেকে তিনটে গরুকে বের করা, আবার ঘর থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস বের করা। না, অসমর্থ শরীরে বুঁদি পারেনি। কোনও মতে গোয়াল থেকে গরু তিনটের বাঁধন আলগা করতে পেরেছিল। এর মধ্যে আবার একটা গরুর বাচ্চাও হয়েছিল কয়েক মাস আগে। গরুগুলোকে ছাড়তে গিয়ে ঘর থেকে বেশি জিনিস আর বের করতে পারেনি বুঁদি। কোনও মতে দু'খানা শাড়ি আর একটা গামলা নিয়ে বের হয়ে এসেছিল। কারণ ততক্ষণে হুহু-করে ঘরে জল ঢুকতে শুরু করেছিল। মাটির ঘর যে কোনও মুহূর্তে ভেঙে পড়লে প্রাণে বাঁচাই দায় হবে। তাই কোনও মতে দু'খানা শাড়ি আর একটা গামলা নিয়েই জল ঠেলতে ঠেলতে রাতের অন্ধকারে ডাঙার সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছিল বুঁদি। মুরগির খাঁচাটা খুলে আসতে না পারা আপশোস সারাক্ষণ তাঁকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। ছাগল দু 'টো উঠোনে বাঁধা ছিল! সেগুলির যে কী হল? এমনই সাত-সতেরো ভেবে কোনও মতে ডাঙায় ভিড়েছিল বুঁদি। পিছন-পিছন জলের মধ্যে সাঁতার কাটতে কাটতে এসেছিল বহু বছরের পোষ্য কুকুরটা।
এখন ভিটে-মাটিতে ফিরে এলেও সারাক্ষণই মেঘের আতঙ্কে থাকে বুঁদি। আকাশ একটু কালো হলেই হল! আশপাশের জন-দের হাজারো জিজ্ঞাসা- বৃষ্টি হবে কি না? নদীর জলটা এখন কোথায়? ভাঙা বাঁধ মেরামত হল কি না? বুঁদির এই মেঘ আতঙ্ক এখন পরিচিতি পেয়ে গিয়েছে এলাকায়। অনেকেই এই নিয়ে বুড়ি মানুষটাকে রাগাতেও ছাড়ে না।
এবারের মতো ভয়ঙ্কর বন্যা এর আগে একবারই দেখেছিল বুঁদি। তখন তাঁর বয়স ৩০ বছর। কিন্তু, এবারের মতো অসহায় কোনওবারই মনে হয়নি। বন্যার সময় থেকে বাড়ি ফিরে আসা পর্যন্ত কোনও নেতাবাবুর দেখার মেলেনি এলাকায়। না শাসক-না বিরোধী, কেউ এসে দাঁড়ায়নি বুঁদিদের পাশে। যতদিন এলাকার উঁচু রাস্তাটার উপরে ত্রাণ শিবিরে বুঁদিরা ছিল ততদিন নিয়ম করে দু'বেলা তাঁদের খাবার দিত উঁচু এলাকার মানুষরা। কারণ, ওদিকে সেভাবে জল ঢোকেনি বলেই জেনেছিল বুঁদিরা। ওই উঁচু এলাকার মানুষগুলো নিজেরাই চাঁদা তুলে রোজ কয়েক'শ মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিয়েছিল। কেউ কেউ আবার হাসপাতাল থেকে ওষুধ নিয়ে এসে বিলি করত। কিন্তু, এই স্থানীয় সাধারণ মানুষের ভিড়ে কোনও রাজনৈতিক দাদাদের মুখ ছিল না। এমনকী, স্থানীয় বিডিও অফিসেরও কোনও কর্তা পা- মাড়ায়নি এলাকায়।
ভাদরের কড়া রোদে জলে খুব দ্রুত টান ধরেছিল। তাই ত্রাণ শিবির থেকে দিন কুড়ি পরে বাড়ি ফিরতে পেরেছিল বুঁদিরা। কিন্তু, খাবে কী? পরবে কী? সাত-সতেরো চিন্তায় অসাড় হয়ে গিয়েছিল বুঁদি। তারমধ্যে তিনটে গরুকেও আর পায়নি সে। গ্রামের কেউ বলেছিল, স্রোতের টানে ভেসে গিয়েছিল গরুগুলো। বন্যার জলে ছাগল ও মুরগিগুলোর পরিণতি যে খুব একটা সুখকর হয়নি তা বুঝতেই পেরেছিল বুঁদি। আপাতত গ্রামের এর-ওর কাছ থেকেই চেয়ে-চিন্তে দু'বেলার অন্ন জোগাতে হচ্ছে বুঁদিকে। যারা দিচ্ছে তাদের অবস্থাও যে ভালো এমনটা নয়। মাঝে মধ্যে শহর থেকে ছেলে-ছোকরা-অল্পবয়সী মেয়েরা ট্রাকে করে আসছে। তারাই বন্যা দুর্গত এলাকাগুলিতে কিছু কিছু করে খাদ্য সামগ্রী আর জামা-কাপড় বিলোচ্ছে। এই ভাবেই চলছে বুঁদিদের। সরকার কবে ভালো-ভাবে কিছু করে দেবে আপাতত সেই দিকেই তাকিয়ে আছে বুঁদিরা।
দিন কয়েক ধরেই কয়েক জন বলছে আকাশে আবার মেঘ জমছে। পুজোর মধ্যে জোর বৃষ্টি হবে। এই কথা শোনার পর থেকে প্রায় ঘুম ছোটার অবস্থা বুঁদির। সময় পেলেই আকাশের দিকে তাকিয়ে কালো-মেঘ খোঁজে। কিন্তু, ভাদর কেটে আশ্বিন যে এসে গিয়েছে তা আর খেয়াল রাখতে পারেনি। আজ পাশের বাড়ির নয়ন যদি স্মরণ করিয়ে না দিত তা হলে বুঁদি বুঝতেও পারত না দিনটি 'মহালয়া' মানে দেবীপক্ষের শুরু। আর ৭ দিন পরেই পুজো। অন্যবার পুজো মানেই তো একটা সুন্দর গন্ধ চারিদিকে ছেয়ে যেত। বয়স হলেও এখনও দুর্গাপুজোর আশ্বিনের সেই গন্ধকে চিনে নিতে অসুবিধা হয় না বুঁদির। কিন্তু, এবার সব হিসেবই যেন উল্টে গিয়েছে। চেনা মহালয়া-টাও তাঁর কাছে অচেনা হয়ে গিয়েছে। দিন কয়েক আগেই নয়ন বলছিল, 'জানো দিদা এবার পুজোয় সানি লিওন আইসব'। বুঁদির কাছে সানি নামটা কোনওমতেই পরিচিত নয়। সামান্য বিরক্তি সহকারে বলেছিল ' কে রে এটা আবার? ' নয়ন-এর তৎক্ষণাত উত্তর কে সানি লিওন। বুঁদির মাথায় ওসব ঢোকেনি। শুধু বুঝেছিল সানি লিওন কোনও 'মাইয়া মানুষ'-এর নাম। অন্য কোনও দুর্গাপুজোয় তাঁর দেখা পাওয়া যায়নি। এবার দেখা পাওয়া যাবে। কিন্তু, পুজা মণ্ডপে সানি লিওন কি করবে? সত্তর বছরের বুঁদি-র মাথা আরও ভারি হয়ে উঠেছিল। গ্রামে এবার 'পুজা হইবক না, তাহলে?'
ঘরের
সামনেটায়
প্রায়
মাটিতে
নুইয়ে
পড়া
শিউলি
ফুলের
গাছটাতে
নজর
গেল
বুঁদির।
সেখান
থেকে
খান
কতক
ফুল
গিয়ে
পড়েছে
পাশের
জমা
জলে।
ফুলগুলো
দেখবে
বলে
জলের
উপর
ঝুঁকেছিল
বুঁদি।
ঝকঝকে
নীল
আকাশের
প্রতিবিম্বটা
দেখা
যাচ্ছিল
জলের
মধ্যে।
মনে
হচ্ছিল
নীল
আকাশের
বুকে
যেন
তির-তির
করে
চলেছে
শিউলি
ফুলগুলি।
মনটা
খুশিতে
ভরে
উঠেছিল
বুঁদির।
এই
প্রথম
সে
যেন
আশ্বিনের
সেই
গন্ধটাকে
অনুভব
করতে
পারল।
ঘাড়
ফিরিয়ে
নিজের
কঙ্কালসার
ঘরটা
দিকে
নজর
যেতেই
চোখ
খুটে
জল
বেরিয়ে
এল
বৃদ্ধার।
শিউলি
ফুলের
গাছের
পাশ
থেকে
সরে
আসতে
আসতে
বুঁদি
তখন
আওড়ে
চলেছে
'মুখ
পোড়া
আমার
দুর্গাপুজো,
পেটে
ভাত
নাই,
পরনে
কাপড়
নাই,
তার
কাছে
আবার
মহালায়!
হু!'।
(বাস্তব
ঘটনার
আধারে
লেখা
হলেও
এই
খবরের
সমস্ত
চরিত্রই
কাল্পনিক)