খেজুরিতে 'অ্যাট দ্য গান পয়েন্ট!' দেখুন ভিডিও
খেজুরির এই ভিডিও এখন ভাইরাল। নন্দীগ্রাম ধর্ষণকাণ্ডে নির্যাতিতার স্বামীকে যেভাবে অস্ত্র আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাতে প্রশ্ন উঠেছে। ইট কিনতে গিয়ে কীভাবে তিনি পিস্তল হাতে পাবেন?
এই ছবি-র ভয়াবহতা শিউরে দিতে পারে যে কাউকে। প্রশ্ন উঠতে পারে এ কোন সন্ত্রাস? দড়ি দিয়ে বাঁধা দুই ব্যক্তিকে নিয়ে এই উন্মত্তার সঠিক কারণ কী? আদৌ কী এই দুই ব্যক্তি কোনও অপরাধী? না, পুরোটাই সাজানো?
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হোয়াটসঅ্যাপ থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে এই ভিডিও। যেখানে দেখা যাচ্ছে একদল লোক দুই ব্যক্তিকে বেঁধে বেধড়ক মারধর করছে। শুধু তাই নয়, দুই ব্যক্তিকে দিয়ে স্বীকার করানোর চেষ্টা চলছে যে তারা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে এলাকায় মানুষ মারতে এসেছিল। মারধর, শাসানি মোটা বাঁশ আর লাঠি দাপাদাপি-র মধ্যে হাত-বাঁধা দুই ব্যক্তির কাতর অনুনয়-বিনয়।
আসলে এই ভিডিও যেখানে তোলা হয়েছে তার নাম খেজুরি। নন্দীগ্রামের পাশেই এই গ্রামাঞ্চল। একটা সময় সিপিএমের দুর্গ। এখন লাল-দুর্গ ধ্বংস হয়ে সেখানে উড়ছে তৃণমূলের জয় পতাকা। এই সেই খেজুরি, যা নন্দীগ্রাম সন্ত্রাসে তখনকার শাসকদলের ঘাঁটি হিসাবে কুখ্যাত হয়েছিল। মঙ্গলবার সন্ধ্যার এই ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর ফের শিরোনামে উঠে এসেছে খেজুরি।
হাত-বাঁধা অবস্থায় থাকা দুই ব্যক্তির পরিচয় কী? খবরের সূত্র ধরে টান মারতেই দেখা যায় এই দুই হাত বাঁধা ব্যক্তির মধ্যে একজন নন্দীগ্রামের সুব্দি গ্রামের ধর্ষণকাণ্ডের নির্যাতিতার স্বামী পরশুরাম মান্না। আর তাঁর সঙ্গে থাকা অপর জন নির্মল শীট ।
কিছুদিন আগেই পরশুরাম ও তাঁর স্ত্রী-র দায়ের করা অভিযোগে পুলিশ সুব্দি গ্রামের তৃণমূল নেতা অসিতকুমার হাজরাকে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার করে। পরশুরামের স্ত্রী-র অভিযোগ, ইন্দিরা আবাস যোজনার অর্থ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা না পড়া নিয়ে বিবাদে তৃণমূল নেতা অসিতকুমার হাজরা তাঁকে ধর্ষণ করে। এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই নন্দীগ্রাম এলাকায় কিছুটা হলে অস্বস্তিতে রয়েছে তৃণমূল।
অভিযোগ, মঙ্গলবার সঙ্গীকে নিয়ে খেজুরিতে ইট বিক্রেতার কাছে আসেন সুব্দিগ্রামের পরশুরাম। অভিযোগ, অগ্রিম বরাত দেওয়া ইট না মেলায় আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে তিনি ও তাঁর সঙ্গী হুমকি দেন।
পরশুরামদের এই হুমকি দেওয়ার ভিডিও কোথায়? এখনও পর্যন্ত এমন কোনও ভিডিও সংবাদমাধ্যমের হাতে আসেনি। তবে, যে ভিডিওটি এসেছে তাতে পরশুরাম ও তাঁর সঙ্গীকে হাত বাঁধা অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে আর যে জিনিসগুলি দেখা যাচ্ছে তা হল পশুরামের বাঁধা হাতে উল্টো করে গোঁজা রয়েছে একটি পিস্তল। এই দু'জনের চারপাশে ঘিরে রয়েছে একদল উত্তেজিত মানুষ। যাঁদের রাজনৈতিক দাদা বলেই বোধ হচ্ছে।
এই ঘটনার পরই পরশুরাম ও তাঁর সঙ্গীকে খেজুরি পুলিশ গ্রেফতার করে। দু'জনের বিরুদ্ধেই অস্ত্র আইনে মামলা দায়ের হয়েছে।
এই ভিডিও থেকে উঠে আসছে বেশকিছু প্রশ্ন। যে ব্যক্তিকে পরশুরাম ও তাঁর সঙ্গী পিস্তল দেখিয়ে শাসানি দিয়েছেন বলে অভিযোগ সেই ইট বিক্রেতা কোথায় গেলেন? একবারের জন্যও তাঁকে আশপাশে দেখা যায়নি। যেখানে গাছের গুঁড়িতে গরুর মতো করে পরশুরামদের বেঁধে রাখা হয়েছিল, তার পিছনেই খেজুরির তৃণমূলের দলীয় অফিস। যারা মারধর করছিল এবং বাঁশ, লাঠি নিয়ে মারধরে অংশ নিয়েছিল তারা সকলেই তৃণমূলের স্থানীয় নেতা এবং তাদের দলবল।
কেন বাঁধতে হল পরশুরামদের। ভিডিও-তে একবারের জন্যও দেখে মনে হয়নি যে পরশুরামরা কোনও সাহস দেখানোর চেষ্টা করছিলেন। বরং তাঁদের চোখে-মুখে ছিল তীব্র আতঙ্ক। সুতরাং, বাগে পাওয়া পরশুরামদের হাত বাঁধতে হল কেন? আর কেনই বা পিস্তলটাকে উল্টো করে পশুরামের বাঁধা হাতের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে হল?
ভিডিও-তে আরও দেখা যাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা বারবার টেনে আনছেন সুব্দি গ্রামের সাম্প্রতিক কতগুলো ঘটনার কথা। যার মধ্যে রয়েছে সম্প্রতি সুব্দি গ্রামে যাওয়া 'আক্রান্ত আমরা'-র প্রতিনিধি দলের কথা। তৃণমূলের মাতব্বর বলে দাবি করা খেজুরির এই সব মানুষ একবারের জন্যও জানতে চাইছিলেন না কীভাবে পরশুরামরা ইট বিক্রেতাকে হুমকি দেওয়ার ছক কষেছিলেন বা তৎসম্বন্ধীয় নানা তথ্য জানার চেষ্টা করছিলেন।
পরশুরামদের গরু বাঁধার মতো করে মারধর এবং হাতে পিস্তল রেখে দেওয়ার ঘটনায় খেজুরির তৃণমূল নেতারা বারবার টেনে আনছিল কেন অম্বিকেশ মহাপাত্র গ্রামে এসেছিলেন সেই প্রসঙ্গ। সুব্দি গ্রামের বুথ তৃণমূল সভাপতি অসিতকুমার হাজরাকে পরশুরাম ও তাঁর স্ত্রী ফাঁসিয়েছেন বলেও মারমুখী নেতাদের কেউ কেউ তেড়ে আসেন। একজন তো আবার বাঁশের লাঠি নিয়ে এগিয়ে আসেন। বাদ যায়নি চড় থাপ্পড়, কান ধরে টান মারা থেকে মাটিতে লাথি।
মারমুখী তৃণমুল নেতাদের একটাই দাবি ক্যামেরার সামনে পরশুরাম ও তাঁর সঙ্গীকে স্বীকার করতেই হবে তাঁরা পিস্তল নিয়ে খেজুরিতে এসেছিলেন। পরশুরাম জানিয়েও দেন তিনি এবং তাঁর স্ত্রী ধর্ষণের অভিযোগে জেলে থাকা অসিত হাজরার বিরুদ্ধে যাবতীয় অভিযোগ তুলে নেবেন। তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হোক। কিন্তু, নেতাদের একটাই দাবি, প্রয়োজন পড়লে মুখে রক্ত তুলিয়ে তাঁরা স্বীকার করাবেন যে পরশুরামরা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে গ্রামে এসেছিল। ইতিমধ্যেই এক নেতার ফোন করেন সঞ্জয় দিণ্ডা নামে সুব্দি গ্রামের তৃণমূল নেতাকে।
এই সঞ্জয় দিণ্ডাই নিজেকে পঞ্চায়েতের কর্মাধ্যক্ষ এবং তৃণমূল নেতার পরিচয় দিয়ে 'আক্রান্ত আমরা'র রাস্তা আটকেছিলেন। পরে সঞ্জয় দিণ্ডা এবং পবন গায়েন নামে এক নেতার বিরুদ্ধে নন্দীগ্রাম থানায় 'আক্রান্ত আমরা' অভিযোগও দায়ের করেছিল। পরশুরাম ফোন সঞ্জয়কে সমস্ত অভিযোগ তুলে নেওয়ার কথা বলতে থাকেন। কিন্তু ভিডিও-তে দেখা যায় ফোন কেটে যেতেই এক নেতা সমানে চড়-থাপ্পড় মারতে থাকেন পরশুরামকে। এরপর মারধর করতে এগিয়ে আসেন আরও এক নেতা। কেন এল অম্বিকেশ? কীসের দহরম তাঁর সঙ্গে? গোপনে ফোনে কথা বলে তৃণমূলকে ফাঁসানো! এমনি সব শাসানি আর মন্তব্য চলতে থাকে পরশুরামদের উদ্দেশে।
সন্দেহ নেই সাম্প্রতিক রাজ্য-রাজনীতিতে এই ভিডিও এই মুহূর্তে ভাইরাল। কিন্তু, যিনি অপরাধী, পিস্তল নিয়ে এলাকায় ঢুকে লোককে হুমকি দেখানোর সাহস দেখিয়েছেন, তাহলে তাঁর চোখে-মুখে এত কীসের আতঙ্ক? আর যাকে ধরা হল তিনি আবার মাস খানেক ধরে রাজনৈতিক অবরোধের সামনে পড়ে রয়েছেন। কারও সঙ্গে দেখা করতে গেলেও স্থানীয় শাসকদলের অনুমতি নিতে হয় তাঁকে! সুতরাং, এই ভিডিও-তে দেখতে পাওয়া পরশুরাম ও নির্মল শীট সত্যি কি অপরাধী? না এক সাজানো রাজনৈতিক হিংসার শিকার? প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।