রাজ্যের আপত্তি খারিজ, সারদা কেলেঙ্কারিতে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট
২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে যখন সারদা কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসে, তখন থেকেই বিভিন্ন মহল থেকে সিবিআই তদন্তের দাবি উঠেছিল। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম থেকে সিবিআই তদন্তের বিরোধিতা করে আসছিলেন। তাই রাজ্য সরকার তড়িঘড়ি বিধাননগর পুলিশকে তদন্তের ভার দেয়। তদন্ত প্রক্রিয়ার পুরোভাগে ছিলেন বিধাননগর পুলিশের গোয়েন্দা প্রধান অর্ণব ঘোষ। গঠিত হয়েছিল স্পেশ্যাল ইনভেস্টিগেশন টিম বা সিট। কিন্তু অভিযোগ ওঠে তারা ঠিকঠাক তদন্ত করছে না। তৃণমূল কংগ্রেসের কিছু প্রভাবশালী নেতা জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় রাজ্য পুলিশ সিঁটিয়ে ছিল। ইদানীং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি বলেছে, রাজ্য পুলিশ নানাভাবে তদন্তে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। রাজ্য সরকার যে দোষীদের আড়াল করতে চাইছে, কিছুদিন আগে এই অভিযোগ তুলেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসেরই জেলবন্দি সাংসদ কুণাল ঘোষ। কুণালবাবু বিধাননগরে আদালতে বলেছিলেন, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দোষীদের আড়াল করছেন।
এদিকে, সারদা কেলেঙ্কারিতে সিবিআই তদন্তের দাবি করে সুপ্রিম কোর্টে গত কয়েক মাস ধরে চলছিল জনস্বার্থ মামলা। পশ্চিমবঙ্গ সরকার আদালতকে বোঝানোর চেষ্টা করে, রাজ্য পুলিশ ৯০ শতাংশ তদন্তই সম্পূর্ণ করে ফেলেছে। এই তদন্ত নিয়ম মেনে হয়েছে। সিবিআই অতীতে কোন কোন মামলায় ব্যর্থ হয়েছে, তার ফিরিস্তিও দেওয়া হয়।
"মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সততায় কালি লেগে গেল", বললেন অধীর চৌধুরী
জনস্বার্থ মামলাকারীদের তরফে যুক্তি দেওয়া হয়, প্রথমত, রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের প্রত্যক্ষ মদতে এত বড় কেলেঙ্কারি হয়েছে। তাই রাজ্য পুলিশ এর তদন্ত করলে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরা বহাল তবিয়তে থাকবেন। দ্বিতীয়ত, এই কেলেঙ্কারির জাল ভিন রাজ্য, এমনকী বিদেশেও ছড়িয়ে রয়েছে। ফলে সিবিআই-ই ভরসা। কারণ পশ্চিমবঙ্গের বাইরে গিয়ে রাজ্য পুলিশের পক্ষে তদন্ত চালানো সম্ভব নয়। তাদের সেই এক্তিয়ার বা পরিকাঠামো, কোনওটাই নেই। তৃতীয়ত, অসম, ত্রিপুরা বা ওড়িশাতেও বহু মানুষ সারদা কেলেঙ্কারির জেরে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। তারা যখন সিবিআই তদন্ত মেনে নিচ্ছে, তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারেরও আপত্তি থাকার কথা নয়। চতুর্থত, পশ্চিমবঙ্গেরও বাইরেও এমন অনেক প্রভাবশালী লোক রয়েছে, যারা সারদা গোষ্ঠীর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিল। একমাত্র সিবিআই পারে এদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে। পঞ্চমত, সারদা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রথম দিকে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, সেবি, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট, কর্পোরেট-বিষয়ক মন্ত্রক কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। কেন নেয়নি, এদের কোন কোন অফিসার কেলেঙ্কারিতে যুক্ত ছিল, সেটা জানতে হলে একমাত্র সিবিআইকে তদন্তভার দেওয়া উচিত।
এই যুক্তিগুলির সঙ্গে একমত হয় সুপ্রিম কোর্ট। পাশাপাশি, বিচারপতি এটাও জানান, সারদা কেলেঙ্কারি হল 'বৃহত্তর ষড়যন্ত্র', যা লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। সিবিআই-ই পারবে গোটা ব্যাপারে নিরপেক্ষ তদন্ত করতে। ডিভিশন বেঞ্চের পক্ষে এই রায় পড়েন শোনান বিচারপতি টি এস ঠাকুর।
লোকসভা ভোট যখন চলছে, তখন সারদা কেলেঙ্কারিতে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ হওয়ায় তৃণমূল কংগ্রেস যথেষ্ট বিপাকে পড়ল সন্দেহ নেই। কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী বলেছেন, "এবার সব বেরোবে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সততায় কালি লেগে গেল। আমাদের রাজ্য সরকারের সম্মান ধুলোয় মিশে গেল।" আর এক কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, "রাজ্য সরকার কিছু লোককে আড়াল করতে চাইছিল। এবার আসল সত্যিটা জানা যাবে।" সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশকে স্বাগত জানিয়েছেন সিপিএম নেতা সূর্যকান্ত মিশ্রও।
তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "সিবিআই এর আগে অনেক মামলায় চার্জশিটই দিতে পারেনি। আমরা সারদা কেলেঙ্কারিতে ৩৬৪টি মামলায় চার্জশিট দিয়েছি। সিপিএমের গৌতম দেব, সুজন চক্রবর্তী প্রমুখ নেতাও জড়িত। সিবিআই তদন্ত হলে সিপিএমেরও মুখোশ খুলে যাবে।"