মহকুমা শাসক! তাই কি তিনি 'থাবড়ে মুখ ভেঙে ফেলতে পারেন', শিক্ষকের অভিযোগে তোলপাড় বর্ধমান
২৮ তারিখে নাকাশিপাড়া বিডিও অফিস। এরপর ১২ সেপ্টেম্বর। স্থান বর্ধমান নর্থের এসডিও-র অফিস। ডিও এবং এলও-র কাজের নামে ফের সামনে এল প্রশাসনিক কর্তাদের আস্ফালনের অভিযোগ।
২৮ তারিখে নাকাশিপাড়া বিডিও অফিস। এরপর ১২ সেপ্টেম্বর। স্থান বর্ধমান নর্থের এসডিও-র অফিস। ডিও এবং এলও-র কাজের নামে ফের সামনে এল প্রশাসনিক কর্তাদের আস্ফালনের অভিযোগ। ২৮ অগাস্ট বেথুয়াডহরীর প্রাথমিক শিক্ষক শাশ্বত ঘোষকে তাঁর ক্ষমতার দৌড় দেখিয়েছিলেন নাকাশিপাড়ার বিডিও সমর দত্ত। আর এবার অভিযোগ, বর্ধমানের প্রাথমিক শিক্ষক অভিষেক মণ্ডলকে থাবড়ে মুখ ভেঙে দেওয়ার হুশিয়ারি দিয়েছেন এসডিও নর্থ পূষ্পেন্দু সরকার। এই ঘটনার জেরে বৃহস্পতিবার বর্ধমানে এডিএম জেনারেলের দফতরের সামনে বিক্ষোভ দেখান অন্তত শ'খানেক প্রাথমিক শিক্ষক। ঘটনার বিহিত না হলে তাঁরা কাজ বন্ধেরও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
বর্ধমানের নীলপুর হরিপদ এফ পি বিদ্যালয়ের শিক্ষক অভিষেক মণ্ডল জানিয়েছেন, ডিও ডিউটি নিয়ে একটা জটিলতা তৈরি হয়েছিল। কারণ, তাঁর স্কুলে তিনি একমাত্র পুরো সময়ের শিক্ষক। এছাড়া তাঁর স্কুলে একজন প্যারা টিচার রয়েছেন। এর বাইরে দ্বিতীয় কোনও শিক্ষক বা অশিক্ষক কর্মী নেই। সুতরাং ডিও-র ডিউটি করলে স্কুল বন্ধ রাখা ছাড়া গতি নেই। ডিও-র নিয়োগপত্র পাওয়ার পর থেকেই এই নিয়ে নির্বাচন দফতরের সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি। কিন্তু সমস্যার সুরাহা তো মেলেইনি উল্টে তাঁকে শোকজ করে নির্বাচন দফতর। সমস্যা যাতে না বাড়ে তার জন্য ডিও-র কাজ শুরু করে দেন অভিষেক। শোকজের জবাব দিলেও নির্বাচন দফতর জানিয়ে দেয় এই উত্তরে হবে না। অভিষেক মণ্ডলের দাবি, নির্বাচন দফতর থেকে একটি বয়ান পাঠিয়ে বলা হয় শোকজ-এ এটা হুবুহু লিখে পাঠাতে। অভিষেক মণ্ডলের দাবি, বয়ানটি এতটাই একতরফা ছিল যে তা লিখতে তাঁর মন সায় দেয়নি। কিন্তু তাঁকে বারবার সেই বয়ান লেখার জন্যই চাপ দেওয়া হয়। নির্বাচন দফতরের পাঠানো বয়ানটি ছিল 'আমি প্রথমবার এই ভুল করে ফেলেছি। জীবনে আর কখনও এইরকম ভুল করব না। আমার ভুলের জন্য নিঃস্বার্থ ক্ষমা প্রার্থনা করছি। '
অভিষেকের দাবি, তিনি কখনও বলেননি ডিও-র ডিউটি করবেন না। প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের নিয়ম মানলে তিনি প্যারা টিচারের হাতে স্কুল ছাড়তে পারেন না। তাই ডিও ডিউটি করলে স্কুল বন্ধ রাখা ছাড়া উপায় নেই। আবার এসআই অফিসের নির্দেশ রয়েছে স্কুল বন্ধ রাখা যাবে না। এই জটিলতার মিমাংসার জন্যই ডিও-র প্রশিক্ষণ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন দফতরের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, এক্ষেত্রে প্যারা টিচারকে ডিও-র দায়িত্ব দিলে স্কুল বন্ধ রাখতে হবে না। সুতরাং, অভিষেক মানতে চাননি যে তিনি কোনও ভুল করেছেন। কারণ, বিষয়টিতে জটিলতা বাড়ছে দেখে তিনি যথারিতি ডিও- হিসাবে কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন।
শোকজের মিমাংসায় ১২ সেপ্টেম্বর এসডিও নর্থ-এর দফতরে যান অভিষেক। অভিযোগ, সেখানে তাঁকে ফের একবার নির্বাচন দফতরের পাঠানো বয়ানেই শোকজের উত্তর দিতে চাপ দেওয়া হয়। অভিষেক এরপর জোর করেই এসডিও নর্থের সঙ্গে দেখা করতে চান। কিন্তু, মহকুমা শাসক পূষ্পেন্দু সরকারের ঘরে ঢুকতেই তিনি হতভম্ভ হয়ে যান। অভিষেকের অভিযোগ, ঘরে ঢুকতেই এসডিও নর্থ পূষ্পেন্দু সরকারের তীব্র হুমকি ছুটে আসতে থাকে। অভিষেকের অভিযোগ তাঁকে কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়েই এসডিও নর্থ পূষ্পেন্দু সরকার বলতে থাকেন, ' কতদিন চাকরি করছেন? আপনার চাকরি খেতে আমার কয়েক মিনিট লাগবে। কোন এসআই, কোন নেতা আপনাকে বাঁচাতে আসবে? আপনি কি ভাবেন এখানে সব গরু-ছাগল বসে আছে। কত বড় নেতা হয়েছেন আপনি? টিআইসি বলে ক্ষমতা দেখাচ্ছেন? আপনাকে প্রথমে সাসপেন্ড করব, তারপর বেতন বন্ধ করব, তারপর ৩ বছর জেল খাটাবো। পরে কোর্টে আপনার সঙ্গে দেখা হবে।'
অভিষেকের অভিযোগ এতক্ষণ তাও এসডিও-র চিৎকার ও হুমকি তিনি সহ্য করছিলেন কারণ প্রশাসনিকভাবে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু যে ভাবে একের পর এক তীব্র হুমকি ছুটে আসছিল তাতে তিনি সত্যিকারেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। প্রাইমারি শিক্ষকতার চাকরিতে প্রতিটি শিক্ষকই প্রাথমিক শিক্ষা সাংসদকে তাঁদের মাদার ইনস্টিটিউশন হিসাবে জানে। কিন্তু, সংবিধানের ক্ষমতা বলে নির্বাচন সংক্রান্ত কাজে স্থানীয় বিডিও ও এসডিও-কে মান্যতা দিতে হয় সেটাও অধিকাংশ প্রাথমিক শিক্ষকই জানেন। কিন্তু, তা বলে এভাবে হুমকি! চাকরি খেয়ে নেওয়ার হুমকি শুধু নয়, সেই সঙ্গে একজন শিক্ষককে জেল খাটানোর মতো হুমকিও নাকি দিয়ে ফেলেন এসডিও নর্থ পূষ্পেন্দু সরকার। অভিষেকের অভিযোগ, এরপর যেন আরও মাত্রা ছাড়িয়ে যান পূষ্পেন্দু। নিজের পদমর্যাদা, একজন বিসিএস অফিসারের আচরণের সংযমকে ভেঙে ফেলে প্রায় মারমুখী হয়ে ওঠেন। অভিষেকের অভিযোগ, মহকুমা শাসক তাঁকে 'থাবড়ে মুখ ভেঙে দেব'-র মতো মন্তব্য করে বসেন।
ডিআই, জেলাশাসক এব ডিপিএসসি বর্ধমানের কাছে জমা করা লিখিতি অভিযোগে অভিষেক জানিয়েছেন, মহকুমা শাসক পূষ্পেন্দু সরকার তাঁকে বলেন 'থাবড়ে আপনার মুখ ভেঙে দেব। আপনার এতবড় সাহস যে আপনি ডিও-র ডিউটি নিতে অস্বীকার করেছেন? করেন তো প্রাইমারি চাকরি, কী ভাবেন নিজেকে? দেখবেন আমার ক্ষমতা? আপনাদের চাবকে পিঠের ছাল তুলে দেওয়া উচিত। চলে যান আমার সামনে থেকে, আপনার মুখও দেখতে চাই না।' অভিষেক জানিয়েছেন মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে তিনি মহকুমা শাসকের অফিস থেকে বেরিয়ে আসেন। কান্নায় চোখ ভিজেও আসে। পড়াশোনা করে রীতিমতো ভালো ফল করার পরই প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরিতে নিয়োগ পেয়েছিলেন। কিন্তু যেভাবে মহকুমা শাসক এক সাধারণ কর্মচারী ও ঊর্ধ্বতন অফিসারের মধ্যে ফারাকটা বোঝাতে যে রাস্তা নিলেন তার কি দরকার ছিল? হতাশ, মানসিকভাবে বিধ্বস্ত অভিষেক এরপর তাঁর পরিচিত শিক্ষকদের ফোন করে বিষয়টি জানান।
১৩ সেপ্টেম্বর দুপুর থেকে অন্তত শ'খানেক শিক্ষক হাজির হন বর্ধমানের এডিএম জেনারেলের দফতরে। সেখানে তাঁরা মহকুমা শাসক পূষ্পেন্দু সরকারের দুর্ব্যবহারের বিচার চান শুধু নয়, ঘটনার বিহিত না হলে কাজ বন্ধেরও হুঁশিয়ারি দিয়ে আসেন। এই বিষয়ে এডিএম জেনারেল ও অভিযুক্ত মহকুমা শাসক পূষ্পেন্দু সরকারের সঙ্গে ওয়ানইন্ডিয়া বেঙ্গলির তরফে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাঁদের দফতরে কেউ ফোন ধরেননি।
অভিষেক অভিযোগ নির্বাচন দফতরের সেকেন্ড অফিসার দাসবাবু ১০ সেপ্টেম্বর আচমকাই তাঁর স্কুলে আসেন। সেখানে টিচার রেজিস্ট্রার ও স্টুডেন্ট রেজিস্ট্রার তিনি সিজ করেন এবং সেই সঙ্গে তিনিও নানা হুমকি দিয়ে বেরিয়ে যান। অভিষেক গোটা ঘটনাতেই অবাক হয়েছিলেন। কারণ এই দাসবাবুকেই তিনি স্কুলের সমস্যার কথা জানিয়েছিলেন। তাহলে তিনি এসে আচমকা এভাবে তাঁকে হুমকি দেওয়ায় কার্যত বিস্মিত হয়েছিলেন। দাসবাবুও অভিষেকের কোনও কথা শোনেনি বলে অভিযোগ।
ডিও ও এলও-র ডিউটি নিয়ে এবার জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে নানা অসন্তোষের খবর আসছে। ২ মাস ধরে একটানা এবার ডিও এবং এলও-দের কাজ চলবে। কারণ ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ২ মাস ধরে ডিউটি-র জন্য শিক্ষকদের তুলে নেওয়া হলেও নিয়োগপত্রে বিভিন্ন ধোঁয়াশা রয়েছে যা নিয়ে সরব হয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষকরা। ইতিমধ্যে কলকাতা হাইকোর্টে এই নিয়ে মামলাও হয়েছে। নিয়োগপত্রের এই ধোঁয়াশা নিয়েই ২৮ অগাস্ট নাকাশিপাড়া বিডিও অফিসে প্রশিক্ষণ চলাকালে সরব হয়েছিলেন শাশ্বত ঘোষ নামে এক প্রাথমিক শিক্ষক। এর জন্য নাকাশিপাড়ার বিডিও সমর দত্ত তাঁকে চাকরি থেকে সাসপেন্ড করার হুমকি দেন। সমর দত্তের বিরুদ্ধে চমর দুর্ব্য়বহারের অভিযোগ এনেছিলেন শাশ্বত। সেই ঘটনার রেশ মেলাতে না মেলাতেই এবার বর্ধমানের মহকুমা শাসকের বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ সামনে এল। শিক্ষক ঐক্য সংহতি মঞ্চ এসডিও-র বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হওয়ার হুমকি দিয়েছে। শিক্ষক ঐক্য সংহতি মঞ্চের সদস্য মইদুল ইসলাম জানিয়েছেন, এবার ডিএল নিয়োগ নিয়ে বারবার বিভিন্ন অভিযোগ জমা পড়ছে। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা যেভাবে জোর করে ডিউটি চাপিয়ে দিচ্ছেন তা অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না।