জল সংকটে বিলুপ্তির পথে আত্রেয়ী, নদী বাঁচাতে শেষমেশ মমতা 'পিসি'-কে চিঠি স্কুল পড়ুয়াদের
নদী বাঁচাতে শেষমেশ মমতা 'পিসি'-র দ্বারস্থ হল একদল স্কুল পড়ুয়া। হারিয়ে যেতে বসা হলুদ পোস্টকার্ডে লেখা হল প্রায় শ'খানেক চিঠি।
নদী বাঁচাতে শেষমেশ মমতা 'পিসি'-র দ্বারস্থ হল একদল স্কুল পড়ুয়া। হারিয়ে যেতে বসা হলুদ পোস্টকার্ডে লেখা হল প্রায় শ'খানেক চিঠি। আর প্রত্যেক চিঠিতেই লেখা 'মমতা পিসি আমাদের আত্রেয়ী নদীকে বাঁচাও।' বৃহস্পতিবার আত্রেয়ী বাঁচাও আন্দোলনের চার বছর পূর্তিতে স্কুল পড়ুয়ারা এই সব চিঠি লেখে। এবার এই চিঠিগুলি পাঠানো হচ্ছে নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে।
জল সংকটে ভুগতে ভুগতে এখন আত্রেয়ী নদীর প্রায় বিলুপ্তির পথে। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার প্রাণভোমরা এই আত্রেয়ী। শিলিগুড়ির কাছে এর উৎপত্তিস্থল হলেও এর মূল প্রবাহ বাংলাদেশের মধ্যে। কিন্তু, বাংলাদেশ থেকে বেরিয়ে আত্রেয়ী দক্ষিণ দিনাজপুরের কুমারগঞ্জ ও বালুরঘাট ব্লকের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তা ফের বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
আত্রেয়ী নদীর উল্লেখ মহাভারতেও পাওয়া যায়। একটা সময় এই নদীর মাধ্যমেই তিস্তার জল প্রবাহিত হয়ে গিয়ে মিশত পদ্মাতে। কিন্তু, এক প্রবল প্রাকৃতিক দূর্যোগে তিস্তার সঙ্গে আত্রেয়ীর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর থেকেই জল সংকট শুরু আত্রেয়ীর। এই মুহূর্তে আত্রেয়ীর জলের উৎসস্থল জোড়পানি নদী। কিন্তু, আত্রেয়ীর জল সংকটের মূল সমস্যা শুরু হয়েছে ২০১২ সালে। এই সময় বাংলাদেশ সরকার নদীর উপরের অংশে 'রাবার ড্যাম্প' তৈরি করেছে। এর ফলে ভারতের অংশে থাকা আত্রেয়ীতে পর্যাপ্ত পরিমাণ জল আসছে না। জলের অভাবে ক্রমশই শুকিয়ে যাচ্ছে নদীখাত। তৈরি হচ্ছে বিশাল বিশাল চর। জলের অভাবে আত্রেয়ীর বুক থেকে হারিয়ে গিয়েছে অসংখ্য প্রজাতির মাছ। এককালে যে জীব বৈচিত্র্যের জগত আত্রেয়ীকে ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল আজ তা ভেঙে পড়েছে অথবা অবলুপ্তির পথে।
তিস্তার জল ছাড়া নিয়ে বারবার ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করছে বাংলাদেশ। কিন্তু, আত্রেয়ী জল বাংলাদেশ সরকার আটকে দেওয়ার ফলে যে ভারতের কুমারগঞ্জ ও বালুরঘাটের ব্লকের অন্তত কয়েক লক্ষ কৃষিজীবী এবং মৎস্যজীবী মানুষ যে রুটি-রুজি হারানোর পথে সে কথা সেভাবে প্রাধান্য পাচ্ছে না। এই আত্রেয়ী নদীর বালুররাশির উপরেই গড়ে ওঠেছে বালুরঘাট শহর। দক্ষিণ দিনাজপুরের অধিকাংশ খাল-বিল অথবা ছোট-খাটো নালার জলের উৎসও এই আত্রেয়ী। কিন্তু , জলের অভাবে যেখানে ধুঁকছে আত্রেয়ী সেখানে এই সব খাল-বিল-নালাগুলোর সংকট যে আরও গভীর তাতে কোনও সন্দেহ নেই। গ্রীষ্মকালে আর চাষের জমিতে জল সরবরাহ করতে পারছে না আত্রেয়ী।
তবে, জল সংকটের সঙ্গে সঙ্গে আত্রেয়ীর প্রবাহমানতায় থাবা বসিয়েছে পরিবেশ দূষণ। এই যুগেও এখনও বহু মানুষের প্রাতঃকৃত্য সারার স্থান এই আত্রেয়ী নদী। এছাড়াও বালুরঘাট শহরের লোকালয়ের সমস্ত বর্জ্য পদার্থের নিস্ক্রমণও ঘটেছে এই আত্রেয়ীর বুকে। বালুরঘাট পুরসভাও এই দূষণরোধে ব্যর্থ। রোজই নদীর ধারে ফেলে আসা হচ্ছে প্লাস্টিক ও আবর্জনা। এর সঙ্গে আছে নদীর মধ্যে প্রতিমা বিসর্জনের মতো সমস্যা। এমনকী, নদীর চরে তরমুজ ও শশার চাষে ব্যবহৃত বিষাক্ত সব রাসায়নিক জলের সঙ্গে মিশছে। এতে জল সংকটে থাকা আত্রেয়ী যেন আরও বিপন্ন।
আত্রেয়ী বাঁচাও আন্দোলনের জন্ম চার বছর আগে ২৯ মার্চ। দিশারী সংকল্পের উদ্যোগে চলছে আত্রেয়ী বাঁচাও। এখন পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর দফতরেও চিঠি পাঠানো হয়েছে। কিন্তু, কোনও সঠিক পদক্ষেপ হয়নি আত্রেয়ীকে নিয়ে।
পরিবেশবিদ তুহিনশুভ্র মণ্ডলের নেতৃত্বে আত্রেয়ীর পাড় ঘেষে তৈরি হয়েছে 'জলবন্ধু' দল। এই দলের সদস্য কচি-কাচারা। এদের কাজ হল হাতে বাঁশি নিয়ে আত্রেয়ীতে নজরদারি করা। কেউ নোংরা আবর্জনা ফেলতে এলে তাদেরকে আটকে দেয় এই 'জলবন্ধু'-দের দল। পরিবেশবিদ তুহিনশুভ্র মণ্ডল জানিয়েছেন, 'ছোটদের কে বাছার কারণ এরা ছোট থেকেই এই অভ্যাসের বশবর্তী হবে এবং নদী বাঁচাতে নিজেদের মন-প্রাণ অনায়সে সঁপে দিতে পারবে। আত্রেয়ীর পাড় ঘেষে এমন একাধিক জলবন্ধু-দের দল রয়েছে।' আত্রেয়ী বাঁচাতে এই 'জলবন্ধু'-রা এখন ব্যস্ত এক নাটকের মহড়ায়। যা বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আত্রেয়ীর পাড়েই মঞ্চস্থ হওয়ার কথা।
২৯ মার্চ আত্রেয়ী বাঁচাও আন্দোলনের চতুর্থ বর্ষপূর্তিতে বালুরঘাট সংলগ্ন অযোধ্যা, হাসোইল ও শালগ্রামে সাইকেল র্যালি করে অযোধ্যা কে ডি বিদ্যানিকেতনের পড়ুয়ারা। এদের সকলেরই আশা আত্রেয়ীকে বাঁচাতে আরও মানুষ তাদের পাশে এসে দাঁড়াবে।