দুর্গার একদিকে রাম, অন্যদিকে শিব, সাবর্ণ রায়চৌধুরী বংশের আটটি পুজোর প্রতিমাতেই এক রীতি
দুর্গাপুজো আর কলকাতা, দুয়েরই প্রতিষ্ঠা নিয়ে নানা মুনির নানা মত থাকতে পারে। কিন্তু সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপুজো মুঘল আমলেও যে স্বমহিমায় আয়োজন হত তার যথার্থ প্রমাণ মেলে। এমনকী প্রচলিত আছে, সম্রাট ঔরঙ্গজেব উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন সাবর্ণ রায়চৌধুরী বংশের পুজোয়। একই পরিবারে আটটি পুজো হয় বর্তমানে। আটটি পুজোতেই দুর্গার এক দিকে থাকে রাম, অন্য দিকে শিবের মূর্তি। তবে বাহন সিংহের মুখাবয়ব ক্ষেত্রবিশেষে আলাদা।
তখনও কলকাতা শহরের পত্তন হয়নি। তবে কলকাতা, সুতানুটি ও গোবিন্দপুর গ্রামের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। আর যাঁর হতে ধরে সুপ্রাচীন এই দুর্গাপুজোর পত্তন হয়েছিল, তিনি এই সাবর্ণ রায়চৌধুরী বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়। আদি নিবাস হালিশহরে হলেও তাঁর জমিদারির মূল কাছারি ছিল বড়িশায়। তাঁর জমিদারির অধিকারে ছিল ওই তিনগ্রাম। সেইথেকেই সাজো আটচালায় হয়ে আসছে সাবর্ণ রায়চৌধুরী বংশের আদি দুর্গাপুজো।
শুরু সেই ১৬১০-এ। নয় নয় করে ৪০৭তম বর্ষে পদার্পণ করল এই ঐতিহ্যশালী পরিবারের দুর্গোৎসব। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার লক্ষ্মীকান্তের কর্মজীবন শুরু হয়েছিল রাজা বসন্ত রায়ের তত্ত্বাবধানে। পরে যশোহরের রাজা প্রতাপাদিত্যের অধীনে তিনি মজুমদার পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন। সেই কারণে তাঁর পদবীতে ব্যবহার হত মজুমদার। পরে মহারাজ মানসিংহের সুপারিশে সম্রাট জাহাঙ্গিরের কাছ থেকে এক বিশাল জমিদারি এবং 'রায়চৌধুরী' উপাধি পেয়েছিলেন। এই পরিবার ছিল সাবর্ণ গোত্রীয়। সেখান থেকেই সাবর্ণ রায়চৌধুরী বংশ নামে উল্লেখ করা হয় এই পরিবারকে।
বর্তমানে সাবর্ণ রায়চৌধুরী বংশে মোট আটটি দুর্গাপুজো হয়। পরিবারের প্রাচীনতম পুজোটি হয় বড়িশার আটচালায়। অন্যান্য পুজোগুলো হয় ঠাকুরদালানে। বড়িশাতেই হয় মোট ছ'টি পুজো। 'আটচালাবাড়ি', 'বড়বাড়ি', 'মেজবাড়ি', 'মাঝের বাড়ি', 'বেনাকিবাড়ি' আর 'কালীকিঙ্করভবন'-এ। এ ছাড়াও 'বিরাটি বাড়ি' ও 'নিমতা বাড়ি'তে পুজো হয়ে আসছে। একমাত্র আটচালাবাড়ির পুজোয় কৃষ্ণানবমী কল্পারম্ভ হয়। অন্য পুজোগুলি শুরু হয় মহাষষ্ঠী থেকে।
ঐতিহাসিকদের মতকে প্রাধান্য দিয়ে কলকাতার জনক হিসেবে জব চার্নককেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সেই সূত্রে ১৬৯০-এর ২৪ আগস্ট কলকাতার জন্মদিন। সেই ঐতিহাসিক দিনটি থেকে ৮০ বছর আগে দুর্গাপুজোর প্রচলন হয় আদি কলকাতায়। দিল্লির মসনদে তখন সম্রাট জাহাঙ্গির। তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। ধীরে ধীরে কেটেছে জাহাঙ্গির ও শাহজাহানের আমল। মুঘল সম্রাট হয়েছেন আওরঙ্গজেব। দেশের সঙ্গে বাংলার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও পরিবর্তনের হাওয়া উঠেছে। আওরঙ্গজেবের ক্ষমতা ক্রমশ কমছে। তখন বাংলার সুবেদার ছিলেন বাদশাহের নাতি আজিম-উস-শান। দিল্লির ক্ষমতার প্রতি তাঁর লোভকে কাজে লাগিয়ে ইংরেজরা তিনটে গ্রাম কিনলেন সুবেদারের সঙ্গে চুক্তিতে। সেই গ্রামগুলি হল কলকাতা, গোবিন্দপুর এবং সুতানুটি, যা অধীন ছিল সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের।
১৬৯৮ সালের ১০ নভেম্বর ১৩০০ টাকার বিনিময়ে সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের থেকে তিনটে গ্রামের প্রজাস্বত্ব কিনে নিয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। আয়ারের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল বড়িশার ওই দুর্গা আটচালায় বসেই। দেশে মুসলমান সম্রাটদের আমলেও শহরে মা এসেছেন সাদরেই, তার প্রমাণ পাওয়া যায় এই ঐতিহাসিক চুক্তিতেও। বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরীর আটচালা বাড়ির পরতে পরতে ছড়ানো রয়েছে এমন অনেক তথ্য।
দেবীপক্ষের আগে কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথিতে দেবীর কল্পারম্ভ দিয়ে শুরু হয় মাতৃবন্দনা।
দুর্গা পঞ্চমীর দিন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, গণেশ ও শান্তির ঘটে পুজো করে শুরু এই পরিবারের দেবী বন্দনা। ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় আটচালা সংলগ্ন রাধাকান্ত মন্দিরে হয় আর একপ্রস্থ বোধন। এটাই চিরাচরিত রীতি এই পরিবারের পুজোয়। মহাসপ্তমীর সকালে প্রথমে দেবীর চক্ষুদান, তারপর নবপত্রিকা স্নান। গঙ্গার ঘাটে নয়, আটচালাতেই হয় মহাস্নান। সপ্ততীর্থের জল এনে একেবারে শাস্ত্রীয় মতে স্নানপর্ব মিটিয়ে বরণ করে নেওয়া হয় নবপত্রিকারূপী দেবী দুর্গাকে। প্রতিটা রীতি মেনে পূজার্চনা হয়।
কিছুক্ষেত্রে এই পরিবারের পুজো একেবারেই স্বতন্ত্র। সাবর্ণ রায়চৌধুরী বংশের আটটি পরিবারেই প্রতিমা তিন চালা। এতে আঁকা থাকে দশমহাবিদ্যা, দেবাসুর সংগ্রাম এবং রাধাকৃষ্ণের পট। এই পরিবারের সাতটি বাড়িতে পুজোয় আমিষ ভোগ হয়। নিমতার বাড়িতে বরাবর নিরামিষ ভোগের রীতি চলে আসছে। বড় বাড়ি, মেজবাড়ি ও নিমতার বাড়ির প্রতিমায় সিংহ ঘোটক আকৃতির। অন্যান্য বাড়িতে সাধারণ সিংহ। বড় বাড়ি ও বিরাটির বাড়িতে নবমীর দিন কুমারী পুজো হয়। পুজোর সময় দশমহাবিদ্যারও পুজো করা হয়। পরিবারের এই আটটি পুজোতেই দুর্গার এক দিকে থাকে রাম, অন্য দিকে শিবের মূর্তি।
তবে সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়ির পুজোয় এখন আর পশুবলী হয় না। আগে ১৩টি ছাগবলি হত। হত মোষবলিও। এখন শুধু বলিদান প্রথা অটুট রাখতে আখ, ছাঁচিকুমরো বলি হয়। সপ্তমী থেকেই হোম এই বাড়ির রীতি। তিনদিনে মোট ১০০৮টি বেলপাতার উৎসর্গ করা হয়। চামুণ্ডারুপী দেবীর সন্ধিপুজোও হয় ঘটা করে। আর বিজয়া পর্বে রয়েছে বিশেষ চমক। ঘট বিসর্জনের পর্ব মিটে গেলেই প্রতমার সামনেই বয়ঃজ্যেষ্ঠদের প্রণাম করার বিধি এই বাড়িতে। মণ্ডপে প্রণামের রীতি সাধারণত থাকে না কোনও বাড়িতেই। এ ব্যাপারে একেবারে স্বতন্ত্র সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার। আগে মানুষের কাঁধে চড়ে দেবীর নিরঞ্জন হত আদিগঙ্গায়। এখন বাবুঘাটে বিসর্জন দেওয়া হয় প্রতিমার।