আসছে নির্বাচন, জাতি হিংসার দাপট বাড়ছে পশ্চিমবঙ্গে, বলছে কেন্দ্রের রিপোর্ট
এখনও পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জাতি হিংসার ঘটনায় সবার উপরে আছে 'গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং'।
এখনও পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জাতি হিংসার ঘটনায় সবার উপরে আছে 'গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং'। ১৯৪৬ সালে অবিভক্ত বঙ্গে এই জাতি হিংসার ভয়াবহতা এতটা মারাত্নক রকমের ছিল যে আজও সেই ঘটনার স্মৃতিচারণা আতঙ্কে ফেলে দেয়। এরপর বিভক্ত বঙ্গে যে জাতি হিংসা হয়নি তা নয়, সেগুলিকে খুব সহজে প্রশমিতও করা গিয়েছে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময় কলকাতায় হিংসার আগুন জ্বলেছিল। কিন্তু, জ্যোতি বসুর একটা কথা - ' দাঙ্গা করতে এলে পুলিশকে বলেছি গুলি করে দিতে।' এরপর আর হিংসা আগুন জ্বালাতে আর কেউ সাহস পায়নি।
জাতি হিংসা নিয়ে রাজনীতি তাই বঙ্গে খুব একটা চালু বিষয় নয়। কিন্তু, ২০১৬ সাল থেকেই যেন পশ্চিবঙ্গে জাতি হিংসা বদ্ধির প্রবণতা তৈরি হয়েছে। আর এর চূড়ান্ত ইঙ্গিত যেন এবার মিলল রাম নবমীকে ঘিরে হওয়া হিংসায়। যে হিংসাকে প্রশমিত করার বদলে চলছে প্রবল রাজনীতি। শাসক দল হোক বা বিরোধী একটি বিশেষ দল কেউ জায়গা ছাড়তে রাজি নয়।
পশ্চিমবঙ্গে যে জাতি হিংসা বৃদ্ধি পাচ্ছে তার ইঙ্গিত মিলেছে এক কেন্দ্রীয় রিপোর্টে। আর এই রিপোর্টে সংসদে প্রকাশ করেছেন খোদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী হংসরাজ গঙ্গারাম আহির। ৬ ফেব্রুয়ারি সংসদে তিনি এই রিপোর্ট সংসদে পেশ করেছিলেন।
হংসরাজ গঙ্গারামের পেশ করা রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে ২০১৫ সালে ২৭টি জাতি হিংসার ঘটনা রেকর্ড হয়েছে। এতে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল এবং ৮৪ জন জখম হয়েছিলেন। কিন্তু, ২০১৭ সালে এই জাতি হিংসার ঘটনা যে দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় রিপোর্টে প্রকাশ ২০১৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে ৫৮টি জাতি হিংসার ঘটনা ঘটেছিল। এতে মৃত্যু হয়েছে ৯ জনের। জখমের সংখ্যা ২৩০।
জাতি হিংসার ঘটনা যে ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালেও বৃদ্ধি পেয়েছিল তাও রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে ৩২টি জাতি হিংসার খবর নথিবদ্ধ করেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। সন্দেহ নেই ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭সালে জাতি হিংসার ঘটনার সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ।
সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে এই তথ্য সামনে নিয়ে আসে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। জাতি হিংসার ঘটনা যে পশ্চিমবঙ্গ খুব একটা ঘটে তেমন কথা কেন্দ্রীয় রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়নি। তবে, ২০১৫ সালের থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে দুই জাতির মধ্যে হিংসার ঘটনা যে বৃদ্ধি পেয়েছে তা কেন্দ্রীয় রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
এমনকী, রিপোর্টে এটাও দেখানো হয়েছে যে ২০১১ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে বছরে গড়ে ২০টি করে হিংসার ঘটনা নথিবদ্ধ হয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের রেকর্ড বই-এ। ২০১২ ও ২০১৩ সালের মধ্যে বছরে এই হিংসার ঘটনার গড় ছিল ২৩ থেকে ২৪টি। কিন্তু, এই হিংসার ঘটনার মধ্যে সবগুলি জাতি হিংসার ঘটনা নয়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে ২০১১ ও ২০১৪ সালে জাতি হিংসার ঘটনার সংখ্যাটা ছিল যথাক্রমে ১৫ ও ১৬।
২০১০ সালে বাম শাসনের জামানাতে ২১টি হিংসার ঘটনা ঘটেছিল। এতে মৃত্যু হয়েছিল ৬ জনের। জখম হয়েছিল ৮২ জন।
নতুন বাংলা বর্ষ পড়ার লগ্নে যে ভাবে রামনবমীকে ঘিরে জাতি হিংসার আবহ তৈরি হয়েছে তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বহু বিশিষ্ট মানুষ। এদের মধ্যে অনেকেই রামনবমী নিয়ে দুই রাজনৈতিক দলের রাজনীতিকেই দায়ী করেছেন। এঁদের মতে, জাতি হিংসার রাজনীতি যে এ রাজ্যের পক্ষে কতটা ভয়ঙ্কর তা এই রাজনৈতিক দলগুলি অনুধাবন করতে পারছে না।
এই বিশিষ্ট মানুষদের মধ্যে অনেকরই বক্তব্যে, যেখানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খোদ অস্ত্রহীন মিছিল করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেখানে তাঁর দল তৃণমূলেরই নেতারাও বহু জায়গায় তা মানেননি। এঁদের মতে, বিজেপি-র দেখাদেখি জেলার কিছু প্রভাবশালী তৃণমূল নেতা আচমকা রাস্তায় নেমে গৈরীকরণের রাজনীতি করতে যাওয়াতে বিপদ আরও বেড়েছে। এক্ষেত্রে তৃণমূল কংগ্রেস নীতিগতভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারত বলেই মনে করছেন এই সব বিশিষ্ট মানুষ। গা-জোয়ারি রাজনীতির ফলে যে অশান্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে উদ্বেগে এখন রাজ্যের একটা অংশের মানুষ। সকলেরই একটা প্রশ্ন সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচন, আর তারপরই লোকসভা নির্বাচনে দামামা বেজে উঠবে- সুতরাং ক্ষমতা দখলের রাজনীতি আর বেশি করে ইন্ধন জোগাবে না তো পশ্চিমবঙ্গের জাতি হিংসার বাড়-বাড়ন্তে?