উত্তর কলকাতায় রণক্ষেত্র: দলীয় মেরুকরণের অজগর ফের গিলছে রাজ্য রাজনীতিকে
মঙ্গলবার উত্তর কলকাতা কেন্দ্রে দলের প্রার্থী রাহুল সিংহের হয়ে প্রচার করতে এসেছিলেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ।
মঙ্গলবার উত্তর কলকাতা কেন্দ্রে দলের প্রার্থী রাহুল সিংহের হয়ে প্রচার করতে এসেছিলেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ। আর তাঁর এই হাই-প্রোফাইল প্রচারকে কেন্দ্র করে প্রথমে উত্তেজনা ও পরে রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় কলেজ স্ট্রিট অঞ্চল। বিরাট আয়োজন করে অমিত শাহের রোড শো শুরু হলেও দিনের শেষে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা ও সংঘর্ষ হয় বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস ছাত্র পরিষদ-এর সমর্থকদের মধ্যে। সংঘর্ষ, ইট ছোঁড়াছুঁড়িতে জখম হন বেশ কয়েকজন। বিদ্যাসাগর কলেজে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙে ফেলে দুষ্কৃতীরা।
পারস্পরিক দোষারোপ চলছেই
যথারীতি এই ঘটনা নিয়ে চাপান উত্তর শুরু হয়ে গিয়েছে বিজেপি এবং রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আক্রমণ করেছেন অমিত শাহকে এবং বিজেপি সভাপতিও পাল্টা দুষেছেন তৃণমূল নেত্রীকে। এদিন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক হিংসার বিষয়ে রাজ্য সরকারকে একহাত নেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংও। তিনি মমতাকে দায়ী করেন। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি মমতাকে একনায়কের সঙ্গেও তুলনা করেন।
ঘটনা হচ্ছে, রাজ্য রাজনীতিতে মারামারি-হিংসার ট্র্যাডিশন নতুন কিছু নয়। এখন এই লড়াইয়ের যুযুধান পক্ষ হচ্ছে তৃণমূল ও বিজেপি -- একসময়ে যারা একই জোট বা সরকারের অংশ ছিল। কী এমন ঘটল যে আজ এই দুই দলের মধ্যে এমন সাপে-নেউলে মারামারি?
মমতা চাপ বোধ করছেন আর লড়াইটা রাস্তায় হচ্ছে
আসলে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝেছেন যে অদূর অতীতে পশ্চিমবঙ্গে তাঁর কোনও বিরোধীপক্ষ না থাকলেও বিজেপির ক্রমাগত উত্থানের ফলে সেই পরিসরটি কমছে। আর বিজেপি যে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী ভাবাদর্শের রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে শুরু করেছে, তাতে সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কের অভিভাবক হিসেবে মমতা বেশ চাপ বোধ করছেন। মুখে বলছেন বিয়াল্লিশে বিয়াল্লিশটিই জিতবেন কিন্তু সেই কাজ যে খুব সহজ হবে না, তা তিনি খুব ভালো করেই জানেন। বিজেপির রাজনীতির পাল্টা এক সংখ্যাগুরু ভাবাবেগকে খুশি করার রাজনীতি তিনিও শুরু করেছেন কিন্তু তাতে শহরাঞ্চলে বিশেষ কাজ দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় বিজেপির প্রতিনিধিত্ব সেভাবে নেই আর ব্যক্তিগত পর্যায়েও তৃণমূল ও বিজেপির নেতাদের মধ্যে সৌজন্যতাবোধ রক্ষা করার বিশেষ বালাই নেই। তাই শেষমেশ লড়াইটি গিয়ে দাঁড়াচ্ছে রাস্তার খণ্ডযুদ্ধে। এই খণ্ডযুদ্ধ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বরাবরই এক বড় ভূমিকা পালন করেছে -- বাম আমলে বামেদের সঙ্গে কংগ্রেসের বা তৃণমূলের সংঘর্ষ বা তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে তৃণমূলের হাতে বামেদের মার খাওয়ার ঘটনা নতুন করা বলার নয়। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে মাত্রাছাড়া দলীয় মেরুকরণের বৈশিষ্ট্য বাম আমলের আশীর্বাদ। আর এখন বামেরা কফিনে চলে গেলেও ঐতিহ্যে কোনও ভাঁটা পড়েনি। ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদের লড়াইয়ের নিস্পত্তি আজও হচ্ছে পথেঘাটে ইট-পাথর ছোঁড়াছুঁড়ির মধ্যে দিয়েই।
বিজেপিও এখন পাল্টা মার দিতে উদ্যত কারণ তাদের অস্তিত্বরক্ষার পথ ওটাই
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি প্রথমে তৃণমূলের কাছে মার খেলেও এবারে তারাও পাল্টা দিতে শুরু করেছে। বোঝা যাচ্ছে, তাদের সাধারণ হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পাশাপাশি এই পাল্টা মার দেওয়ার মারাত্মক খেলাটি তারা শিখে নিয়েছে খুব তাড়াতাড়ি কারণ সংগঠন দুর্বল হওয়াতে তাদের অস্তিত্বরক্ষার প্রধান হাতিয়ার এখন এটাই। আর শহরাঞ্চলে বিজেপির প্রধান সমর্থনভিত্তি হওয়াতে খোদ কলকাতার বুকেই বেধে যাচ্ছে তুমুল সংঘর্ষ।
তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব যেভাবে বিজেপির শীর্ষনেতৃত্বকে আক্রমণ করছেন, তাতে বোঝাই যায় যে গেরুয়াবাহিনীর উপরে এই শারীরিক আক্রমণের খুব শিগগিরই বিরতি আসবে না। কিন্তু নির্বাচনের সময়েই যদি নিরাপত্তার কড়াকড়িতে এই অবস্থা হয়, নির্বাচনের ফলাফলের পরে কী অবস্থা হতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গে তা ভাবলেই শিউরে উঠতে হয়।