‘নিজেকে মমতার প্যারালাল ভাবছেন’, একান্ত সাক্ষাৎকারে বিস্ফোরক মুকুল-অনুগামী
নতুন দল করে তিনি কেন সেই পথে পা বাড়ালেন না। কেন সেই সাহস দেখাতে পারলেন না মুকুলবাবু। তা নিয়েই মুখ খুললেন জাতীয়তাবাদী তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি অমিতাভ মজুমদার।
দলে গুরুত্ব হারিয়ে তৃণমূল ছেড়েছেন। এখন দলহীন 'একা' তৃণমূলের এককালের সেকেন্ড ইন কম্যান্ড মুকুল রায়। তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়েই এখনও রয়েছে বড় প্রশ্নচিহ্ন। নানা মহলে নানা জল্পনা চলছে। পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ মুকুল রায় সবদিক বিচার-বিবেচনা করে বিজেপি অভিমুখেই পা বাড়িয়ে রেখেছেন।
কিন্তু নতুন দল করে তিনি কেন সেই পথে পা বাড়ালেন না। কেন সেই সাহস দেখাতে পারলেন না মুকুলবাবু। তা নিয়েই মুখ খুললেন জাতীয়তাবাদী তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি অমিতাভ মজুমদার। মুকুল রায় দল ছাড়ার পরই কেনই বা জাতীয়তাবাদী কংগ্রেসে ভাঙন স্পষ্ট হয়ে উঠল, কী তার উদ্দেশ্য, তা নিয়েও অকপট প্রবীণ এই রাজনীতি বিশ্লেষক।
জাতীয়তবাদী তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি অমিতাভ মজুমদার কী জানালেন 'ওয়ান ইন্ডিয়া বেঙ্গলি'-র প্রতিনিধিকে, তারই একঝলক।
ওয়ান ইন্ডিয়া : তৃণমূল ছাড়ার পর মুকুল রায় এখন বিজেপির দিকে পা বাড়িয়ে রয়েছেন। তাঁর বিজেপিতে যাওয়া এখন স্রেফ সময়ের অপেক্ষা বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। অনেক আশা নিয়ে আপনারা দল করেছিলেন। ভেবেছিলেন মুকুল রায় আপনাদের দলের নেতৃত্বভার তুলে নেবেন। কিন্তু তা হয়নি। কেন পুরো পরিস্থিতি মোড় নিল অন্য দিকে, কী বলবেন?
অমিতাভ মজুমদার : ২০১৫ সালে দল তৈরি হয়েছিল। তখন এক অন্য বাতাবরণ ছিল। তারপর ভাগীরথী দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। জাতীয়তাবাদী তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি হওয়ার প্রায় দু-বছর পর মুকুল রায় তৃণমূল ছেড়েছেন। এখনও তিনি দলহীন। নিজে এখনও স্থির করে উঠতে পারেনি, কোন পথ যাবেন। তিনি নিজেকে বাঁচানোর জন্য এখন বড় ডাল ধরতে চাইছেন। আর সেই কাজে ব্যবহার করতে চাইছেন জাতীয়বাদী তৃণমূল কংগ্রেসের মতো সদ্য অঙ্কুরিত দলকে।
ওয়ান ইন্ডিয়া : নতুন দল করেও কেন মুকুল রায় পা বাড়ালেন না এই জাতীয়তাবাদী তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে? কী উদ্দেশ্যে তিনি বিজেপি পথগামী এখন? কী মনে করেন, এর পিছনে কোনও বিশেষ রহস্য রয়েছে?
অমিতাভ মজুমদার : এই দলটা যে তাঁর নির্দেশেই তৈরি হয়েছিল, তা নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। কিন্তু তিনি কখনও স্বীকার করেননি, তিনিই এই দলের পরিকল্পনায় ছিলেন। আগাগোড়া তিনি অস্বীকার করে গিয়েছেন সবকিছু। তিনি নিজের ঘনিষ্ঠদের নিয়ে দল তৈরি করিয়েছিলেন। এখন উনি মনে করছেন বিজেপিকে দেখাতে এই দলের মাথায় বসাতে হবে এক সংখ্যালঘু মুখ। জাতীয়তাবাদী তৃণমূলের মধ্যে ভাঙন তৈরি করে সংখ্যালঘু এক নেতাকে মাথায় বসানোর পিছনে উনিই কলকাঠি নেড়েছেন। কিন্তু এই কাজ করে তিনি সংখ্যালঘু মুসলিমদেরই অপমান করেছেন। কারণ তিনি একজন বাঙালি মুসলিমকে পেলেন না ওই পদে বসানোর জন্য। একদন উর্দুভাষী সংখ্যালঘু মুসলিমকে বসিয়েছেন দলের মাথায়। উনি বুঝিয়ে দিয়েছেন বাংলার মুসলিমদের প্রতি তাঁর ভরসা নেই।
ওয়ান ইন্ডিয়া : দল ছাড়ার পরও মুকুলবাবু সারদা-নারদ নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে 'ক্লিনচিট' দিয়েছেন? কেন মমতার প্রতি এখনও এত আনুগত্য মুকুল রায়ের? একজন রাজনৈতিক বিশ্লেশক হিসেবে কী ব্যাখ্যা দেবেন আপনি?
অমিতাভ মজুমদার : মুকুল রায় প্রথমে সারদা-নারদ নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ক্লিনচিট দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিছুই জানতেন না এই ব্যাপারে। এই দায়ভার যে যাঁর ব্যক্তিগত। এর সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা দলের কোনও সম্পর্ক নেই। এ প্রসঙ্গে তাহলে তো প্রশ্ন উঠতেই পারে, উনি কি স্বীকার করে নেবেন তাহলে ওই তালিকায় তিনি নিজেও পড়েন!
ওয়ান ইন্ডিয়া : মুকুল রায়ের এই ধরনের আনুগত্য প্রকাশ কি পরবর্তী সময়ে তাঁর তৃণমূলে ফেরার রাস্তা খুলে রাখার একটা প্রয়াস?
অমিতাভ মজুমদার : রাজনীতিতে অসম্ভব বলে কিছুই নেই, তিনি ফিরতেই পারেন। কিন্তু তাঁকে এবার আর মাথা উঁচু করে ফিরতে দেখা যাবে না। নতজানু হয়েই তাঁকে ফিরতে হবে তৃণমূলে। এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে মুকুল রায় তৃণমূল ছাড়ার পর দলে একটা ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়েছিল। তা কিন্তু ওই পানাপুকুরে ঢিল পড়ার মতো। ঢিল পড়ার পরই ফাঁকা হয়ে যায়। তারপর অচিরেই তা ফের পূরণ হয়ে যায়। তৃণমূলেও তেমনই তাঁর জায়গা পূরণ হয়ে গিয়েছে, পূরণ হয়ে যাবেও।
ওয়ান ইন্ডিয়া : আপনিই তো অভিযোগ করেছিলেন, মুকুল রায় তৃণমূলের চর। বিজেপিতে যাচ্ছেন তাঁদের সাজানো সংসার ঘেঁটে দিতে। চিঠি দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ, কৈলাশ বিজয়বর্গীয়দের।
অমিতাভ মজুমদার : হ্যাঁ, আমি এই চিঠি লিখেছিলাম। কিন্তু তা করেছিলাম আশঙ্কা থেকেই। আমার মনে হয়েছিল, এর পিছনে তৃণমূলেরই খেলা রয়েছে। কেননা, তৃণমূল ছাড়ার পর মুকুল রায়ের কিছু বক্তব্যে এমন একটা ইঙ্গিত পেয়েছিলাম। কিন্তু পরবর্তী সময়ে উপলব্ধি করেছি, বিজেপি একটা বড় দল, তারা কি এমন বালখিল্য কাজ করবে? বিজেপি জেনে বুঝেই নিশ্চয়ই এগোচ্ছে। তা না হলে কেন্দ্রীয় তরফে তাঁকে বিজেপিতে নেওয়ার জন্য এত তোড়জোড় হত না।
ওয়ান ইন্ডিয়া : হঠাৎ মুকুল রায়কে নিয়ে আপনার এই মোহভঙ্গ কেন? আপনি তো তাঁর পাশেই ছিলেন। তাঁর নির্দেশেই তো দল গড়েন, তৃণমূল ভেঙে বাংলার রাজনীতিতে নতুন সম্ভাবনার জন্ম দিতে চেয়েছিলেন।
অমিতাভ মজুমদার : তখন এমন একটা পরিস্থিতি ছিল। সেটা ২০১৫ সাল। তৃণমূল ছেড়ে মুকুল রায় বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। সংগঠিতও করেছিলেন অনেকে। তখন যদি তিনি বেরিয়ে আসতেন তাহলে বিপ্লব ঘটে যেত। কিন্তু তখন তিনি আমাদেরকে এগিয়ে দিয়ে নিজে কেটে পড়েছিলেন। একপ্রকার বেইমানি করেছিলেন তাঁর অনুগামীদের একাংশের সঙ্গে। তাই এখন তাঁর সঙ্গে অনেকেই নেই। তাঁরা আর কেউ সাহস করছেন না মুকুল রায়ের সঙ্গে যেতে।
ওয়ান ইন্ডিয়া : কিন্তু মুকুল রায়ের সঙ্গে তো এখনও অনেকে রয়েছেন, তাঁর ইতিমধ্যে দল ছেড়ে বসে রয়েছেন। বলছেন, দাদা যখন নেই, আমাদেরও তৃণমূলে জায়গা নেই। দাদা যেখানে যাবেন, আমরাও সেখানে থাকব।
অমিতাভ মজুমদার : ওঁরা সব পোঁ-এর দল। ওঁদের মতিগতি ওরকমই। ওঁদের দিয়ে কোনও দল চলতে পারে না। এখন মুকুল রায়ের সঙ্গে এমন কেউ নেই, যারা চলে গেলে তৃণমূলের মাথাব্যথা হতে পারে। আবার ২০১৫ সালে মুকুল রায় তৃণমূল ছাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হলে, যে ভিড় ছিল মুকুল রায়কে ঘিরে, এখন আর তা নেই। চোখ খোলা রাখলেই পুরো চিত্রটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
ওয়ান ইন্ডিয়া : মুকুল রায় এতদিন তৃণমূলের সংগঠন একার হাতে রক্ষা করে গিয়েছেন। প্রতি জেলাতেই তাঁর একটা নিজস্ব সার্কেল রয়েছে। যাঁরা মনে করেন, মুকুল রায়ই তাঁদের জেলা সভাপতি। তবু মুকুল রায়ের কোনও ক্যারিশ্মা নেই বলছেন।
অমিতাভ মজুমদার : এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে মুকুল রায় তৃণমূলের জন্য রাতদিন এক করে কাজ করেছেন। সংসারের তোয়াক্কা করেননি। ঘর ছেড়ে দলের জন্য তাঁর নিয়োজিত প্রাণ। ২৪x৭ ঘণ্টা সময় দিয়েছেন। অক্লান্ত করেছেন তৃণমূলকে দাঁড় করানোর জন্য। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মাথার উপর না থাকলে তৃণমূল আজ এই জায়গায় যেত না। মমতার আশীর্বাদ ছাড়া এমন একজন রয়েছেন ওই দলে, যে জিতে আসতে পারবেন। এমনকী শিশির অধিকারী-শুভেন্দু অধিকারীরাও মমতা ছবির উপর নির্ভরশীল।
ওয়ান ইন্ডিয়া : তাহলে কি বলছেন মমতাকে ছাড়া মুকুল রায় ফ্লপ হবেন?
অমিতাভ মজুমদার : দলে তিনি ২ থেকে ২০০ নম্বরে নেমে গিয়েছিলেন এক লহমায়। আমি সমর্থন না থাকতে পারে, আমি অন্য মতাদর্শ বিশ্বাসী হতেই পারি। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বলেই তৃণমূলের উত্থানের কথা অস্বীকার করা যাবে না। মুকুল রায় এখন নিজেকে মমতার প্যারালাল ভাবছেন। কিন্তু তা কি সম্ভব। তাই এই মুহূর্তে মুকুল রায়ের কাছে বিজেপি ছাড়া দ্বিতীয় কোনও পথ খোলা নেই।
ওয়ান ইন্ডিয়া : আপনি কি মনে করেন তিনি বিজেপিতেই নাম লেখাতে চলেছেন?
অমিতাভ মজুমদার : কান পাতলে তো এমনটাই শুনতে পাচ্ছি। সর্বত্রই একই আলোচনা। শুনতে পাচ্ছি শনিবার তিনি যোগ দেবেন। কিন্তু আমার মনে হয় শনিবার মুকুল রায়কে শুধুমাত্র আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বিজেপির কেন্দ্রীয় দফতরে। বিজেপি-র দেওয়ালি সমাবর্তন অনুষ্ঠান রয়েছে। সেই অনুষ্ঠানে মুকুলবাবুকে ডেকে গৌরচন্দ্রিকা করে রাখতে চাইছেন বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। প্রথাগত দলে যোগদানের অনুষ্ঠান পরে।
ওয়ান ইন্ডিয়া : এখন যদি মুকুল রায় বিজেপিতে না গিয়ে জাতীয়তাবাদী তৃণমূল কংগ্রেসে আসেন, ফের একসঙ্গে দল করবেন?
অমিতাভ মজুমদার : ২০১৫ আর ২০১৭- আকাশ পাতার তফাৎ। রাজনৈতিক পরিস্থিতি পুরোপুরি ভিন্ন। তখন মুকুল রায় দল করলে কেন্দ্রে ও রাজ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় থাকতেন। নির্ণায়ক শক্তি পর্যন্ত হতে পারতেন। ২০১৬-য় তৃণমূল ক্ষমতায় এলেও, ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলত তাঁর দল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পুরো ভিন্ন। তিনি নিজের সিকিউরিটির কথা আগে ভাবছেন। আর নতুন দল করলেও, আগের মতো সেই প্রভাব পড়বে না বঙ্গ রাজনীতিতে।
ওয়ান ইন্ডিয়া : মুকুল রায় বিজেপিতে গেলে কি তৃণমূলের সেভাবে কোনও ক্ষতি হবে? বিজেপির কি আদৌ কোনও লাভ হবে?
অমিতাভ মজুমদার : মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জলকল্যাণকর প্রকল্পের রূপায়ণে গ্রামবাংলার বুকে শক্ত ভিত তৈরি করে নিয়েছেন। আর বিজেপি সেভাবে কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলির প্রচার করতে ব্যর্থ। ফলে যতই মুকুল রায় যান, তাঁর হাতে তো আর আলাদিনের আশ্চর্যপ্রদীপ নেই যে, তিনি রাতারাতি বিজেপির পরিবর্তন এনে দেবেন। আর যদি বলেন মুকুল রায় গেলে তাঁর সঙ্গে অনেকেই বিজেপিতে ভিড় জমাবে, তাহলে আমার উত্তর পাড়ার মোড়ে ডুগডুগি বাজালেও লোকর ভিড় হয়। তারপর মুকুল রায় সবুজ পোশাক ছেড়ে গেরুয়া বসনে কেমন দেখতে লাগছে, তাও তো লোকে দেখতে যাবে।
ওয়ান ইন্ডিয়া : তাহলে কি মুকুল রায় জাতীয়তাবাদী তৃণমূল কংগ্রেসে এলেই ভালো করতেন?
অমিতাভ মজুমদার : ২০১৫-য় দল করলে তিনি প্রিমিয়ার ডিভিশনে খেলতেন। আর এখন দল করলে তাঁকে তৃতীয় ডিভিশন থেকে খেলা শুরু করতে হবে। ফলে তার ফল কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এখন মুকুল রায় সমস্ত কিছু হারিয়ে বসে আছেন, তাঁর বিজেপি ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই।
ওয়ান ইন্ডিয়া : আপনি কি মনে করেন মুকুল রায়ের বিজেপিতে পা বাড়ানো সারদা-নারদ থেকে বাঁচতেই?
অমিতাভ মজুমদার : আমার তো তেমনই মনে হয়। কেননা এখন ভগবান, আল্লা থেকে শুরু করে গুরুদ্বার পর্যন্ত যেভাবে তাঁর বিশ্বাস বেড়েছে, তাতে এটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। ধর্মে তাঁর মতি দেখেই মনে মুকুল রায় নিজে বাঁচতে চাইছেন। সবার আগে চাইছেন নিরাপদ নিরাপত্তা।
ওয়ান ইন্ডিয়া : আপনাদের পরবর্তী লক্ষ্য কী? কী করবেন জাতীয়তাবাদী তৃণমূল কংগ্রেস নিয়ে?
অমিতাভ মজুমদার : সময় হলেই সব দেখতে পাবেন। ক্রমশ প্রকাশ্য। তবে এটুকু বলতে পারি পঞ্চায়েতে আমরা লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। সময় বলবে সবই। ধৈর্য ধরতে হবে তাঁর জন্য।