এই বিমান আর উড়বেন না; এই সূর্যও আর আলো দেবেন না; কিন্তু তরুণ আনলেই কি বামেদের ঘোড়া দৌড়বে?
অগ্ন্যুৎপাতটি ছিল স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। ২০০৯ সালে যেই পতন শুরু হয়, এক দশকের মধ্যে তার বৃত্ত পূরণ হল পশ্চিমবঙ্গের বামেদের।
অগ্ন্যুৎপাতটি ছিল স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। ২০০৯ সালে যেই পতন শুরু হয়, এক দশকের মধ্যে তার বৃত্ত পূরণ হল পশ্চিমবঙ্গের বামেদের। সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে বঙ্গীয় বামেরা পেয়েছে মাত্র সাত শতাংশ আসন এবং আসন পায়নি একটিও। ২০০৪ সালেও যেখানে পশ্চিমবঙ্গে বামেদের আসন সংখ্যা ছিল ৩৫ এবং ভোট শতাংশ ৫০-এর উপরে, সেখানে দেড় দশক পরে আসন সংখ্যা গিয়ে ঠেকেছে শূন্যতে এবং ভোট শতাংশ মাত্র সাতে। একে কী বলা যেতে পারে? শুধু একটি রাজনৈতিক পরাজয় নাকি একটি আস্ত মতাদর্শকে আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলা?
২০০৮-এই শুরু হয় বামেদের চূড়ান্ত অবক্ষয়
প্রথমটিই অবশ্যই এবং প্রথমটির হাত ধরে দ্বিতীয়টিরও প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বামেদের অবক্ষয় চলছিল অনেকদিন ধরেই। যখন বামেদের নিজেদের পুনরায় আবিষ্কার করার প্রয়োজন ছিল, তখন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সিঙ্গুর প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ায় একটি ঐতিহাসিক সুযোগ হেলায় হারায় বামেরা এবং সেখান থেকেই পতনের রাস্তা পরিষ্কার হয়। দু'হাজার আট সালটি পশ্চিমবঙ্গের এবং সর্বভারতীয় বামেদের কাছে এক কালো বছর ছিল। একদিকে টাটারা সিঙ্গুর থেকে কারখানা প্রত্যাহার করে নেন এবং অন্যদিকে প্রকাশ কারাতের নেতৃত্বে বামেরা কেন্দ্র সরকার থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু চুক্তির বিরোধিতা করে সমর্থন তুলে নেন। ঐতিহাসিক কী না জানা নেই, কিন্তু এই ভুলদ্বয়ের ফলে বামেরা সেই যে পথে বসেন, আজও আশ্রয় খুঁজে পাননি। আর মড়ার উপরে খাঁড়ার ঘা হিসেবে নেমে আসে বর্ষীয়ান নেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে দল থেকে বহিষ্কার। দলের অন্যতম বড় মাথা হরকিষেন সিং সুরজিৎ মারা যান ২০০৮-এরই অগাস্ট মাসে এবং অশীতিপর জ্যোতি বসু তখন আর সক্রিয় রাজনীতিতে নেই।
কে হাল ধরবেন বামেদের? বৃদ্ধ, নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত মাঝারি নেতারা?
এই সমস্ত ঘটনা এবং ২০১১তে পশ্চিমবঙ্গে বামেদের গণেশ পাকাপাকিভাবে উল্টে যাওয়ার পরে যে উদ্যোগের সঙ্গে পুনর্গঠন করার প্রয়োজন ছিল সমস্ত দলটির, তা হয়নি। আর করবেই বা কে? বামেদের মধ্যে তো তখন অতীতশক্তি বৃদ্ধ এবং চুনোপুঁটি নেতাদের ভিড়। এই মাঝারি মানের নেতারা মার্ক্স্-লেনিন-এর ছবি দেখে মাথা নোয়ালেও কেন নোয়াচ্ছেন তা বিশদে জানেন কী না সন্দেহ রয়েছে। বামেদের এই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে একটি বিশ্বব্যাপী প্রবণতা থাকলেও তাঁদের নিজেদের দোষেও আজ তাঁদের অস্তিত্বই বিপন্ন।
নতুন নেতা উঠে আসেন না কারণ বাম শিবিরে নতুন নেতা উঠে আসা সহজ নয়
এই বিপন্নতার অন্যতম বড় কারণ তাঁদের মরচে ধরা নেতৃত্ব। সেই পক্ককেশ বিমান বসু, সেই সূর্য্যকান্ত মিশ্রের মুষড়ে পড়া শরীরী ভাষা অথচ তবু তাঁদের বিকল্প কাউকে তুলে আনার কোনও উদ্যোগ নেই। উল্টে কোনও তরুণ নেতা যদিও বা উঠে আসেন, তিনি কেন অমুক কোম্পানির ঘড়ি বা শার্ট ব্যবহার করে "সাম্রাজ্যবাদী" শক্তিদের আস্কারা দিলেন, তাই নিয়েই বৃদ্ধতন্ত্রের চমকানি শুরু হয়ে যায়। একবিংশ শতাব্দীতে টাইম মেশিনে চড়া নেতা বামেরা কোত্থেকে জোগাড় করবেন তা ভগবানও না জানন্তি।
কিন্তু এবারে দলের মধ্যেই শুরু হয়েছে বৃদ্ধতন্ত্র উৎখাতের আন্দোলন। লোকসভা নির্বাচনের বেনজির ভরাডুবির পরে সিপিএম-এর রাজ্য কমিটির প্রথম বৈঠকেই রাজ্যের শীর্ষ নেতৃত্বের সমালোচনায় মুখর হল একাধিক জেলা নেতৃত্ব। দলের বিভিন্ন ফ্রন্টের -- যেমন কৃষক ও শ্রমিক -- নেতারা নাম না করেই বোঝাতে চাইলেন যে বিমান আর উড়বেন না, সূর্য্যও আর অন্ধকার তাড়াতে পারবেন না। সবাই একযোগে চান নতুন মুখ।
"আপনারা অন্তত এ বার বুঝুন, আপনাদের কেউ পছন্দ করছে না। আপনাদের দেখলে পার্টি সম্পর্কে মানুষের মধ্যে বিরক্তি বাড়ছে," সোজা কথা প্রতিফলিত হয়েছে বৈঠকে।
দলের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বেগতিক দেখে সাংবাদিক সম্মেলনে বলেই ফেলেন যে এবার তারুণ্যের উপরে জোর দিতে হবে।
কিন্তু তারুণ্যের উপরে জোর দেওয়ার জন্যে জোর দিয়ে কতটা কী হবে, সেকথাও আশা করি ভেবে দেখছেন বাম নেতৃত্ব।
ইউরোপের বাম দলগুলির মতো সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট হয়ে উঠতে পারলেন না ভারতের বামেরা
মিশ্রবাবু যদিও বিপর্যয়ের দায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন কিন্তু সমস্যাটা কোনও ব্যক্তিবিশেষের নয়। নেতৃত্ব উঠে আসুক বললেই সিপিএম-এর নয়া নেতৃত্ব উঠে আসে না। বামেরা একটি আগাপাশতলা মতাদর্শ-ভিত্তিক দল। একধরনের প্রাচীনপন্থাই তাদের পাথেয়। কিন্তু সেই প্রাচীনপন্থাটিই এখন আর মানুষে খায় না আর তাই তারুণ্যে জোর দেওয়ার আগে বামেদের বিদায়ী নেতৃত্বের প্রয়োজন দলের রাজনীতির খোলনলচে বদলানোর।
ইউরোপের বিভিন্ন বামপন্থী দল পরিবর্তিত যুগে নিজেদের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট রূপে প্রতিষ্ঠিত করে পিঠ বাঁচিয়েছে। ভারতের বামেরা আসলে সেইরকম সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট হলেও মুখে তাঁরা ভাব দেখান যেন কমিউনিজম-এর আদি ধারা থেকেই তাঁরা উঠে এসেছেন। নতুন রক্ত আমদানি করলেই এদেশের বামফ্রন্টের সমস্যা আসন হবে, সেই গ্যারান্টি দেওয়া মুশকিল। কিন্তু বৃদ্ধতন্ত্র নির্বাচন জেতার মরীচিকার পিছনে না দৌড়ে যদি চেষ্টা করতেন দলের রাজনৈতিক অভিমুখকে আরও যুগোপযোগী করার, তাহলে তরুণরা নিজেরাই আগ্রহ দেখাত।
আজকের বামেদের বৃদ্ধ শুদ্ধবাদীরা যদি মনে করেন সেই ষাটের বা সত্তর দশকের মতো সদস্য উঠে আসবেন তরুণদের মধ্যে থেকে, তাহলে তাঁরা ধানের খেতে বেগুন খুঁজেই মরবেন। এখনকার তরুণরা তখনই বামেদের শিবিরে নাম লেখাবে যখন তাঁরা নিজেদের মার্কেটিং করতে পারবেন, সময়ের সঙ্গে মানানসই ঝকঝকে আদর্শের বাস্তবায়ন করতে জানবেন।
ইতিমধ্যেই অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। সদস্যদের মতো দলটিও তাই প্রায় চলে গিয়েছে আইসিসিইউতে। এর থেকে মুক্তির উপায়ে কী? মার্ক্স্ও বোধহয় খাবি খেতেন জিজ্ঞেস করলে।
[আরও পড়ুন: বিমান-সূর্যদের কেউ চাইছে না, 'মানে মানে কেটে পড়ুন', সরব জেলার সিপিএম নেতা-কর্মীরা ]