কত হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে রোজভ্যালির বিরুদ্ধে, হিসেবটা চমকে দেবে
রোজভ্যালির আত্মসাতের পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি। অন্তত এমনটাই বলছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী বিভিন্ন সংস্থা। টাকা আদায়ের দাবিতে কখনও ধর্না, কখনও বিক্ষোভ চলছে বিভিন্ন জায়গায়
১৯৯৭ সালে রোজভ্যালির প্রতিষ্ঠা করেন কাজল কুণ্ডু। এর আগে বছর দশেক ধরে রাষ্ট্রয়ত্ত সংস্থার বিমা বিক্রি করতেন তিনি। তা মূলত ত্রিপুরাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। এরপরেই এলআইসির কর্পোরেট এজেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন কাজল কুণ্ডু।
১৯৯৭ সালে রোজ রিসর্টস অ্যান্ড প্ল্যান্টেশনস নাম দিয়ে কালেকটিভ ইনভেস্টমেন্ট স্কিমে নামেন কাজল কুণ্ডু। কমবেশি দুবছর পর সেবির কাছে লাইসেন্সের জন্য় আবেদন জানান কাজল কুণ্ডু। কিন্তু সেই আবেদন গ্রাহ্য হয়নি। তবুও ব্যবসা চলছে থাকে বাংলা, ত্রিপুরা অসমে। ২০০৩ সাল থেকে কম্পানি ফুলে ফেঁপে ওঠে। ঠিক ওই বছরেরই আগরতলা থেকে গুয়াহাটি যাওয়ার পথে এক রহস্যময় গাড়ি দুর্ঘটনায় ছেলে-বউসহ প্রাণ হারান কাজল কুণ্ডু। কম্পানির দায়িত্ব ভার যায় ভাই গৌতম কুণ্ডুর হাতে। সঙ্গে ছিলেন নামী সংস্থার হয়ে চিটফান্ড ব্যবসায় হাত পাকানো শিবময় দত্ত।
[আরও পড়ুন: টাকা ফেরতের দাবিতে রোজভ্যালির হোটেলে ধুন্ধুমার]
দায়িত্ব হাতে নিয়েই গৌতম কুণ্ডু আশীর্বাদ নামে এপর একটি স্কিম চালু করেন। এই বাংলার বিভিন্ন কোণে কোণে ছাড়াও পার্শ্ববর্তী রাজ্য ওড়িশা, বিহার এবং উত্তর-পূর্বের বাকি রাজ্যগুলি এমনকি উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাবকেও টার্গেট করেন গৌতম।
ঠিক কত কোটি টাকা বিভিন্ন রাজ্যের বাজার থেকে রোজভ্যালি সংগ্রহ করেছিল, তার সঠিক কোন সংখ্য়া জানা না গেলেও, কোনও কোনও মাধ্য়ম থেকে দাবি করা হয়, ২০০৩ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে রোজভ্যালি ৪০ হাজার কোটি টাকা তুলেছিল। কেউ বলেন ৬০ হাজার কোটি, আবার কেউ বলেন ১৬ হাজার কোটি। বাজার থেকে টাকা তোলার সঠিক পরিমাণ জানা না যাওয়ায়, ঠিক কত কোটি টাকা তছরুপ করেছে এই গোষ্ঠী তারও সঠিক পরিমাণ জানা যায়নি। যদিও, কেন্দ্রীয় অর্থ প্রতিমন্ত্রী জয়ন্ত সিংহ গত বছর সংসদে জানান, রোজভ্যালি বাজার থেকে ১০ হাজার ২৮০ কোটি টাকা তুলেছিল। যদিও, স্মল ডিপোজিটর অ্যাসোসিয়েশনের দাবি, রোজভ্যালি কম করেও ৪০ হাজার কোটি টাকা বাজার থেকে সংগ্রহ করেছিল।
সেবির দেওয়া হিসেব অনুযায়ী, ২০০৬-২০০৭ থেকে রোজভ্যালির বাড়বাড়ন্ত। সেবির হিসেব অনুযায়ী রোজভ্যালি ২০০৫-২০০৬ সালে যেখানে ৩.৭৫ কোটি টাকা তুলেছিল, সেখানে ২০০৯-১০-এ গিয়ে তা দাঁড়ায় ১২৭১.৯৮ কোটিতে।
রোজভ্যালিতে টাকা রাখায় রাজ্যের স্বল্প সঞ্চয়ে টান পড়ে। টনক নড়ে রাজ্যের তৎকালীন বাম সরকারের। ২০০৯-এর ডিসেম্বরে সেবির কাছে তদন্ত দাবি করে চিঠি লেখে রাজ্য সরকার।
রাজ্যে তৃণমূলের ক্ষমতায় আসার বছরে রোজভ্যালি বাজার থেকে তুলেছিল আনুমানিক ২০১৬. ৩২ কোটি টাকা।
ওই বছরেই সেবি রোজভ্যালির রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেডকে টাকা তুলতে বারণ করে। ২০১৩-তে সংস্থার হোটেল অ্যান্ড এন্টারটেইনমেন্ট লিমিটেডকে টাকা তুলতে বারণ করে।
রোজভ্যালিকে নিয়ে প্রথম বিতর্ক শুরু হয় রোজভ্যালি হোটেলস অ্যান্ড এন্টারটেনমেন্ট-এর অধীন চালু হওয়া 'হলিডে মেম্বারশিপ'কে ঘিরে। কিস্তির মাধ্যমে টাকা দেওয়া শেষ হলে কোনও গ্রাহক প্যাকেজ ট্যুর নিতে পারেন অথবা প্রদেয় অর্থের থেকে বেশি অর্থ রোজভ্যালি থেকে ফেরত পেতে পারেন। এমনই অফার দিয়েছিল রোজভ্যালি। বেশি লাভের আশায় বহু মানুষ এই প্যাকেজ বুক করেছিলেন। কিন্তু, সমস্যা দেখা দেয় যখন কিস্তি পূরণ করা গ্রাহককে রোজভ্যালি আরও বেশি অর্থের লোভ দেখিয়ে অপর একটি স্কিমে ফেলে দেওয়ায়। বহু মানুষ এক্ষেত্রে টাকা ফেরত পাননি বলে অভিযোগ ওঠে। সেবিও এই স্কিম নিয়ে আপত্তি জানায়। এটা একধরনের বেআইনি স্কিম বলে জানিয়ে দেয় সেবি।
২০১৩ সালে সেবি দেখে, হলিডে মেম্বারশিপ-এর নামে রোজভ্যালি ১১.৯৬ % থেকে শুরু করে ১৭.৬৫% সুদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। এবং ২১.৯ লক্ষ মানুষ এই প্রকল্পে টাকা রেখেছিলেন।
এরই মধ্যে তদন্তের জেরে আইআরডিএ-র চিঠিতে কর্পোরেট এজেন্টের লাইসেন্স খোয়ায় রোজভ্যালি।
সারদাকাণ্ড সামনে চলে আসতেই অভিযোগ ওঠে রোজভ্যালির বিরুদ্ধেও। রোজভ্যালি বিরুদ্ধে তদন্তে নামে সিআইএফও অর্থাৎ 'সিরিয়াস ইনভেস্টমেন্ট ফ্রড অফিস'। তাঁদের তৈরি করা রিপোর্টে রোজভ্যালির বিরুদ্ধে একাধিক কেলেঙ্কারি সামনে আসে। এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারকে অভিযোগ জানিয়ে লেখা রাজ্যের বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার চিঠিতে রোজভ্যালিকে অভিযুক্ত করা হয়। রাজ্যে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা অন্য চিটফান্ড সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি ওঠে।
এসআইএফও-র তৈরি করা রিপোর্টের ভিত্তিতে তদন্তে নামে ইডি। অবশেষে প্রায় ১ বছর ধরে তদন্তের পর ২০১৫ সালের মার্চে গ্রেফতার করা হয় রোজভ্যালি কর্ণধার গৌতম কুণ্ডুকে। এর কয়েক মাসের ব্যবধানেই গ্রেফতার করা হয় সংস্থার এমডি শিবময় দত্ত এবং রোজভ্যালির কালেক্টরস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের নেতা অমিত বন্দ্যোপাধ্যায়কে। এই মুহুর্তে জামিনে মুক্ত রয়েছেন অমিত বন্দ্যোপাধ্যায়।
বেশির ভাগ ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলেও, রোজভ্য়ালির তরফে তাদের হোটেল এবং খবরের চ্য়ানেলের ব্যবসা চালু রয়েছে।
রোজভ্যালির কেলেঙ্কারির জেরে রাজ্যে ইতিমধ্যেই বহু এজেন্ট আত্মহত্যা করেছেন কিংবা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আর মাঝে মধ্যেই কলকাতা কিংবা জেলাগুলিতে ধর্না দিচ্ছেন এজেন্ট কিংবা আমানতকারীরা। রোজভ্যালির তরফে ইতিমধ্য়েই বিভিন্ন ব্যবসায় কম্পানির নাম বদলের অভিযোগ উঠেছে। সংস্থার তরফে বাজারে বকেয়ার পরিমাণ কখনও দুশো কোটি কিংবা তার থেকে একটু বেশি বলা হলেও, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে খবর, এই বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা।