বাঙালির রূপান্তর- বাম ঘরানা থেকে ফের জাতীয়তাবাদী
সিএনএন-আইবিএনের সাম্প্রতিক নির্বাচনী সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস ২০০৯ সালের চেয়েও ভালো ফল করতে পারে এবং লোকসভা নির্বাচনে ২০-২৮টি আসন পেতে পারে। আর বামফ্রন্ট পেতে পারে ৭-১৩টি আসন। ওই সমীক্ষায় আরও বলা হয়েছে, তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোটের হার ৩৩ শতাংশের আশপাশে থাকতে পারে। বামফ্রন্টের প্রাপ্ত ভোটের হার কমে দাঁড়াতে পারে ২৫ শতাংশে, যেখানে কংগ্রেস ১৯ শতাংশ ভোট পেতে পারে। আশ্চর্যজনকভাবে বিজেপি-র প্রাপ্ত ভোটের হার ৬ শতাংশ থেকে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে ১৪ শতাংশের আশপাশে পৌঁছতে পারে।
২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের পালে যে হাওয়া লেগেছিল, তা এই সময় না থাকলেও তারা সবচেয়ে বেশি আসন পাবে। গত আড়াই বছরে পশ্চিমবঙ্গে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যেগুলি শাসক দল সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে পারেনি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব খারাপ। ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে অনেক। এই ঘটনাগুলি জাতীয় স্তরে উঠে এসেছে। শুধু ধর্ষণের দুভার্গ্যজনক ঘটনাগুলি ঘটেছে তা-ই নয়, তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের ঔদাসীন্য, মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, ভেঙে পড়া পুলিশি ব্যবস্থার পক্ষে এহেন ঘটনা ঠেকাতে ব্যর্থতা, সব মিলিয়ে 'আনন্দনগরী' এখন বিপর্যস্ত।
পার্ক স্ট্রিটে ধর্ষণের ঘটনার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, এটা 'সাজানো ঘটনা'। তাঁর সরকারকে হেয় করার চেষ্টা। পরে কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার দময়ন্তী সেন যখন এই ঘটনার সফল তদন্ত করলেন, তখন সম্ভবত শাস্তি হিসাবে তাঁকে বদলি করে দেওয়া হল। পরে উত্তর ২৪ পরগনার বারাসতে পরপর ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা ঘটায় বোঝা গেল, বাগাড়ম্বর সত্ত্বেও পরিস্থিতির খুব একটা বদল হয়নি।
কবীর সুমনের মতো অনেকে, যাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একদা কট্টর সমর্থক বলে পরিচিত ছিলেন, তাঁরা ভাবতেই পারছেন না এ সব। বিরোধী শিবিরে থাকার সময় মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায় সব সময় 'নিপীড়িত' মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। সেই তিনিই এখন উদাসীন ও অনড় হয়ে উঠেছেন। সব কিছুর জন্য বিরোধীদের দায়ী করছেন এবং বাস্তব থেকে চোখ সরিয়ে রেখেছেন। যে কলকাতা তথা বাংলা নারীবাদ ও নারী স্বাধীনতা নিয়ে গর্ব করেছে, সেখানেই এখন মেয়েদের নিরাপত্তা চিন্তা ও আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আইনশৃঙ্খলার ক্রমশ অবনতি যদি একটা বিষয় হয়, তা হলে শিল্পে স্থবিরতা ও বড় বিনিয়োগকারীদের টেনে আনার ব্যাপারে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের অক্ষমতা আর একটা বিষয়। বাংলা থেকে ফি বছর প্রচুর গ্র্যাজুয়েট বেরোয়। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এরা অন্যত্র চাকরিবাকরি খুঁজে নিচ্ছে। আশা ছিল, ক্ষমতায় বদল হলে শিল্পায়ন হবে। কিন্তু, পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের ঘটনায় তৃণমূল কংগ্রেসের অবস্থান, পাশাপাশি শ্রমিক ইউনিয়নগুলির হরতাল, কারখানার পরিচালক-তত্ত্বাবধায়কদের ওপর ট্রেড ইউনিয়নের হামলা, জমি ইস্যুতে অবরোধ ইত্যাদি কারণে বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
পাশাপাশি, চিটফান্ড কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। 'বিজনেস টুডে'-র প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারদা গোষ্ঠী ১৪ লক্ষ আমানতকারীর সঙ্গে ৪০০০ কোটি টাকা প্রতারণা করেছে। এর সঙ্গে কয়েকজন তৃণমূল কংগ্রেস নেতা জড়িত থাকায় শাসক দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে।
এছাড়া ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির স্বার্থে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের ব্যাপারে নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়া হয়েছে। রয়েছে সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির অভাব। ফলে বাংলায় নেতিবাচক মনোভাব বেড়েছে।
এত কিছুর জেরে হঠাৎ শাসক দলের বিপক্ষে ভোট পড়বে, এমনটা নাও হতে পারে। কারণ বাংলায় যোগ্য বিকল্পের অভাব রয়েছে। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএম নেতৃত্বাধীন ভূতপূর্ব বামফ্রন্টের যে মহাপতন হয়েছিল, সেই ধাক্কা এখনও তারা সামলে উঠতে পারেনি। তাদের যোগ্য নেতৃত্বের অভাব রয়েছে। শাসক দলের ব্যর্থতাকে তারা পুঁজি করতে পারেনি। স্বাভাবিকভাবে এবার তাদের ভোটের প্রাপ্ত হার ২৫ শতাংশ বা তার নীচে নেমে যেতে পারে।
এর ফলে বিজেপি-র মতো দল কিন্তু লাভবান হচ্ছে। পরবর্তী নির্বাচনগুলিতে তারা তাদের ভোটের হার বাড়িয়ে নেবে বলে আশা। দলের প্রাথমিক সদস্য বেড়ে গিয়েছে কয়েক গুণ। পাশাপাশি, 'নরেন্দ্র মোদী সেনা'-র মতো কতগুলি সমান্তরাল সংগঠনের জন্ম হয়েছে। এরা লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি-র পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য মানুষকে বোঝাচ্ছে। নরেন্দ্র মোদীর সপক্ষে বাংলা থেকে সোশ্যাল মিডিয়া গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে ও তাদের সদস্য সংখ্যাও ভালো, এটা কয়েক বছর আগেও ছিল চিন্তার অতীত।
আনুষ্ঠানিকভাবে এ ধরনের গোষ্ঠীর সঙ্গে বিজেপি-র কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু, এদের উত্থান, ময়দানে নেমে প্রচারে সক্রিয়তা অন্তত বাংলার পরিপ্রেক্ষিতে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। যেখানে বিজেপি-র সাংগঠনিক ক্ষমতা তত বেশি নয়, সেখানে এমন ঘটনায় প্রতিফলিত হচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তা। নরেন্দ্র মোদী সেনার ১২ হাজার অনলাইন সদস্য রয়েছে। অধিকাংশই পেশাদার লোকজন ও কলেজ পড়ুয়া।
নরেন্দ্র মোদীর সপক্ষে ময়দানে নেমে প্রচারের জন্য দোহা নিবাসী পবিত্র দে কলকাতা ফেরার পরিকল্পনা করছেন লোকসভা ভোটের ১০ দিন আগে। সত্যপ্রকাশ যাদব, তন্ময় বসাক, দেব সাহা এই নামগুলি রাজনীতিক খবরের বিচারে গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু, এঁরা প্রত্যেকে নরেন্দ্র মোদীর সপক্ষে প্রচার চালানোর জন্য নিজেদের কাজের ফাঁকে সময় বের করে নিয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়া মারফত এঁরা প্রচার চালাবেন। আবার ময়দানেও নামবেন। বামপন্থী মনোভাবাপন্ন বাংলার বাঙালি তরুণরা বিজেপি-র প্রচারে সময় দিচ্ছেন, এটা অবাক করার মতো।
ভারতের রাজনীতিক পটে আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটছে, দেশের মানুষ ক্ষমতায় বদলের সঙ্গে সঙ্গে শক্তপোক্ত সরকার চাইছে, সব ঠিক। পাশাপাশি, বাংলায় একদম তৃণমূল স্তরে ঘটে চলেছে পরিবর্তন, ধীরভাবে অথচ চুপিসাড়ে। এবার লোকসভা ভোটে হয়তো তৃণমূল সিংহভাগ আসনে জিতবে, কিন্তু পরবর্তী পাঁচ বছরে অবস্থাটা বদলে যেতে পারে।
লোকসভা ভোটের যখন আর তিন মাস বাকি আর সব দলই কোমর কষছে, তখন সুমন্ত্র মাইতির মতো প্রবাসী বাঙালিরা দেশে ফেরার পরিকল্পনা করছেন। তাঁর পছন্দ স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, "নরেন্দ্র মোদীর মতো দৃঢ়চেতা নেতাকে আমি শীর্ষে দেখতে চাই। ওঁর নেতৃত্বে ভারত নতুন দিশার দিকে এগিয়ে যাবে। আমি সব উজাড় করে ওঁকে সহায়তা করতে চাই।" নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বাংলা এখন পুনরুজ্জীবিত জাতীয়তাবাদকে প্রত্যক্ষ করছে এবং তৃণমূল স্তরে ক্রমশ সরে আসছে বাম রাজনীতির ঘরানা থেকে। আর এই বিষয়টি এখন অবহেলা করা সম্ভব নয়।