'জয় শ্রীরাম' ও বাংলা সংস্কৃতি : বিজেপির এখন উল্লাসের দিন; অমর্ত্য সেনের কথা তারা শুনবেন কোন দুঃখে?
তথাগত রায় বাংলাকে খুব ভালোবাসেন আর এতটাই ভালোবাসেন যে বাংলা সম্পর্কে তাঁর মনের মতো কথা কেউ না বললে তাঁকে তিনি নিমেষে দংশন করতে উদ্যত হন।
তথাগত রায় বাংলাকে খুব ভালোবাসেন, আর এতটাই ভালোবাসেন যে বাংলা সম্পর্কে তাঁর মনের মতো কথা কেউ না বললে তাঁকে তিনি নিমেষে দংশন করতে উদ্যত হন। বর্তমানে মেঘালয়ের গভর্নর তথাগত সম্প্রতি বিঁধলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনকে। অমর্ত্যর দোষ? তিনি মনে করেন 'জয় শ্রীরাম' স্লোগান বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খায় না।
ঠোঁটকাটা নেতা হিসেবে পরিচিত তথাগতের মতে, পশ্চিমবঙ্গে রামরাজাতলা বা শ্রীরামপুরের মতো জায়গা রয়েছে। সেখানে রাম বাঙালি সংস্কৃতিতে একেবারে বেমানান, তা বলা যায় কীভাবে? তিনি এও বলেন যে ভূতের ভয় পেলেও তো আমরা রামের নাম স্মরণ করি। অতএব, রাম এই রাজ্যের সংস্কৃতিতে নতুন কিছু নয়। তথাগতের মতে, অমর্ত্য যেহেতু অর্থনীতি নিয়ে চর্চা করেছেন, তাই তাঁকে রাজনীতি নিয়ে কিছু বলার কোনও প্রয়োজন নেই।
অমর্ত্য সেনের যুক্তিকে কিন্তু খণ্ডাতে পারছেন না তাঁর সমালোচকরা
অথচ অমর্ত্য সেন কিন্তু রামের নামের বিরোধিতা করেননি, করেছেন সেই নামের মন্ত্রের ধুয়ো তুলে মানুষকে মারধরের সংস্কৃতিকে। তিনি বলেন "জয় শ্রীরাম" মন্ত্র জপে মানুষকে আক্রমণের সংস্কৃতি বাংলায় নতুন। তিনি বলেন কলকাতায় তিনি আজকাল রাম নবমী উদযাপিত হতেও দেখছেন যা আগে ছিল না। তিনি বলেন তাঁর চার বছরের নাতনিকে তার প্রিয় দেবতার নাম জিজ্ঞেস করলে সে মা দুর্গার কথা বলে। "মা দুর্গা আমাদের জীবনে চিরকালীন। আর 'জয় শ্রীরাম' হচ্ছে মানুষকে মারধরের ছুতো," অমর্ত্য বলেন।
অমর্ত্যের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার আশ্চর্যের নয়
কয়েকদিন আগে উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলায় একজন লোককে 'জয় শ্রীরাম' স্লোগান না দেওয়ার কারণে মারধর করার প্রসঙ্গেই পঁচাশি বছরের অমর্ত্যের এই বক্তব্য। আর যেমনটি আগেও দেখা গিয়েছিল, তাঁকে তাঁর মন্তব্যের জন্যে একহাত নিলেন এক বিজেপি নেতা।
অমর্ত্য সেনের প্রতি বিজেপির নানা স্তরের নেতাদের বিষোদ্গার নতুন কিছু নয়। এবং এই বিরোধিতার মধ্যে আশ্চর্য হওয়ারও কিছু নেই। অমর্ত্য সেনের মতো বিদ্বান-বিচক্ষণ লোকের মতামতের একটি গুরুত্ব রয়েছে। 'জয় শ্রীরাম' নিয়ে তাঁর মতামত মোটেই রাজনৈতিক নয়।তার মধ্যে একটি সামাজিক চেতাবনির ছোঁয়াও রয়েছে। যে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের ভূত ধীরে ধীরে আমাদের গিলে খাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে অমর্ত্যর এই অবস্থান যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু বিজেপির নেতাদের এখন পৈশাচিক উল্লাসের সময়। তাঁরা অমর্ত্যর অন্তর্দৃষ্টির কথা এখন ভাবতে যাবেন কোন দুঃখে?
তথাগত রায়ের "রামরাজতলাতে" 'রাম' আছে বা ভূতের ভয় পেলেও আমরা রামনাম জপ করি, অতএব পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিতে রামের গুরুত্ব আছে জাতীয় যুক্তি ধোপে টেকে না। মেঘালয়ের রাজ্যপাল ভালো করেই জানেন অমর্ত্য সেন কী বলতে চাইছেন তবু অমর্ত্যেরই লেখা 'তর্কবাগীশ ভারতীয়'র মতো তাঁর মতামতকে গায়ের জোরে নস্যাৎ করার অভিসন্ধি চোখ এড়ায় না। তথাগত কি 'জয় শ্রীরাম' বলে লোক পেটানোকে সমর্থন করেন?
আগে তিনি সেটা পরিষ্কার করুন।
ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং-এর দুশমন অনেক
আসলে ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং-এর গুণ ক্ষমতান্ধরা কোনওদিনই সহ্য করতে পারে না। তা সে বামপন্থীই হোক বা দক্ষিণ। অমর্ত্যকে পশ্চিমবঙ্গের পূর্বতন বামেরাও নানা বিষয়ে কম কটাক্ষ করেনি; আর এখন দক্ষিনপন্থীদের রামরাজ্য তিনি তাঁদের নিশানায় পড়েছেন। কিন্তু রাজনীতির ভাষা যায় বলুক না কেন, অমর্ত্যর মতো মানুষরা যতদিন সমাজকে বিপদের ঘন্টা বাজিয়ে সাবধান করতে থাকবেন, বুঝতে হবে এদেশের গণতন্ত্র তদ্দিন বেঁচে রয়েছে। যেদিন এই ব্যবস্থাটিও উঠে যাবে, সেদিন সব আশা শেষ।