কাঁথিতে অধিকারী-দাপটে মন্ত্রীর আসন দখল বিজেপির, পিছিয়ে তৃণমূলের হেভিওয়েটরা
কাঁথিতে অধিকারী-দাপটে মন্ত্রীর আসন দখল বিজেপির, পিছিয়ে তৃণমূলের হেভিওয়েটরা
কাঁথির শান্তিকুঞ্জ। শুভেন্দু অধিকারীর বাসভবন। পূর্ব মেদিনীপুরের অধিকারী-গড়ে থাবা বসাতে চেয়েও তৃণমূল কংগ্রেস যে লাভবান হয়নি তা পরিষ্কার ভোটের ফলেই। এমনকী সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ঝাঁপিয়েও কাঁথি দক্ষিণ আসন ধরে রাখতে পারেনি তৃণমূল কংগ্রেস। উল্টে, নিজেদের ওয়ার্ডে পিছিয়ে পড়েছেন জেলায় তৃণমূলের হেভিওয়েটরাই। কাঁথি তথা মেদিনীপুর যে অধিকারীদের পাশেই রয়েছে এই ঘটনা সেটাই প্রমাণ করে।
সবুজ ঝড়ের পরও অস্বস্তিতে মমতা, নন্দীগ্রাম-সহ পূর্ব মেদিনীপুরে দলের ভোটব্যাঙ্কে বড় ধস
নজরে কাঁথি দক্ষিণ
১৯৮২ সালে কাঁথি দক্ষিণ থেকে প্রথমবার কংগ্রেস বিধায়ক হন শিশির অধিকারী। ২০০১ সালে তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক নির্বাচিত হন এই আসন থেকেই। ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কাঁথি দক্ষিণ থেকেই জয়লাভ করেছিলেন শুভেন্দু অধিকারী, ৫০.৬০ শতাংশ ভোট পেয়ে। ২০০৯ সালে শুভেন্দু অধিকারী সাংসদ হওয়ায় তাঁর ভাই দিব্যেন্দু অধিকারী কাঁথি দক্ষিণ আসন থেকে উপনির্বাচনে জয়ী হন। ২০১১ সালে দিব্যেন্দুই ৫৭.১২ শতাংশ ভোট পেয়ে ফের বিধায়ক হন। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে দিব্যেন্দু ৫৩.৭২ শতাংশ ভোট পেয়ে ফের বিধায়ক হন। সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী বিধানসভা ভোটে জিতে মন্ত্রী হলে তাঁর ছেড়ে আসা তমলুক লোকসভার উপনির্বাচনে জয়লাভ করেন দিব্যেন্দু অধিকারী। দিব্যেন্দুর কাঁথি দক্ষিণ আসন থেকে জিতিয়ে এনে মন্ত্রী করা হয় চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যকে। চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য কিন্তু ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলেন। ৫৫.৮৯ ভোট পেয়ে চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের জয়ের পিছনে অবদান ছিল অধিকারী পরিবারেরই। মন্ত্রী চন্দ্রিমার সেই আসনই এবার হাতছাড়া হয়েছে তৃণমূলের!
শিশির অধিকারী ফ্যাক্টর
লোকসভা নির্বাচনে কাঁথির তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ শিশির অধিকারী কাঁথি দক্ষিণ বিধানসভা ক্ষেত্র থেকে লিড পেয়েছিলেন ১৯,০১৫ ভোটের। এবার বিধানসভা নির্বাচনের আগে কাঁথিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জনসভায় উপস্থিত ছিলেন শিশিরবাবু। তাতেই গেরুয়া ঝড় ওঠে কাঁথিতে। কাঁথি দক্ষিণে লোকসভা ভোটের তুলনায় তৃণমূলের ভোটও কমেছে এবারের বিধানসভা ভোটে। লোকসভা ভোটে কাঁথি দক্ষিণ বিধানসভা ক্ষেত্রে তৃণমূল পেয়েছিল ৯৩,৭৯২টি ভোট। বিধানসভা নির্বাচনে তা কমে হয়েছে ৮৮,১৮৪। অন্যদিকে, মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যকে এখানে আর প্রার্থী করেনি তৃণমূল কংগ্রেস। দাঁড় করানো হয় পটাশপুরের দুবারের বিধায়ক জ্যোতির্ময় করকে। পটাশপুর আসনটি তৃণমূল ধরে রাখতে পারলেও জ্যোতির্ময় কর কাঁথি দক্ষিণে পরাজিত হন বিজেপি প্রার্থী অরূপকুমার দাসের কাছে। এই প্রথম ১০,২৯৩ ভোটে জিতে কাঁথি দক্ষিণে ফুটল পদ্মফুল। বিজেপির প্রাপ্ত ভোট লোকসভা ভোটে ছিল ৭৪,৭৭৭। তা বেড়ে হয়েছে ৯৮,৪৭৭। মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের বিধায়ক হিসেবে নিষ্ক্রিয়তা ও অধিকারী পরিবারের প্রতি আস্থাই বিজেপির এই জয়ের নেপথ্যে বলে মত রাজনৈতিক মহলের। সেই অধিকারী পরিবারকেই অকথ্য ভাষায় আক্রমণের জবাব মানুষ দিয়েছেন ভোটবাক্সেই।
গড় অটুট
শুভেন্দু অধিকারী এবার থেকে নন্দীগ্রামের ভোটার। তবে অধিকারী পরিবারের বাকিরা ভোট দেন ১৫ নং ওয়ার্ডের একটি বুথে। করোনা পরিস্থিতিতে বাড়ানো হয়েছিল বুথের সংখ্যা। কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে কটাক্ষ করা হয় অধিকারীরা নিজেদের বুথেই হেরেছেন বলে! অথচ বাকি অনেক তথ্য চেপে যাওয়া হয়েছে! ২১ ওয়ার্ডের কাঁথি পুরসভায় বিজেপির হাতে একটি ওয়ার্ডও ছিল না। পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান তথা প্রশাসক সৌমেন্দু অধিকারী বিজেপিতে যোগ দিয়ে বিজেপি প্রার্থীর এজেন্ট হিসেবে সংগঠন জোরালো করার কাজ করেছেন। তার ফলেই ১৫টি ওয়ার্ডে এগিয়ে গিয়েছে বিজেপি। ১৫ নং ওয়ার্ডে ৮৩ নং বুথে তৃণমূল বিজেপির চেয়ে ২৬৫-২১১ ভোটে এগিয়ে থাকলেও ৮৩এ, ১১৪ ও ১১৪এ বুথে বিজেপি এগিয়ে যথাক্রমে ৩০৩-১৮০, ২৭৬-১৬৪ এবং ৩০২-১৪৬ ব্যবধানে। রাজনৈতিক মহলের ধারণা, একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের ভোটার বেশি থাকাতেই ৮৩ নং বুথে সামান্য এগিয়ে তৃণমূল। তবে সবমিলিয়ে শান্তিকুঞ্জ যে ওয়ার্ডে সেই ১৫ নং ওয়ার্ডে বিজেপির লিড ৩৩৭ ভোটের।
ওয়ার্ডে পিছিয়ে তৃণমূলের হেভিওয়েটরা
কাঁথি দক্ষিণে এবারের তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী জ্যোতির্ময় কর থাকেন ৬ নং ওয়ার্ডে। সেই ওয়ার্ডের সবকটি বুথেই বিজেপির লিড। এই ওয়ার্ডে বিজেপি এগিয়ে ৬৩৬ ভোটে। রামনগরের বিধায়ক তথা জেলা তৃণমূল কার্যকরী সভাপতি অখিল গিরি থাকেন কাঁথির ১৬ নং ওয়ার্ডে। সেই ওয়ার্ডেও ২১২ ভোটে এগিয়ে বিজেপি। ১১৭ নং বুথে ৫৭ ভোটে তৃণমূল এগিয়ে থাকলেও বাকি তিনটি বুথেই লিড বিজেপির। কাঁথি পুরসভার যে ছয়টি ওয়ার্ডে তৃণমূল এগিয়ে রয়েছে সেগুলি হলো ১, ৩, ৪, ৫, ১২ ও ১৪। এক নম্বর ওয়ার্ডে আবার তৃণমূল যেখানে পেয়েছে ২৭৪৫ ভোট, বিজেপি পেয়েছে ৫৭৬টি। তিনটি বুথে তৃণমূল এগিয়ে রয়েছে ৪৯২-১৩, ৪৫৪-৮ ও ৫০৪-৫ ব্যবধানে। চার নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূল যেখানে পেয়েছে ১৫১৯ ভোট সেখানে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট মাত্র ২২। পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডে ৫৬ ভোটে পিছিয়ে বিজেপি। তবে সামগ্রিকভাবে কাঁথি পুরসভা এলাকায় বিজেপি তৃণমূলের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে ৪৬২২ ভোটে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভা বা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রোড শো-ও জনমানসে প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ বলেই মত রাজনৈতিক মহলের। অধিকারী পরিবারকে গদ্দার, মীরজাফর ইত্যাদি কুকথা বলে নানা মাপের নেতাদের আক্রমণও ব্যুমেরাং হয়েছে।
কাঁথি লোকসভায় এগিয়ে বিজেপি
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে শিশির অধিকারী যখন সাংসদ হন তখন সাতটি বিধানসভা ক্ষেত্রেই এগিয়ে ছিল তৃণমূল। এবারের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী চণ্ডীপুর, পটাশপুর ও রামনগর তৃণমূল দখলে রাখতে পারলেও বিজেপি জিতে নিয়েছে কাঁথি উত্তর, কাঁথি দক্ষিণ, ভগবানপুর ও খেজুরি আসনটি। লোকসভা ভোটের তুলনায় তৃণমূলের মার্জিন কমেছে চণ্ডীপুর (১৫৪৬৩ থেকে কমে হয়েছে ১২৮৯৫) ও পটাশপুরে (১৪৩৫৫ থেকে কমে হয়েছে ৯৯৯৪)। রামনগরে একমাত্র তৃণমূল লোকসভা ভোটের তুলনায় মার্জিন বাড়িয়েছে। লোকসভা ভোটে তৃণমূল এই বিধানসভা ক্ষেত্রে এগিয়ে ছিল ৭৭৬৬ ভোটে, এবার তা বেড়ে হয়েছে ১২৫১৭। তাৎপর্যপূর্ণ যেটা সেটা হলো সব বিধানসভা আসনেই অনেকটা ভোট বেড়েছে বিজেপির। কাঁথি উত্তরে তৃণমূল কংগ্রেস যেখানে লোকসভা ভোটের সময় এগিয়ে ছিল ১৩০৭৪ ভোটে, সেখানে বিজেপি জিতেছে ৯৩৩০ ভোটে। ৩৭৩৯১ ভোটে পিছিয়ে থাকা ভগবানপুর বিজেপি ছিনিয়ে নিয়েছে ২৬৭০২ ভোটের ব্যবধানে জয় পেয়ে। খেজুরিতে তৃণমূলের লিড লোকসভা ভোটের সময় ছিল ৫৯১৩, এই আসনটিও বিজেপি জিতে নিয়েছে ১৭৯৬৫ ভোটে। কাঁথি দক্ষিণে শিশির অধিকারীর লিড ছিল ১৯০১৫ ভোটের। এই আসনে বিজেপি জিতেছে ১০২৯৩ ভোটের ব্যবধানে।