'আমি কোটিপতির মেয়ে নই': 'মাস লিডার' মমতাকে আজ এই কথা বলতে হচ্ছে কেন?
শুক্রবার, ১৪ জুন, উত্তর ২৪ পরগনার কাঁচরাপাড়ায় একই জনসভায় গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিছু তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করলেন।
শুক্রবার, ১৪ জুন, উত্তর ২৪ পরগনার কাঁচরাপাড়ায় একই জনসভায় গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিছু তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করলেন। এক তো বললেন যে, বাংলায় থাকতে হলে বাংলা ভাষা শিখতে হবে। দ্বিতীয় কথা যেটা বললেন তা হল যে, তিনি কোটিপতি ঘরের মেয়ে নন, আঁতেল নন, তাই তাঁকে অনেকে পছন্দ করে না। আবার বললেন, পাড়ার 'বখাটে' ছেলেদের নিয়ে তিনি এবারে তাঁর দলের ভবিষ্যতের পথ রচনা করবেন।
এই মন্তব্যগুলোর মধ্যে মমতার চলতি সময়ের একটি আন্দাজ করা যায়। ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক এবং দলগত -- তিনটি পর্যায়ে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী তাঁর বিশেষ বক্তব্যগুলি রাখছিলেন। এবং তাঁর প্রতিটি কথাতেই ফুটে বেরোচ্ছিল তাঁর বর্তমান সময়ের কোণঠাসা অবস্থাটি।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে মমতার ভাবমূর্তি বাঁচানোর মরিয়া লড়াই
প্রথমত ব্যক্তিগত। বৃহস্পতিবার কলকাতার একটি প্রথম সারির নিউজ চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও মমতা বলেন "আমি আঁতেল নই", "আপনারা আমাকে পছন্দ করেন না" কথাগুলি। তিনি কোটিপতি ঘরের মেয়ে নন বলে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা কম, এই ভাষণটির মধ্যে কোথাও একটি অভিমান লুকিয়ে রয়েছে। কিন্তু তাঁর গ্রহণযোগ্যতার কোনও মাপকাঠি সেটা হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও কোটিপতি ঘরের ছেলে নন এবং তিনিও অনেক সময়ে তাঁর ভাষণে তাঁর অতীত সামাজিক অবস্থার কথা বলে একটি সমবেদনা পাওয়ার চেষ্টা করলেও তাঁর গ্রহণযোগ্যতার পথে সেটি কোনও অন্তরায় হয়ে ওঠেনি। কিন্তু মমতার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে প্রশাসনিক ভূমিকায় তাঁর বিরুদ্ধে অসন্তোষ দিন দিন বাড়ছে এবং বিশেষ করে বর্তমানে চলতে থাকা চিকিৎসক সঙ্কটের ক্ষেত্রে তো তা আরও প্রস্ফুটিত হয়েছে। তখন তিনি "আমি কোটিপতি ঘরের মেয়ে নই" বা "আমি আঁতেল নই" ধরনের কথাগুলি বলে 'সিম্প্যাথি কার্ড' খেলছেন। লক্ষ্য, নিজের পুরোনো ভাবমূর্তিটি ফের ফিরে পাওয়া।
রাজনৈতিকভাবে, মমতা খেলছেন 'বাঙালিয়ানা' কার্ড
রাজনৈতিকভাবে তিনি খেলছেন বাঙালিয়ানা কার্ড। বাংলায় থাকতে হলে বাংলা শিখতে হবে, এমন নিদান মমতার কাছে অপ্রত্যাশিত নয় কারণ তিনি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই একটি বাঙালি খণ্ড-জাতীয়তাবাদী আবেগকে উৎসাহিত করেছেন; ভারতের অন্যান্য অনেক প্রদেশের নেতৃত্বের মতো। কিন্তু একদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গুণগ্রাহী হয়ে অন্যদিকে এমন 'এক্সক্লুসিভ' একটি অবস্থান নেওয়া মুখ্যমন্ত্রীর পরস্পরবিরোধী অবস্থানের পরিচয় দেয়। তৃণমূল নেত্রী হয়তো বিজেপির হিন্দি বলয়ের রাজনীতির পাল্টা একটি উগ্র ভাষা জাতীয়তাবাদের জিগির তৈরী করার চেষ্টা করছেন কিন্তু সেটা বাঙালি মননে রাতারাতি তৈরী হওয়া মুশকিল। মমতা যেমন বাংলার মাটিতে বিজেপির পদ্ম ফুটবে না বলে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন এবং তার ফল হাতেনাতে পেয়েছেন সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে, তেমনই বাংলাকে শুধু বাঙালির জন্যে করার অভিসন্ধিও বুমেরাং হয়ে ফিরতে দেরি লাগবে না। বিজেপির বিরুদ্ধে বাঙালি-অবাঙালি বিভাজনের অভিযোগ এনেও মমতা কিন্তু জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে নিজেও সেই একই বিভাজন করছেন বাঙালি খণ্ডজাতীয়তাবাদের দিকে বেশি ঝুঁকে। কয়েকদিন আগে পর্যন্ত যেই মমতাকে জাতীয় ক্ষেত্রে নিজেকে একটি বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে উদ্যোগী দেখাচ্ছিল, তিনিই এখন নিজের প্রদেশেই জমি পোক্ত করার জন্যে লড়ছেন।
দলের নবনির্মাণের সঙ্গে জুড়তে চাইছেন যুবশক্তিকে
এবং সবশেষে পাড়ার 'বখাটে' ছেলেদের দলে নিয়ে দলের নতুন সূচনা করার আবেদন। এই বিষয়টির মাধ্যমে মমতা নিজের দলের শুদ্ধিকরণের উদ্যোগকে তাঁর পপুলিস্ট আর্জির সঙ্গে একই সূত্রে বাঁধতে চাইছেন, রাজ্যের মানুষের হিতকে তাঁর দলের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে জনভিত্তি তৈরী করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু পাড়ার 'বখাটে' ছেলেদের দলে ঢুকিয়ে তিনি কি আদৌ শুদ্ধিকরণের পথে এগোতে পারবেন? নাকি কিছু একটা করে দেখানোর ঝুঁকি নেওয়াটাই তাঁর আস্ফালনের মূল উদ্দেশ্য?
নেত্রী কার্যত এখন তাঁর কোনঠাসা অবস্থা থেকে বেরোতে চাইছেন। চেষ্টার কসুরও করছেন না। সমবেদনা চাইছেন, বাঙালিয়ানাকে উৎসাহ দিচ্ছেন, পাড়ার ছেলেদের চাকরি না দিতে পারলেও (যদিও দল করলে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন) দলের সদস্যপদ দিয়ে সবাইকে খুশি রাখার চেষ্টা করছেন। সাফল্য এতে কতটা আসবে তা ভবিষ্যৎই বলবে।