সরকারেও আছি, বিরোধিতাতেও আছি; নেত্রী মমতার নৈহাটি অভিযান বোঝাচ্ছে তৃণমূলের সঙ্কট কতটা গভীর
বিরোধী রাজনীতি তাঁর মতো করতে পারেন ভারতে খুব কম রাজনীতিবিদই আছেন।
বিরোধী রাজনীতি তাঁর মতো করতে পারেন ভারতে এমন রাজনীতিবিদ খুব কমই আছেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি গদিতে আসীন আট বছরের উপরে কিন্তু এখনও তাঁকে দেখা যায় ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রতিবাদে, এমনকী সরকারে থেকেও!
বৃহস্পতিবার যখন দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবেন নরেন্দ্র মোদী নয়াদিল্লির এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে, তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো তখন যাবেন উত্তর ২৪ পরগনার নৈহাটিতে। সেখানে স্থানীয় পুরসভার সামনে তিনি ধর্নায় বসবেন; লক্ষ্য এবারের লোকসভা নির্বাচনের পরে যে শতাধিক তৃণমূল কংগ্রেস কর্মী ঘরছাড়া হয়েছেন, তাঁদের ঘরে সুরক্ষার সঙ্গে ঘরে ফিরিয়ে আনা। নৈহাটি যেই লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত, সেই ব্যারাকপুর এক দশক পরে তৃণমূলের হাতছাড়া হয়েছে; প্রাক্তন রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী প্রচন্ড গোলমালের মধ্যে ওই কেন্দ্র থেকে বিজেপির অর্জুন সিং-এর কাছে চোদ্দ হাজার ভোটে হারেন। অর্জুন নিজেও একসময়ে তৃণমূলেই ছিলেন, এবারে বিক্ষুদ্ধ নেতা হিসেবে বিজেপিতে যোগ দিয়ে হারান নিজেরই প্রাক্তন দলকে।
রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসক হয়েও তিনি ধর্নায় বসছেন; কী বার্তা দিচ্ছেন?
মমতার এহেন কর্মসূচি দেখে অবাক অনেক মহলই। কারণ তিনি নিজেই যেখানে রাজ্যের সর্বোচ্চ নেতা এবং পাশাপাশি পুলিশমন্ত্রীও, সেখানে অবস্থান বিক্ষোভে যোগ দিয়ে নিজেই আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরী করতে মদত দিচ্ছেন কিভাবে, প্রশ্ন উঠছে তাই নিয়ে। মমতা নিজে যদিও বলছেন তাঁর এই আন্দোলন সত্যাগ্রহ, কিন্তু বিরোধীরা তাঁকে কটাক্ষ করতে ছাড়ছে না।
কোন দিক সামলাবেন দিদি, বুঝেই উঠতে পারছেন না
তৃণমূল নেত্রী আসলে শিয়রের বিপদটি খুব ভালোই টের পাচ্ছেন। একে তো দলের মধ্যে ভাঙন ধরেছে, তার উপরে সমর্থকরা একপেশে মার খেতে শুরু করেছে। মুকুল রায়ের ঝোড়ো ব্যাটিং-এর ধাক্কায় তৃণমূলের এখন বিধ্বস্ত অবস্থা। অন্যদিকে, বিজেপি রাজ্যে তাঁদের ৫৪ জন হিংসায় মৃত সমর্থকদের পরিবারকে দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর শপথগ্রহণ সভায় আমন্ত্রণ জানিয়েছে। লক্ষ্য, মমতা সরকারকে আরও বড় লজ্জার মুখে ঠেলে দেওয়া। সেই কারণে তৃণমূল নেত্রী শেষ মুহূর্তে দিল্লি যাত্রা বাতিল করেন এবং ঝাঁপিয়ে পড়েন নিজের দলের লোকেদের ঘরে ফেরাতে। এমন ভূমিকায় মমতাকে অবতীর্ণ হতে মমতাকে বাম আমলে হামেশা দেখা যেত। তখন দলের কর্মী-সমর্থকদের বাম হার্মাদদের থেকে বাঁচাতে তিনি যত্রতত্র ছুটে যেতেন, পরোয়া করতেন না কোনও বিপদই। কিন্তু নিজে ক্ষমতায় থেকেও আজকে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের বাঁচাতে তাঁকে ধর্না দিতে হচ্ছে কেন? বিষয়টি একই সঙ্গে হাস্যকর এবং গুরুগম্ভীর।
[আরও পড়ুন: পশ্চিমবঙ্গের বিজেপিতে যেভাবে বেনোজল ঢুকছে, তাতে পদ্মও না ভেসে যায়]
দলের দ্বিতীয় সারির নেতৃত্ব, সংগঠন কোথায়?
আসলে মমতা বুঝেছেন যে এক-ব্যক্তির এই দলে দ্বিতীয় সারির নেতৃত্ব এতটাই অযোগ্য যে দলীয় সংগঠন ধরে রাখতে তাঁকেই মাঠে নামতে হচ্ছে। একই সঙ্গে প্রশাসক ও কোনঠাসা দলনেত্রী হওয়ার ফলে তাঁর ভূমিকায় এমন পরস্পরবিরোধিতা লক্ষ্য করছি আমরা যা কোনওমতেই গণতন্ত্রের পক্ষে ইতিবাচক ইঙ্গিত নয়। কয়েকদিন আগেও তাঁকে রাজ্যে কেন্দ্রের সিবিআই হানার বিরুদ্ধে পথে বসতে দেখা গিয়েছে প্রতিবাদী হয়ে। প্রতিবাদের রাজনীতি তাঁর কাছে সহজাত কিন্তু তাই বলে প্রশাসকের দায়িত্ব তিনি দূরে সরিয়ে রাখেন কিভাবে?
পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জিকেও এক সময়ে দেখা গিয়েছে নিজের সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নামতে। সেটিও বিরল বিষয় হলেও যুক্তফ্রন্টের সেই জুলিমিলি সরকারের মধ্যে দলীয় সংঘাত অপ্রত্যাশিত ছিল না। কিন্তু মমতার তো আজ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার সরকার; দলের তিনিই সর্বময় হোতা। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সাতদিন আগেও তাঁর অঙ্গুলিহেলনে পাতা নড়তো।
তো সেই মমতার আজ এই মরিয়া অবস্থা কেন?
উত্তরটা তিনিই জানেন সবচেয়ে ভালো।
[আরও পড়ুন:মোদীর শপথের দিন বাংলায় গড় বাঁচানোর হাইভোল্টেজ লড়াইয়ে মমতা]