মহুয়া মৈত্র অসাধারণ বলেছেন; কিন্তু নিজের ক্ষয়িষ্ণু দলকে তিনি কতটা আড়াল করতে পারবেন?
মঙ্গলবার লোকসভায় জীবনের প্রথম বক্তৃতাটি রাখেন তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ মহুয়া মৈত্র। তেতাল্লিশ বছরের এই নেত্রীর এর আগের পরিচয় তেমন কিছু ছিল না।
মঙ্গলবার লোকসভায় জীবনের প্রথম বক্তৃতাটি রাখেন তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ মহুয়া মৈত্র। তেতাল্লিশ বছরের এই নেত্রীর এর আগের পরিচয় তেমন কিছু ছিল না। একটি সর্বভারতীয় নিউজ চ্যানেলের সঞ্চালককে মধ্যমা দেখানো বা আসামের শিলচর বিমানবন্দরে নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে ধস্তাধ্বস্তি করা, এই সামান্য কিছু পরিচয় ছিল এ যাবৎ মহুয়ার। কিন্তু মঙ্গলবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করা এবং ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিং-এর উচ্চপদে কাজ করা মহুয়া যেভাবে লোকসভায় নিজের তীক্ষ্ণ ও মেধাবী বক্তব্যটি রাখলেন, তাতে তাঁকে বাহবা না দিয়ে পারা যায় না। ২০১৬ সালে নদিয়ার করিমপুরে বিধায়ক নির্বাচিত হওয়া মহুয়া এবারের লোকসভা নির্বাচনে ওই জেলারই কৃষ্ণনগর থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন, তাপস পালের জায়গায় তৃণমূলের টিকিট পেয়ে। এবারের নির্বাচনে বেশ কঠিন পরিশ্রম করেন তিনি ৬৩,০০০ ভোটে নিজের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপির কল্যাণ চৌবেকে হারান।
খুবই প্রাসঙ্গিক কথা উত্থাপন করেছেন বাগ্মী নেত্রী মহুয়া
লোকসভায় একের পর এক নানা প্রসঙ্গে সরকারকে বিঁধতে থাকেন -- জাতীয় সুরক্ষা নিয়ে বাড়াবাড়ি, অন্তঃসারশূন্য জাতীয়তাবাদ, সংবাদমাধ্যমের উপরে নিয়ন্ত্রণ, বিরোধী কণ্ঠকে কোনঠাসা করা, মানবাধিকারকে উপেক্ষা করা, ইত্যাদি। তিনি বলেন যতটা বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এই সরকার এসেছে ক্ষমতায়, ততটাই তার দায়িত্ব হয় বিরোধী কণ্ঠকে পরিসর দেওয়া। নজর ঘোরান দেশজুড়ে চলতে থাকা বিদ্বেষের রাজনীতি এবং খুনখারাপির দিকেও।
মহুয়া যে কথাগুলি বলেছেন, সেগুলি কংগ্রেসের কোনও নেতার বলা উচিত ছিল
মহুয়া মৈত্র আমাদেরকে গর্বিত করেছেন। যখন বিরোধী রাজনীতির পরিসর প্রায় শূন্যে এসে ঠেকেছে এবং বিরোধীরা হাসির খোরাকে পরিণত হয়েছেন প্রায়, তখন এই তেজস্বী নেত্রীর উঠে দাঁড়ানোটা এবং চোস্ত ভাষায় নিজের বক্তব্য সামনে রাখার নজিরটি নতুন করে আশা জোগায় দেশের গণতন্ত্রের প্রতি। তিনি এদিন একা অভিমন্যুর মতো যেভাবে রুখে দাঁড়ালেন বিরাট সরকারপক্ষের বিপক্ষে, সেটা আশা করা গিয়েছিল কংগ্রেসের মতো শতাব্দী-প্রাচীন দলের কাছে। কিন্তু তাঁদের কোনও নেতাকে এখনও দেখা যায়নি এভাবে মুখ খুলতে। লোকসভায় দলের নেতা হিসেবে অধীর রঞ্জন চৌধুরী বলেছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর সীমাবদ্ধতা আমাদের চোখে পড়েছে। মারকাটারি ব্যাট হয়তো তিনি চালাতে পারেন কিন্তু ব্যাকরণ মেনে শট তাঁর ব্যাট থেকে কতটা বেরোবে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। মহুয়া যে কথাগুলি বলেছেন, সেগুলির মধ্যে তাঁর মেধাবী মননের ছাপ রয়েছে রীতিমতো। এই কথাগুলি এককালে নেহরুবাদি রাজনৈতিক-সামাজিক রীতিনীতির ধারক কংগ্রেসের কেউ বলে উঠতে পারলেন না কেন, সেটাই অবাক করে।
সেদিক থেকে একটি ক্ষয়িষ্ণু আঞ্চলিক দলের প্রতিনিধি হিসেবে মহুয়ার ভূমিকা যথেষ্ট সদর্থক। তৃণমূলের বাকি ২১ জন সাংসদের অবশ্যই মহুয়াকে দেখে শেখার আছে, বিশেষ করে তিনি যেভাবে সমকালীন রাজনৈতিক-সামাজিক প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারকে চেপে ধরেছেন। যুক্তিপূর্ণ বিতর্ক বিজেপিকেও বাধ্য করবে যথার্থ জবাবদিহি করতে; এলোপাথাড়ি চেঁচামেচিতে পণ্ডশ্রমই হবে।
কিন্তু মহুয়াও যে পাল্টা আক্রমণের সামনে পড়বেন, তা নিয়ে সন্দেহ নেই
তবে মহুয়ার বক্তব্যে যথেষ্ট সারবত্তা থাকলেও তাঁর দলের যা অবস্থা এখন বাংলায়, তাতে তাঁর প্রতি পাল্টা আক্রমণ যে উড়ে আসবে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সঙ্গে সঙ্গে এও বললে অত্যুক্তি হয় না যে অধীরের সময়ে তৃণমূলের একা চলার পরিস্থিতিটি আরও প্রকট হবে কারণ অধীর কোনওমতেই তৃণমূলের সঙ্গে হাত মেলাবার লোক নন। আর সেই ক্ষেত্রে নিজেদের একক অবস্থান জানাতে তৃণমূলের মহুয়ার মতো নেত্রীরই প্রয়োজন হবে। কিন্তু পাল্টা কাটমানি-চিটফান্ড-দুর্নীতি ইত্যাদি ইস্যুতে মহুয়া কতটা দলকে আড়াল করে আক্রমণে যেতে পারেন, এখন দেখার বিষয় সেটাই।
[আরও পড়ুন: পুর আধিকারিককে মারধরের পর গ্রেফতার কৈলাশ পুত্র আকাশ]