কংগ্রেসের টিকিট পেয়েই ময়দানে তুখোড় রাজনীতিক লক্ষ্মণ, খুঁজে চলেছেন পুরনো সঙ্গীদের
পূর্ব মেদিনীপুর বিশেষ করে হলদিয়ার বেতাজ বাদশা তিনি। তাঁর কথায় বাঘে-বলদে এক ঘাটে জল খেত। পর পর তিনবার সাংসদ হয়েছেন। ২০১৪ সিপিএম থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পরে বিজেপি ঘুরে তিনি এখন কংগ্রেসে।
পূর্ব মেদিনীপুর বিশেষ করে হলদিয়ার বেতাজ বাদশা তিনি। তাঁর কথায় বাঘে-বলদে এক ঘাটে জল খেত। পর পর তিনবার সাংসদ হয়েছেন। ২০১৪ সিপিএম থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পরে বিজেপি ঘুরে তিনি এখন কংগ্রেসে। কংগ্রেসের প্রতীক নিয়েই এবারের লোকসভা নির্বাচনে তমলুক কেন্দ্র থেকে লড়াই করবেন তিনি। এখন প্রশ্ন তিনি কি এই যুদ্ধে পাশে পাবেন পুরনো 'বন্ধু'দের।
আগের সেই দাপট নেই লক্ষণ শেঠের। একটা সময়ে তাঁর কথাই ছিল এলাকার শেষ কথা, সেই তিনি এখন রাজপাট হারিয়ে প্রায় এক দশক ধরে নিঃসঙ্গ। সেই অবস্থাতেই ভোটযুদ্ধে নামতে চলেছেন একদা হলদিয়ার মুকুটহীন সম্রাট। তাঁর প্রতিপক্ষ তৃণমূল কংগ্রেসের দিব্যেন্দু অধিকারী, যিনি ২০১৬ সালে লোকসভার উপ নির্বাচনে ৭,৭৯,৫৯৪ ভোট পেয়েছিলেন। জিতেছিলেন ৪,৯৭,৫২৮ ভোটে।
১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৯ সাল অবধি তমলুক কেন্দ্রের সাংসদ ছিলেন লক্ষণ শেঠ। ২০০৯ সালের নির্বাচনে শুভেন্দু অধিকারীর কাছে তিনি হারেন ১,৭২,৯৫৮ ভোটের ব্যবধানে। সেই নির্বাচন হয়েছিল নন্দীগ্রাম আন্দোলনের আবহে। জমি বাঁচাতে নন্দীগ্রামে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তার জন্য দায়ী করা হয় লক্ষণ শেঠকে।
এই আন্দোলন থেকেই রাজ্যে সিপিএমের পতন শুরু হয়। যার জেরে রাজ্যে ৩৪ বছর পর ক্ষমতা হারায় বামফ্রন্ট। নন্দীগ্রাম-কাণ্ডসহ একাধিক দুর্নীতি ইস্যুতে ২০১৪ সালে লক্ষণ শেঠকে দল থেকে বহিষ্কার করে সিপিএম। এরপর সিপিএম থেকে বহিষ্কৃত লক্ষ্মণবাবু নিজের অনুগামীদের নিয়ে 'ভারত নির্মাণ পার্টি' গঠন করেন। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে জোট করে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া লক্ষ্মণবাবুর সব প্রার্থীরই জামানত জব্দ হয়।
ওই বছর লোকসভা উপনির্বাচনের প্রাক্কালে লক্ষ্মণবাবু নিজের তৈরি দলের নেতা-কর্মীদের নিয়ে বিজেপিতে যোগ দেন। দিন কয়েক আগে তিনি বিজেপির সঙ্গ ত্যাগ করে কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন। সেই তিনিই এবার হাত চিহ্নে লড়াই করতে চলেছেন তমলুক কেন্দ্রে। রাজপাট সব হারালেও, এখনও পুরোপুরি হার মানতে রাজি নন লক্ষ্মণ শেঠ।
এখন তিনি নিজের জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। মনে করেন, ঠিক মতো ভোট হলে তিনিই জিতবেন। এখনকার হলদিয়ার নির্মানের সুচনা হয়েছিল তাঁর হাত ধরে, সেই তিনি এখনও তাঁর অতীতের কাজের ফিরিস্তি দিয়ে ভোট যুদ্ধে নিজের জয় দেখছেন। শরীর ভেঙে গেলেও মন তার তরতাজা। এখনও জয়ের স্বপ্ন দেখে লক্ষ্মণের মন।
তবে তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন, এই মুহূর্তে লড়াইটা খুব কঠিন। তাই বেশ কিছু কৌশল নিতে চান তিনি। কী সেই কৌশল তা অবশ্য খোলসা করে বললেন না। তবে চোখে-মুখে ফুটে উঠল প্রত্যয়। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় লক্ষণ শেঠের ভূমিকা নিয়ে সেই সময় সরব হয়েছিল কংগ্রেসও। এখন 'নন্দীগ্রামের সেই কলঙ্কিত নায়ক' হাত ধরেছেন। এই কেন্দ্রে তিনিই কংগ্রেসের প্রার্থী।
ইতিমধ্যে কংগ্রেসের হয়ে এক কর্মিসভাও করে ফেলেছেন তিনি। লক্ষণ শেঠকে নিয়ে জেলা কংগ্রেস সভাপতি মানিক ভৌমিক বলেন, ব্যক্তি লক্ষণ শেঠকে নিয়ে অনেক অভিযোগ থাকতেই পারে। তবে আমাদের রাজ্য সভাপতি সোমেন মিত্র যখন তাঁর হাতে দলীয় পতাকা তুলে দিয়েছেন তাঁকেই আমরা প্রার্থী হিসাবে মেনে নিয়েছি।
জেলা কংগ্রেস তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে জানিয়েছে, তিনি সেই সময় সব কাজ করেছিলেন বামফ্রন্টের নেতাদের নির্দেশে। তাই নন্দীগ্রামের সব ঘটনার জন্য শুধু তাঁকে ভিকটিমাইজ করা হচ্ছে কেন? দলের সবাই লক্ষণ শেঠকে জেতাতে সব উদ্যোগ নিয়ে প্রচার চালাবে।
এক সময় যারা লক্ষ্মণ শেঠকে সর্বদা ঘিরে থাকত তাদের বেশির ভাগই এখন জার্সি বদল করে অন্যদলে। কঠিন যুদ্ধের আগে পুরনো সঙ্গীদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কার্যত খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে লক্ষ্মণবাবুকে। কেউ মুখের উপর না বলছেন, কেউবা সবিনয়ে নিজের বাধ্যবাধকতার কথা জানিয়ে দিচ্ছেন।
লক্ষ্মণবাবুর সঙ্গে থাকা তাঁর এক প্রধান অনুচর প্রণব দাস বলেন, রাজনৈতিক অবস্থান বদল হলে পুরনো বন্ধুদের একসঙ্গে পাওয়া যায় না। আবার অনেক নতুন বন্ধুও আসে। তবে আমরা পুরনো বন্ধু, সহকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গে কথা বলছি। আশা করছি, সকলেই লক্ষ্মণদার পাশে দাঁড়াবেন।
নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলনকে হাতিয়ার করে তৃণমূল কংগ্রেসের শুভেন্দু অধিকারী ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে সম্রাটের আসন থেকে লক্ষ্মণবাবুকে ভূপতিত করেন। ২০১১ সালে বিধানসভা ভোটে বামদুর্গের পতনের পর লক্ষ্মণবাবুর রাজনৈতিক জীবনে সঙ্কট ঘনিয়ে আসে। কিন্তু বারবার দল বদলের খেলায় তাঁর ঘনিষ্ঠ অনুচরদের কেউ এখন তৃণমূলের কাউন্সিলার, কেউ বা বিজেপির কোষাধ্যক্ষ, কেউবা বসে গিয়েছেন।
একদা হলদিয়ায় লক্ষ্মণবাবুকে 'বাবা' বলে ডাকা সিপিএম নেতা শেখ মোজাফ্ফর এখন তৃণমূলের ডাকসাইটে নেতা। তাঁর ছেলে আজগর আলি হলদিয়া পুরসভার চেয়ারম্যান ইন কাউন্সিলের সদস্য। মোজাফ্ফর সাহেব বলেন, লক্ষ্মণবাবুকে আমি বাবার মতোই সম্মান করি। তবে রাজনৈতিক মতাদর্শ আলাদা। বর্তমানে আমার নেতা শুভেন্দু অধিকারী। দিব্যেন্দুবাবুর সমর্থনে আমি ভোট প্রচার করছি।
বর্তমানে হলদিয়া পুরসভার পূর্ত দফতরের চেয়ারম্যান ইন কাউন্সিলের সদস্য নারায়ণ প্রামাণিকের মতো লক্ষ্মণবাবুর ঘনিষ্ঠ বহু নেতা বলেন, ব্যক্তিগত সম্পর্ক রাজনীতিতে কোনও প্রভাব ফেলবে না। আমরা এখন তৃণমূলের সৈনিক। নন্দকুমার পঞ্চায়েত সমিতির বর্তমান শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ হৃষিকেশ মাজি, তমলুক পুরসভার কাউন্সিলার চন্দন দে ও স্নিগ্ধা মিশ্র লক্ষ্মণবাবুর ঘনিষ্ঠ হিসেবে একসময় সিপিএম ছেড়ে ভারত নির্মাণ পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁরা একযোগে বলেন, আমরা এখন তৃণমূলের কর্মী। আমাদের একমাত্র লক্ষ্য দিব্যেন্দুবাবুকে বিপুল ভোটে জেতানো।
লক্ষ্মণবাবুর আরেক বিশ্বস্ত অনুচর বিজন মিত্র বর্তমানে বিজেপির তমলুক জেলার কোষাধ্যক্ষ। তিনি বলেন, আমি এখন বিজেপির সৈনিক। তাই বিজেপি প্রার্থীকে জেতানোর সবরকম চেষ্টা করছি। আর এলাকার মানুষ বুঝতে পারছেন না এই অবস্থায় লক্ষণ শেঠ কি করে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন, কারণ জেলায় এখন কংগ্রেসের সংগঠনটাই বলতে গেলে নেই। তাই এক সময়ের বেতাজ বাদশা জানেন তিনি এক কঠিন লড়াইয়ে নেমেছেন। আর তারপরেও লড়াইয়ের ময়দান থেকে পালিয়ে যেতে রাজি নন তিনি।