বিলম্বিত বোধোদয় বিজেপির! মুকুলের পদ্ম-পথে ‘কাঁটা’ তাঁরই এককালের সাথী
রাজনৈতিক মহলে জোর চর্চা- কেন মুকুল রায়কে নিয়ে কালবিলম্ব করছে বিজেপি। মুকুলকে নিয়ে এই ‘বিলম্বিত লয়ে’র পিছনে নাকি রয়েছেন মুকুল ঘনিষ্ঠ এক সাংসদই।
শরতে তৃণমূলে মুকুল ঝরলেও, পদ্মের ডালে বাসা বাঁধতে ব্যর্থ হয়েছেন প্রাক্তন এই সাংসদ। এই হেমন্তে আদৌ মুকুল রায়কে বিজেপি শিবির বরণ করে ঘরে তুলতে পারবে কি না, তা নিয়ে জল্পনার অন্ত নেই। এর মধ্যেই রাজনৈতিক মহলে জোর চর্চা- কেন মুকুল রায়কে নিয়ে কালবিলম্ব করছে বিজেপি। মুকুলকে নিয়ে এই 'বিলম্বিত লয়ে'র পিছনে নাকি রয়েছেন মুকুল ঘনিষ্ঠ এক সাংসদই।
জাতীয়তাবাদী তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি অমিতাভ মজুমদার মুকুল রায়কে তৃণমূলের চর বলে অভিহিত করে বিজেপিকে সাবধান করেছিলেন। থমকে গিয়েছিল বিজেপির মুকুলকে নিয়ে পরিকল্পনা। সেইসঙ্গে একদা সতীর্থ কুণাল ঘোষের চিঠিও গিয়েছিল বিজেপির শীর্ষ নেতাদের হাতে। নরেন্দ্র মোদী থেকে অমিত শাহ- সবাই তাই সাবধান মুকুল রায়কে নিয়ে। শেষ মুহূর্তে কুণাল ঘোষের লেখা চিঠিতেই আটকে গিয়েছে বিজেপির দরজা। তা আবার টেনে খোলার চেষ্টা চলছে।
আসলে কিছুতেই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছেন মোদী-শাহ জুটি। মুকুলকে না পারছেন ফেলতে, না পারছেন গিলতে। একই অবস্থা মুকুল রায়েরও। বিজেপিই তাঁর একমাত্র সম্বল। সব কূল হারিয়েছেন তিনি, একমাত্র পদ্মশিবিরই তাঁকে ফের দিতে পারে গুরুত্বের আসন। কিন্তু তিনিও জানেন না- বিজেপি কেন তাঁকে এত ল্যাজে খেলাচ্ছে।
আসলে মুকুল রায় তৃণমূল ছাড়ার দিনই অনেকের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। এমনকী যাঁরা তাঁর সঙ্গে ছিলেন, তাঁরাও মুকুল রায়ের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেন। কেন মমতাকে তিনি সারদা-নারদ থেকে ক্লিনচিট দিলেন, তা নিয়েই প্রশ্ন অনেকের। তিনি অমিতাভ মজুমদার হন বা কুণাল ঘোষ, কিংবা অন্য কেউ- এই প্রশ্নে মুকুল রায়কে সরাসরি বিঁধতে ছাড়লেন না।
মুকুল রায়কে প্রকাশ্যে তোপ দাগেন কুণাল ঘোষ। তাঁর মন্তব্য নিয়ে সমালোচনায় বিদ্ধ করেন। তারপরই তিনি বসে না থেকে মুকুল রায়ের সারদা-নারদ অবস্থান নিয়ে সটান মোদী-অমিত শাহদের চিঠি লিখে বসেন। জনে জনে বিস্ফোরক চিঠি লিখে তিনি জানিয়ে দেন, মুকুলকে নিলে বিজেপিকে অনেক কাঁটাও গিলতে হবে। তাতেই ধাক্কা খায় মুকুলের বিজেপি-বরণ।
গত শনিবারই পাকাপাকি সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছিল মুকুল রায়কে গেরুয়া সংসারে বরণ করে নেওয়া হবে। বিজেপির কেন্দ্রীয় পার্টি অফিসে যখন সাজো সাজো রব, তখনই মুকুল রায়কে সাড়ে তিনঘণ্টারও বেশি সময় বসিয়ে রাখা হল। কৈলাশ বিজয়বর্গীয় তাঁকে আশ্বাস দিয়েও নিয়ে গেলেন না মোদী-অমিত সকাশে।
বারবার ফোন করে গেলেন মুকুল রায়। কিন্তু এদিক থেকে কোনও ইতিবাচক সাড়া পেলেন না। দফায় দফায় বৈঠকেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হল না। কিন্তু আগেই যখন সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছিল, শেষ সময়ে এসে আবার কীসের আলোচনা। তা বোধগম্য হয়নি মুকুলবাবুরও। তখনই এসেছিল কুণাল ঘোষের চিঠি প্রসঙ্গ। তাতেই নাকি মুকুলের বিজেপিতে যোগদান আপাতত স্থগিত হয়ে যায়।
এই চিঠিগুলির খবর গোপন রাখার চেষ্টা হয়েছিল। তবু দেরিতে হলেও বেরিয়ে আসে চিঠি প্রসঙ্গ। তবু মুকুলকে যখন বিজেপির দলে আমন্ত্রণ করা ছাড়া কোনও উপায় নেই, তখন আর ভাবনার অবকাশ কেন? অমিতাভ বাবু বলেছিলেন- 'মুকুল রায় তৃণমূলের চর।'। আর কুণালবাবুর বোমা- 'মুকুল রায়ের আর্থিক দুর্নীতি প্রসঙ্গ। সারদা থেকে নারদ কিংবা অন্য চিটফান্ড প্রসঙ্গও উঠে এসেছিল সেই চিঠিতে।'
কুণালবাবু ছ'টি চিঠি লিখেছিলেন। আর স্পষ্ট করে বললে বিজেপির ছয় নেতাকে পৃথক পৃথক চিঠি পাঠিয়েছিলেন। নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ, রাজনাথ সিং, অরুণ জেটলি থেকে শুরু করে কৈলাশ বিজয়বর্গীয়, এমনকী দিলীপ ঘোষকেও। তাঁর স্পষ্ট বার্তা ছিল, তৃণমূল বা মমতার বিরুদ্ধে যা অভিযোগ, সেই অভিযোগ মুকুল রায়ের বিরুদ্ধেও। কেননা মুকুল রায় শুধু তৃণমূলের দু'নম্বর ছিলেন না, ছিলেন তৃণমূলের চোখ। তাঁর চোখ দিয়েই দলের যাবতীয় কাজকর্ম দেখতেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ফলে বিজেপির কাছে এখন 'শাঁখের করাত' হয়েছে মুকুলকে দলে নেওয়া বা না নেওয়ার বিষয়টি। নিলে সারদা-নারদের কাঁটাও গ্রহণ করতে হবে। প্রচার হবে সারদা-নারদে অভিযুক্তকে রাজনৈতিকভাবে আশ্রয় দিচ্ছে বিজেপি। সেইসঙ্গে সারদা-নারদ ইত্যাদি আর্থিক কেলেঙ্কারি নিয়ে তৃণমূলকে অলআউট আক্রমণে যেতে পারবে না দল।
আর অপর পক্ষে তাঁকে দলে না নিলে অন্যান্য-রা দল ছেড়ে বিজেপিতে আসতে ভয় পাবেন। বিশেষ করে মুকুল রায়কে নিয়ে এত কীর্তির পর যদি দলে না নেওয়া হয়, ভুল বার্তা যাবে অনেকের কাছে। তা রাজ্যে বিজেপিকে আরও শেষ করে দেবে। পঞ্চায়েতে তো বটেই আগামী নির্বাচনগুলিতেও তার খারাপ প্রভাব পড়বে।
বরং মুকুল রায়কে নিলে অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও বিজেপির শ্রীবৃদ্ধির একটা সম্ভাবনা তৈরি হবে রাজ্যে। এই মুহূর্তে রাজ্যে তারাই দ্বিতীয় শক্তি। তৃণমূলের সঙ্গে লড়াই বিজেপিরই। কিন্তু তৃণমূলকে লড়াই দেওয়ার মতো জায়গা এখনও তৈরি করতে পারেনি বিজেপি। তা সম্ভব যদি মুকুল রায়ের মতো কারও হাতে সংগঠনের গুরুদায়িত্ব অর্পণ করা যায়।
শুধু কি রাজ্য বিজেপিতে মুকুলের প্রভাব পড়বে। দিল্লির রাজনীতিতে এবং অন্যান্য রাজ্যেও এর খারাপ প্রভাব পড়বে। মুকুল রায়কে না নিলে একটা হল্লা হবে সর্বত্রই। ফলে অন্য রাজ্যগুলির নেতারাও বিজেপিতে আসতে ভয় পাবেন। তাঁদের সঙ্গেও এমন হতে পারে ভেবে বিজেপি বিরোধী হাওয়া তৈরি হবে। তাই সাবধানী বিজেপি।