রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের স্বপ্নাদিষ্ট দেবীর কুমারী বালিকা মূর্তিই আজ পূজিত হয় কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে
সাবেকি জৌলুস আর আভিজাত্যে ভরা ঐতিহ্যের সেই পুজো। আজও স্বতন্ত্র। জনশ্রুতি আর ইতিহাস মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে যেখানে। ঠিক ধরেছেন, এ পুজো কৃষ্ণচন্দ্রের প্রবর্তিত জগদ্ধাত্রী পুজো।
সাবেকি জৌলুস আর আভিজাত্যে ভরা ঐতিহ্যের সেই পুজো। আজও স্বতন্ত্র। জনশ্রুতি আর ইতিহাস মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে যেখানে। ঠিক ধরেছেন, এ পুজো কৃষ্ণচন্দ্রের প্রবর্তিত জগদ্ধাত্রী পুজো। হোক না এক দিনের। কিন্তু এ পুজো যে আজ কিংবদন্তির পর্যায়ে। আর ঐতিহ্য যখন আছে, তখন কাহিনি থাকবে না, তা কী হয়! রাজবাড়ির তোরণ পেরোলেই সেই কথা বলে ওঠে ইতিহাস। রাজবাড়ির প্রতিটি প্রস্তরে লেখা সেই কাহিনি। রাজকর দিতে না পারায় নবাব আলিবর্দি খাঁয়ের কারাগারে বন্দি রাজা কৃষ্ণচন্দ্র।
আনুমানিক ১৭৫৪ সাল। কারাগার থেকে যেদিন তিনি বের হলেন, সেদিন দুর্গোৎসব শেষ। নৌকায় করে যখন ফিরছেন কৃষ্ণনগরে, গঙ্গার ঘাটে চলছে নিরঞ্জন পর্ব। ক্লান্ত শরীর, বিষণ্ণ মন। নৌকোতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। জনশ্রুতি, সেখানেই কৃষ্ণচন্দ্র স্বপ্নে দেখেছিলেন এক রক্তবর্ণা চতুর্ভুজা কুমারী দেবীকে। তিনি কৃষ্ণচন্দ্রকে নির্দেশ দিয়েছিলেন কার্তিক মাসের শুক্লানবমী তিথিতে তাঁর পুজো করতে। সেই মতোই কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে সূচনা হয়েছিল জগদ্ধাত্রী পুজোর।
এই কল্পকাহিনির পাশাপাশি আরও একটি কাহিনি রয়েছে কৃষ্ণচন্দ্রের জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রবর্তন নিয়ে। সেই ঘটনা আরও দশ বছর পরের। ১৭৬৪ সাল। বাংলার স্বাধীনতা সূর্য তখন অস্তমিত। মীরকাশিমের নির্দেশে মুঙ্গেরের কারাগারে বন্দি রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও তাঁর পুত্র শিবচন্দ্র। কৃষ্ণচন্দ্রের প্রাণদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন মীরকাশিম।
কারাগারেই রাজা কৃষ্ণচন্দ্র স্বপ্নাদেশ পান। দর্শন করেন চতুর্ভূজা দেবীর। পথ খুঁজে পান কারাগার থেকে মুক্তিলাভের। কারামুক্ত হয়েই কৃষ্ণচন্দ্র, পুত্র শিবচন্দ্র ও গোপালভাঁড়কে নিয়ে ছুটে যান তান্ত্রিক কালীশঙ্কর মৈত্রের কাছে। কৃষ্ণচন্দ্র এই স্বপ্নের কথা জানান তন্ত্র সাধক কালীশঙ্কর মৈত্রকে। তিনিই জানান, স্বয়ং চণ্ডীর রূপ ওই দেবী। এই দেবীর পুজোর প্রচলন প্রাচীনকালেও ছিল।
এরপর কৃষ্ণনগরে না ফিরে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র চলে গিয়েছিলেন চন্দননগরে। তাঁর বন্ধু ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর কাছে। কৃষ্ণনগরের রাজবাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজোর দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন পুত্র শিবচন্দ্র ও গোপালভাঁড়কে। তাঁরাই জগদ্ধাত্রী পুজোর সব আয়োজন করেছিলেন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র পুজোর আগের দিন রাতে ফিরে আসেন কৃষ্ণনগরে। গবেষকদের মতে, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রই জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রবর্তক।
পরের বছর থেকে চন্দননগরে পুজোর প্রচলন হয়েছিল ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর উদ্যোগে। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির প্রতিমা অন্যান্য প্রতিমার চেয়ে আকারে ছোট। তার কারণ, স্বপ্নাদেশে কৃষ্ণচন্দ্র যে দেবীর দর্শন পেয়েছিলেন, সেই আদলেই দেবীর কুমারী বালিকা মূর্তি স্থাপন করা হয়। সিংহবাহনা দেবী। সিংহটি দেখতে দাবানলের ঘোড়ার মতো। এক দিনে তিন বার পুজো হয়। সকালে সাত্বিকি, দুপুরে রাজসিকি, সন্ধেবেলা তামসিকি রূপে পুজোই রীতি।
পুজোয় অন্নভোগের পাশাপাশি ন'রকম ভাজা, তরকারি, পোলাও, তিন রকম মাছ, চাটনি, পায়েস সুজি, মিষ্টি হয়। রাজবাড়ির পুজোর নিয়ম, নিষ্ঠা আর জৌলুস আজও বর্তমান। রাজবাড়ির পুজো শুরুর পরই ধীরে ধীরে কৃষ্ণনগরে শুরু হয়েছিল সর্বজনীন জগদ্ধাত্রী পুজো। আজও কৃষ্ণনগরের সব সর্বজনীন প্রতিমা রাজবাড়ির সামনে দিয়ে শোভাযাত্রা করে বিসর্জনে নিয়ে যাওয়াই রেওয়াজ।