বদল নেই সন্ত্রাসের ভোট-চিত্রে, এবারও অভিযোগ থেকে বেরোতে পারল না কলকাতা পুরভোট
বদল নেই সন্ত্রাসের ভোট-চিত্রে, এবারও অভিযোগ থেকে বেরোতে পারল না কলকাতা পুরভোট
অশান্তিতে তৃণমূল কংগ্রেসের যোগ আছে প্রমাণ করতে পারলে ব্যবস্থা নেবে দল, কলকাতা পুরসভা ভোটের দিন ফের সাফাই গেয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি আগেও বড়মুখ করে বলেছিলেন, এবার এমন ভোট হবে বিরোধীরা কোনও অভিযোগ করতে পারবে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল অন্য ছবি। চিরাচরিত সেই ভোট-সন্ত্রাসের অভিযোগ থেকে বের হতে পারল না কলকাতা পুরভোটও।
বাংলায় ভোট-সন্ত্রাসের এই ধারা আজকের নয়। সাতের দশক থেকেই এই অভিযোগ উঠে এসেছে। প্রথম কংগ্রেস, তারপরে দীর্ঘদিন ধরে সিপিএম, হালে তৃণমূল কংগ্রেসের আমলে সন্ত্রাসের সেই ধারা অব্যাহত। শুধু লোকসভা বা বিধানসভা নির্বাচন নয়, পুরভোট বা পঞ্চায়েত ভোটেও লাগাতার সন্ত্রাস চলছে। ২০১১ সালের বাংলায় পরিবর্তনের পরও সন্ত্রাসের আবহে কোনও পরিবর্তন নেই।
২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে ব্যাপক সন্ত্রাস হয়েছে। ৩৩ শতাংশ আসনে ভোট হয়নি, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছে তৃণমূল। তারপর বাকি আসনে যে ভোট হয়, সেখানেও অশান্তি, হিংসা। ২০১৯ ও ২০২১-এর আগে পরও কম অশান্তি হয়নি। একুশের বিধানসভা ভোটের পর ব্যাপক সন্ত্রাস চলছে, মামলা হয়েছে, গ্রেফতার হয়েছে, তদন্তও চলছে। কিন্তু সুরাহা মেলেনি। বন্ধও হয়নি সন্ত্রাসের বাতাবরণ। এই পুরভোটই তার প্রমাণ।
২০১৫ সালে কলকাতা পুরভোটেও ভোট-সন্ত্রাস হয়েছিল। ২০২১-ও সেই পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হল না। বিরোধীরা অভিযোগ করতে পারবেন না, বলে যে দাবি করেছিলেন অভিষেক, সেই কথা রাখতে পারলেন না তিনি। কলকাতা পুরভোটেও রক্ত ঝরল, বোমাবাজি হল, মারাপিট, হাতাহাতি, ভাঙচুর, ছাপ্পাভোট- সবই চলল। তুলকালাম কাণ্ড ঘটল কলকাতা পুরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডে।
৪৫ নম্বর ওয়ার্ডে কংগ্রেসের এজেন্ট হিসেবে প্রদেশ কংগ্রেস নেতা অমিতাভ চক্রবর্তীর মতো নেতাকেও আক্রান্ত হতে হল। ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হল কংগ্রেস এজেন্টদের। ব্র্যাবোর্ন রোডের জৈন বিদ্যালয়ে বুথের মধ্যেই হাতাহাতিতে জড়ালেন কংগ্রেস ও তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। অমিতাভ চক্রবর্তীকে বের করে দেওয়া হল রাস্তায়। তাঁর উপরও হামলা হল।
মাড়োয়ারি বিদ্যালয়ে ভোট বন্ধ করে দেওয়া হল। অভিযোগ এই বুথ দখল হয়ে গিয়েছে। বড়বাজারে ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের একটি বুথে ঢুকে ভাঙা হল ইভিএম। তার ফলেই ভোট বন্ধ হয়ে যায়। বিজয় ওঝার বিরুদ্ধে ছাপ্পা ভোটে মদত দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ২৩ নম্বর ওয়ার্জের ৮ ও ৯ নম্বর বুথে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়। অশান্তি হলেও এই বুথদখল হয়নি বলে জানায় নির্বাচন কমিশন।
বামপ্রার্থী ফৈয়াজ আহমেদের উপর হামলা চালানো হয়। তাঁর গাড়িতে হামলা চালায় একদল বহিরাগত। তিনি রক্তাক্ত হন। তারপর রাস্তায় বসে অবস্থান-বিক্ষোভ শুরু করেন। এলাকায় বহিরাগত তাণ্ডবের অভিযোগ আনেন বামপ্রার্থী। তাঁর অভিযোগ তৃণমূলের বিরুদ্ধে। তৃণমূলের মদতে বহিরাগতরা জড়ো হয়ে তাণ্ডব চালায়। ১০২, ১০৪, ১০৮, ১০৯- এই চারটি ওয়ার্ডে সিপিএম পুনর্নির্বাচন চেয়েছেন। তাঁরা রাস্তায় বসে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন। তাঁদের অভিযোগ, বিরোধী এজেন্টদের বের করে শাসক দল ভোটকে প্রহসনে রূপান্তরিত করেছে। পূর্ব পুটিয়ারিতে সিপিএম প্রার্থীর এজেন্টের বাড়িয়ে হুমকি দিয়ে যায় একদল। এই ঘটনায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে অভিযোগ সিপিএমের।
এমন অজস্র ঘটনা ঘটেছে কলকাতা পুরসভার ভোটে। আক্রান্ত হয়েছেন প্রার্থী, ভোটাররা রক্তাক্ত হয়েছেন। বুথে ভাঙচুর, মারপিট, ছাপ্পা- সবকিছুই চলেছে। চলেচে ব্যাপক বোমাবাজির ঘটনা। আর পুলিশ সাংবাদিক বৈঠক করে জানিয়েছে, টাকিতে বোমাবাজির ঘটনায় এখনও পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে একজনকে। এখনও পর্যন্ত ৭২ জনকে মোট গ্রেফতার করা হয়েছে। ভিড়, জমায়েত দেখলেই পুলিশের তরফে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বড় কোনও ঘটনা ঘটেনি, মোটের উপর শান্তিপূর্ণ ভাবেই ভোট হয়েছে বলে দাবি কলকাতা পুলিশের। তবে এদিন সেই একই চিত্র উঠে এল পুরভোটে। ভোট মানেই সন্ত্রাসের অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ। এবারও বদল হল না ছবি। বাংলার পরিস্থিতি সেই একই জায়গায় রয়ে গেল। জেলা নয় মহানগর কলকাতা পুরভোটেই দেখা গেল সন্ত্রাসের ভয়াবহ ছবি।