'প্রধানমন্ত্রী কা গেস্ট আ গেয়া', 'টপ ভয়েস'- মুখোমুখি মন কি বাত-এ অংশ নেওয়া সহিদুল
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী-র মন কি বাত অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন বারুইপুরের সহিদুল লস্কর। 'মন কি বাত' অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে রবিবার মধ্যরাতেই কলকাতায় ফিরেছেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী-র মন কি বাত অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন বারুইপুরের সহিদুল লস্কর। 'মন কি বাত' অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে রবিবার মধ্যরাতেই কলকাতায় ফিরেছেন তিনি। এরপর মুখোমুখি হয়েছিলেন ওয়ানইন্ডিয়া বেঙ্গলি-র। 'টপ ভয়েস'-এ কী বললেন সহিদুল, জানুন-
ওয়ানইন্ডিয়া বেঙ্গলি- মন কি বাত-এর পঞ্চাশতম এপিসোডের জন্য আপনাদের লাইভ টেলিকাস্ট ছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে, সেটা হল না কেন?
সহিদুল লস্কর- নরেন্দ্র মোদী যে 'মন কি বাত'-এর পঞ্চাশতম এপিসোড-এ আমাদের সঙ্গে সরাসরি লাইভ অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন তেমনটাই জানানো হয়েছিল। হোটেল অশোকা থেকে আমরা মান্ডি হাউসে পৌঁছই রবিবার বেলা ১২ টা-র কিছু আগে। ততক্ষণে খবর পেয়েছিলাম যে ১১টা থেকে 'মন কি বাত অনুষ্ঠান'-এর সম্প্রচার শুরু হয়ে গিয়েছে। একটু চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। ডিডি নিউজের দফতরে ঢুকে জানতে পারি নরেন্দ্র মোদী আসতে পারছেন না। তাই মন কি বাত-এর রেকর্ডেড প্রোগামটা চালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ওয়ানইন্ডিয়া বেঙ্গলি- হতাশ হয়ে পড়েছিলেন কি? যার জন্য এত প্রস্তুতি নিয়ে এলেন তাঁর সঙ্গেই তো সাক্ষাৎ হচ্ছে না!
সহিদুল লস্কর- মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু, পরক্ষণেই নিজেকে বোঝাই নরেন্দ্র মোদী দেশের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর উপরে অনেক দায়িত্ব। সুতরাং, তাঁর ব্যস্ত থাকাটাই স্বাভাবিক। হতাশ একদমই হইনি। 'আশাহত' শব্দটা জুড়লে বরং সঠিক প্রয়োগ হবে। কারণ, তাঁর অপেক্ষায় থাকা মানুষগুলোর কথা ভেবে প্রধানমন্ত্রী ভিডিও বার্তা পাঠিয়েছিলেন। আমার মতো একজন মানুষের কাছে সেটা বড় পাওনা। তিনি এমনটা নাও করতে পারতেন। কিন্তু, উনি তো আমাদের কথা ভেবেছেন। আজ যে সম্মান মানুষের কাছে বিপুলভাবে পাচ্ছি শুধু নয়, গত কয়েক মাসে যেভাবে অসংখ্য মানুষ আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন তা তো সবই প্রধানমন্ত্রীর জন্য। তিনি 'মন কি বাত' অনুষ্ঠানে আমার নাম না নিলে এই সম্মান তো কোনওদিনই পেতাম না। তাঁর মতো একজন মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে অবশ্যই আনন্দ হতো। কিন্তু সেটা হয়নি। আশাহত বটে, কিন্তু হতাশ নই।
ওয়ানইন্ডিয়া বেঙ্গলি- প্রধানমন্ত্রীর জন্য বারুইপুরের বিখ্যাত পেয়ারা, জামরুল নিয়ে গিয়েছিলেন, সেগুলোর কী হল?
সহিদুল লস্কর- জীবনে একটা কথা আমি খুব ভালভাবে মানি- আর সেটা হল জীবনের কোনও কিছুই ব্যর্থ হয় না। প্রধানমন্ত্রীর জন্য নিজের বাগানের পেয়ারা ও জামরুল নিয়ে গিয়েছিলাম। তবে, তা আমি সেখানে থাকা আধিকারিকদের হাতে তুলে দিয়েছি। তাঁরা সেই পেয়ারার ডালা এবং জামরুল ও একটি চিঠি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী-র হাতে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন।
ওয়ানইন্ডিয়া বেঙ্গলি- এই দিল্লি সফরে কোন জিনিসটা আপনি সারাজীবন খেয়াল রাখবেন?
সহিদুল লস্কর- ট্যাক্সি চালিয়ে হাসপাতাল তৈরির কাজে হাত দিয়েছিলাম একটা সময়। তিল তিল করে জমানো অর্থ এবং মানুষের সহযোগিতায় তা আজ সম্পূর্ণ হওয়ার পথে। স্ত্রী সামিমা ওর গয়না পর্যন্ত বিক্রি করেছে। অসংখ্য মানুষ আমাদের এর জন্য অভিনন্দন জানান যা আমাদের কাছে গর্বের। তবে এই দিল্লি সফরে যেভাবে আমি প্রতিটি পদক্ষেপে সম্মান পেয়েছি তা জীবনে ভুলব না। এই কথা তো জীবনেও ভুলবো না, সেটা হল আমি যখন দিল্লির অশোকা হোটেলে পা রেখেছি তখন সেখানকার কর্মী এবং রিসেপশন-এ থাকা লোকজন যে ভাবে বলছিলেন 'প্রধানমন্ত্রী ক্যা গেস্ট আ-গেয়া'- তখন সত্যি সত্যি মনটা আনন্দে ভরে উঠেছিল। স্বপ্নেও ভাবিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হবে। ২০১৮-র ২৪ নভেম্বর রাত থেকে ২৫ নভেম্বর রাত ১১টা পর্যন্ত আমি ছিলাম প্রধানমন্ত্রীর অতিথি। এমন কথা শুনতে পেয়ে চোখে প্রায় জলে এসে গিয়েছিল। এটাও তো একটা পাওনা। স্বীকৃতি। বুঝতে পেরেছিলাম আমি আমার কাজে সঠিকভাবেই এগিয়ে চলেছি।
ওয়ানইন্ডিয়া বেঙ্গলি- মন কি বাত-এ আপনার কাছে কী জানতে চাওয়া হয়?
সহিদুল লস্কর- মন কি বাত-এই অনুষ্ঠানে আমার নামটা অতিথিদের তালিকায় প্রথমে ছিল। এছাড়াও অনুষ্ঠান পরিচালনা করছিলেন নীলম শর্মা। ছিলেন প্রসারভারতীর চেয়ারম্যান সূর্যপ্রকাশ। এছাড়াও ছিলেন এফটিআই-এর চেয়ারম্যান তথা বিখ্যাত হিন্দি সাহিত্যিক এবং বলিউডের সফল গান লিখিয়ে প্রসূন জোশী। অনুষ্ঠানের শুরুতেই আমার নাম ডাকা হয়। সেখানে আমাকে নিয়ে তৈরি একটি নিউজ ক্লিপিং দেখানো হয়। এতে দেখানো হয় আমি কীভাবে কাজ করছি- সে বিষয়গুলি। আমাকে নানা ধরনের প্রশ্ন করা হয়। আমি তার উত্তর দেই। আমার হাসপাতাল বর্তমানে কোন জায়গায় রয়েছে থেকে শুরু করে আগামী-তে আমি আর কোন কোন কাজ করতে চাই তাও জানতে চাওয়া হয়। বাংলা মেশানো হিন্দিতেই তাঁর জবাব দেই। জানাই যে এমন এক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পেরে আমি সত্যি অভিভূত।
ওয়ানইন্ডিয়া বেঙ্গলি- আপনার মতো আর কারা এসেছিল এই অনুষ্ঠানে?
সহিদুল লস্কর- মোট ৩০জনকে ডাকা হয়েছিল মন কি বাত-এর বিশেষ অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার জন্য। ১ জন ছাড়া ২৯ জনকে এসেছিলেন। ৫ জন ছিলেন আমার মতো, যাঁরা কোনও না কোনও ভাবে সমাজের বুকে কিছু কাজ করেছেন। যেমন ছিলেন অসমের রিকশা চালক আহমেদ আলি। যিনি রিকশা চালিয়ে স্কুল তৈরি করেছেন। ছিলেন প্যারা অলিম্পিকে পদক জয়ী জিগর, ম্যাঙ্গালোরের সুরেশ ডাক্তার। যিনি ফুটপাতবাসীদের চিকিৎসা করেন। এছাড়া বাকি ২৪ জন এমন অতিথি ছিলেন যাঁরা মন কি বাত-এ প্রশ্ন পাঠিয়েছিলেন। এদের মধ্যে ১১ বছরের একটি বালকও ছিল। যে প্রধানমন্ত্রীর কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে পায়রাদের জল খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে।
ওয়ানইন্ডিয়া বেঙ্গলি- খাস প্রধানমন্ত্রীর অতিথি, অসামান্য অতিথি আপ্যায়ন, সেভেন স্টার হোটেলে রাত্রি-যাপন! কেমন লাগল এমন জীবন?
সহিদুল লস্কর- এমন এক রাজকীয় আথিয়েতায় মন ভরেনি এটা কখনও বলব না। হোটেলের বিছানায় যখন বসেছিলাম গদিতে প্রায় ঢুকে যাচ্ছিলাম। চারিদিকে কত লোক। প্রত্যেকেরই পরনে দামী-দামী সব পোশাক। ঝকঝকে এক জীবন। যেখান থেকে ভারতবর্ষের গরিবী-র চেহারা-টা-কে আন্দাজ করাটাই কঠিন। অশোকা হোটেলে আমার একটা একটা খাবারের প্লেটে-রই মূল্য ছিল ১২০০ টাকা। ভাবছিলাম এই ১,২০০ টাকা-তে আমার মতো কত মানুষের সারা মাস-টাই চলে যায়। মাঝে মাঝে এমন বৈভব-চাকচিক্য দেখে কষ্ঠ হচ্ছিল। খেয়াল পড়ছিল সেই সব মানুষগুলোর কথা যাঁরা দু'বেলা ঠিক করে পুষ্ঠিকর খাবার খেতে পারেন না, প্রজন্মের পর প্রজন্ম পড়ে থাকে অনুন্নত জীবনের অন্ধকারে। অর্থের অভাবে ঠিক করে শিক্ষার পাঠও নিতে পারেন না। আমাদেরও একটা সময় ঠিক করে খাবার জুটত না। ক্যানসারে আক্রান্ত বোনের চিকিৎসাও করাতে পারিনি অর্থাভাবে। কিন্তু, বৈভব-চাকচিক্য থেকে কিছুটা অর্থ যদি গরিবদের হাতে পৌঁছত তাহলে কত সুবিধাই না হতো! খেতে গিয়ে দেখেছিলাম প্লেটে প্লেটে কত উদ্বুত্ত খাবার। আমাদের দেশে খাবার নাকি বাঁচে না! দু'বেলা খাবার পাওয়া যাঁদের নিশ্চিত তাঁরা যদি সেই মানুষগুলির কথা ভেবে খাবার নষ্ট করার অভ্য়াসটা ত্যাগ করতেন এবং সেই খাবারের অংশ গরীবদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করতেন তাহলে হয়তো অনেক সমস্যা কমে যেত। নিজের মনকেই প্রশ্ন করছিলাম সত্যি কি এত বৈভবের দরকার আছে?
ওয়ানইন্ডিয়া বেঙ্গলি- ১২ কোটি টাকার একটা প্রকল্প তৈরি করে মন কি বাত-এ গিয়েছিলেন, সেটার এবার কী হবে?
সহিদুল লস্কর- জেরিয়াট্রিক রিসার্চ প্রোগ্রাম নিয়ে এই প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়নি তো কী হয়েছে? এতে থেমে গেলে তো হবে না। আমি এগিয়ে যাব। থেমে থাকবো না এইটুকু বলতে পারি। এই মুহূর্তে অসংখ্য মানুষ আমাকে সাহায্য করতে পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন। তাদের সহযোগিতা নিয়েই আমি এগিয়ে চলব। ১২ কোটি টাকার এই প্রকল্পকেও গড়ে তুলব। যাতে পরের বার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হলে যেন তাঁকে বলতে পারি যে প্রকল্প এগিয়ে চলেছে।
ওয়ানইন্ডিয়া বেঙ্গলি- অনুষ্ঠান থেকে বিদায় নেওয়ার সময় কী বললেন সবাইকে?
সহিদুল লস্কর- বহু মানুষ আমার ফোননম্বর নিয়েছেন। আমিও তাঁদের নম্বর নিয়েছিল। প্রসারভারতীর চেয়ারম্যান সূর্যপ্রকাশ, অ্যাঙ্কর নীলম-দের বলেছি বারুইপুরে আমার হাসপাতাল দেখে যেতে। তাঁরা আসবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।
ওয়ানইন্ডিয়া বেঙ্গলি- দিল্লি-কে 'বাই' বলার সঙ্গে আর কী বললেন?
সহিদুল লস্কর- 'বাই' যেমন বলেছি, তেমনি দিল্লি বিমানবন্দরে যেভাবে নিরাপত্তারক্ষীরা আমার অটোগ্রাফ নিলেন তাতে আপ্লুত। বিমানে ওঠেও একটা মজার ঘটনার সাক্ষী হলাম। বিমান টেক অফ করতে ঝলমলে দিল্লির রোশনাই-এ মন ভরে গিয়েছিল। একটু পরে দেখলাম আমার উইন্ডো সিটের উপরে সোনার আলো। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়য়ে দেখি পূর্ণিমার চাঁদের আলো এসে পড়়েছে বিমানের জানলায়। চাঁদের স্নিগ্ধ আলো এমনভাবে কখনও দেখিনি। এর আগে আমার ভাঙা ঘর থেকে চাঁদের আলো দেখেছি। এবার দেখলাম বিমানের জানলা থেকে।
ওয়ানইন্ডিয়া বেঙ্গলি- কলকাতা বিমানবন্দরে আপনাকে নিতে কে এসেছিল?
সহিদুল লস্কর- মধ্যরাতে বিমানবন্দরে আমাকে নিতে এসেছিল স্ত্রী সামিমা। ছিলেন আমার ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট সেলিম লস্কর। এছাড়়াও আমার পরিবারের আরও কিছু সদস্য এবং আমাকে ভালোবাসা কিছু মানুষ।
(আরও পড়ুন-মন কি বাত-এ বারুইপুরের সহিদুল, বাগানের পেয়ারা আর জামরুল উপহার নরেন্দ্র মোদীকে)
ওয়ানইন্ডিয়া বেঙ্গলি- বাড়িতে ঢুকে কী করলেন?
সহিদুল লস্কর- আমি এবং আমার স্ত্রী সামিমা এখন হাসপাতালেরই একটা ঘরে থাকি। কারণ, হাসপাতালের কাজ শেষ হয়নি। নির্মাণকাজ চলছে। নিরাপত্তারক্ষী নেই। আমি আমার স্ত্রী পাহাদার এই নির্মিয়মাণ হাসপাতালের। নতুন আশা, নতুন আলো নিয়ে ফিরলাম আমার স্বপ্নের আঁতুরঘরে। আশা করি নতুন উদ্যোমে আমি এগিয়ে যেতে পারব।
(আরও পড়ুন-নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে লাইভ অনুষ্ঠান, দিল্লি চললেন বারুইপুরের সহিদুল)