অভিভাবকদের 'ব্রেনওয়াশ' কাজে এল না, পড়ুয়া নির্যাতনকাণ্ডে তদন্তের মুখে বরাহনগর স্কুলের প্রধানশিক্ষক
শেষরক্ষা আর হল না। পড়ুয়া নির্যাতনকাণ্ডে নিজের দায় ঢাকতে চেষ্টার কসুর করেননি বরাহনগর শরৎচন্দ্র ধর বিদ্যামন্দিরের প্রধানশিক্ষক মণীশকুমার নেজ।
শেষরক্ষা আর হল না। আপাতত তদন্তের সামনে পড়তে হচ্ছে বরাহনগরের শরৎচন্দ্র ধর বিদ্যামন্দিরের প্রধানশিক্ষককে। পড়ুয়া নির্যাতনকাণ্ডে নিজের দায় ঢাকতে চেষ্টার কসুর করেননি বরাহনগর শরৎচন্দ্র ধর বিদ্যামন্দিরের প্রধানশিক্ষক মণীশকুমার নেজ। ২ অক্টোবর ওয়ানইন্ডিয়া বেঙ্গলি প্রথম সামনে নিয়ে আসে বরাহনগরের শরৎচন্দ্র ধর বিদ্যামন্দিরের প্রাথমিক বিভাগে ক্ষুদে পড়ুয়াদের উপর প্রধানশিক্ষকের নির্যাতনের ভিডিও। যা এই মুহূর্তে সোশ্যালমিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। যে ভিডিও দেখে রাগে-ক্ষোভে সমানে পোস্ট হচ্ছে একের পর এক কমেন্ট। দেড় হাজারের কমেন্টের মধ্যে নব্বই শতাংশ মানুষই বরাহনগরের শরৎচন্দ্র ধর বিদ্যামন্দিরের প্রধানশিক্ষকের কঠোর শাস্তির পক্ষে সওয়াল করেছেন। ইতিমধ্যে এই ভিডিওটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ১১হাজার বার শেয়ার হয়ে গিয়েছে। যারা এই ভিডিওটি দেখেছেন তাঁদের অধিকাংশই কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। ভিডিওটি-র ভিউয়ার্স সংখ্যা সাড়ে চার লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছে।
শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী কোনওভাবেই পড়ুয়াদের কর্পোরাল পানিশমেন্ট এবং বুলিং করা যায় না। কিন্তু, বরাহনগর শরৎচন্দ্র ধর স্কুলের প্রধানশিক্ষক মণীশকুমার নেজ নিজের টেবিলে বসেই ছাত্র-ছাত্রীদের আঙুলে পেন ঢুকিয়ে মুচড়ে দিচ্ছেন। আর যন্ত্রণায় কাঁকিয়ে উঠছে ছোট্ট-ছোট্ট ছেলে-মেয়েরা। অভিযোগ বুধবার রাত থেকেই থেকেই ড্যামেজ কন্ট্রোলে নেমে পড়েন মণীশকুমার নেজ। তিনি দলবল নিয়ে গিয়ে ভিডিও-তে দেখতে পাওয়া পড়ুয়াদের বাড়়ি যান বলে বিশেষ সূত্রে দাবি করা হয়েছে। এইসব পড়ুয়াদের অভিভাবকদের নাকি বোঝানো হয় স্কুলে দুষ্টুমি-র জন্য শাসন করা হয়েছিল। এইসব অভিভাবকদের নাকি পাখি পড়ানোর মতো করেই মিডিয়ার সামনেই প্রধানশিক্ষককে সমর্থন করার কথাও বলে দেওয়া হয়েছিল। এই পরিকল্পনা মোতাবেক বৃহস্পতিবার স্কুলের সামনে বিভিন্ন মিডিয়ার সাংবাদিকদের ডেকে আনা হয় এবং তাঁদের রিপোর্টার ও ক্যামেরার সামনে নিগ্রহের শিকার পড়ুয়াদের অভিভাবকদের শেখানো কথা বলতে বাধ্য করা হয় বলে অভিযোগ। ফলে, অভিভাবকরা প্রধানশিক্ষক এবং তাঁর বাহিনীর একপ্রকার চাপের সামনে নিজেদের সন্তানদের নিগ্রহের ঘটনায় অন্য কথাই বলেন। যে বয়ানে পড়ুয়াদের উপর হওয়া নিগ্রহকে মঞ্জরি দিয়ে দিয়েছেন অভিভাবকদের দল। এতে একজন শিশুর বেঁচে থাকার অধিকারকে খর্ব করা হয়েছে সে জ্ঞানটুকুও অভিভাবকরা বুঝতেই পারেননি বলে অভিযোগ।
এখানেই শেষ নয় এরপর এই অভিভাবকদের সঙ্গে করে নিয়ে বরাহনগর থানায় দরবারও করতে গিয়েছিলেন অভিযুক্ত প্রধানশিক্ষক মণীশকুমার নেজ। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার চক্করে মণীশকুমার নেজ স্কুলের তিন শিক্ষকের সঙ্গে নিগৃহীত পড়ুয়াদের অভিভাবকদের থানায় পাঠান। এই তিন শিক্ষক হলেন অভিক চক্রবর্তী, দুর্গাপাল গুপ্ত ও মৌসুমী মাঝি মল্লিক। বরাহনগর থানায় দুই অভিভাবক এই ঘটনায় প্রধানশিক্ষককে নির্দোষ বলে দুটি আবেদনও জমা করতে চান। কিন্তু, থানা থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয় গণ স্বাক্ষর সম্বলিত আবেদন ছাড়া এই আবেদন গৃহীত হবে না।
অভিযোগ, প্রধানশিক্ষক এরপরও তাঁর অনিয়মের ঠিকাদারি ছাড়েননি। জেলাশাসক অন্তরা আচার্য-র নির্দেশে গোটা ঘটনার তদন্তে নেমেছেন ডিআই অফ স্কুল সঞ্জয়কুমার চট্টোপাধ্যায়। তাঁর নির্দেশে একজন এসআই, এক জন এআই এবং একজন ডিআই অ্যাডমিন বৃহস্পতিবার দুপুরে বরাহনগরের শরৎচন্দ্র ধর বিদ্যামন্দির স্কুলে যান। সেখানে প্রধানশিক্ষক মণীশকুমার নেজের সামনেই বেশকিছু প্রকাশনা সংস্থার বই আটক করা হয়। অভিযোগ, এই বইগুলি কোনওভাবেই সরকারের নয়। বাইরের এইসব প্রকাশনা সংস্থার বই বিক্রি করে অভিযুক্ত প্রধানশিক্ষক মণীশকুমার নেজ অভিভাবকদের কাছ থেকে মোটা অর্থ আদায় করতেন বলে অভিযোগ।
মণীশকুমার নেজ এই তদন্ত দলের সামনে নিগৃহীত পড়ুয়াদের অভিভাবকদের হাজির করেন। বেআইনি ভাবে ওই অভিভাবকদের দিয়ে তদন্তের দলের সামনে মুচলেকা লিখিয়ে নেওয়া হয় বলেও অভিযোগ। এরপর তদন্তকারী দল স্কুলের সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকার সঙ্গেও কথা বলে। রাত পর্যন্ত যা খবর প্রধানশিক্ষক মণীশকুমার নেজ যতই অভিভাবকদের ব্রেন-ওয়াশ করে থাকুন তাতে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত থেমে থাকার সম্ভাবনা কম।
অভিযোগ, গত মে মাসেও এমন অনিয়ম এবং বেআইনি কার্যকলাপের জন্য তদন্তের মুখে পড়েছিলেন প্রধানশিক্ষক মণীশকুমার নেজ। কিন্তু সঠিক প্রমাণের অভাবে ছাড় পেয়ে গিয়েছিলেন এই প্রধানশিক্ষক। এবার তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো হয়ে উঠেছে ভিডিও এভিডেন্স। যাকে কোনওভাবেই অমান্য করা যাচ্ছে না। রাইট টু এডুকেশন অ্যাক্ট এবং শিশু অধিকার রক্ষা আইন যে শরৎচন্দ্র ধর বিদ্যামন্দিরে লঙ্ঘন হয়েছে তার প্রমাণ যথেষ্টই জোরালো। সেই কারণে অভিযুক্ত প্রধানশিক্ষক মণীশকুমার নেজকে আপাতত তদন্ত কমিটির শুনানির সামনে পড়তে হবে বলে বিশেষ সূত্রে খবর।
[আরও পড়ুন:নিয়মকে বুড়ো আঙুল, স্কুলের মধ্যেই বই বিক্রি প্রধানশিক্ষকের, দেখুন ভিডিও]
যে ভাবে দিনের পর দিন একজন 'শিক্ষারত্ন' পাওয়া শিক্ষক শিক্ষার অধিকার আইন-কে তুড়ি মেড়ে উড়িয়ে বাইরের প্রকাশনা সংস্থার বই বিক্রি করছেন, ফ্রি-প্রাইমারি শিক্ষাতেও অর্থ নিয়ে শিশুদের ভর্তি করাচ্ছেন এবং সর্বোপরি পড়ুয়াদের শারীরিকভাবে নিগ্রহ করছেন তাতে প্রবল ক্ষুব্ধ উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক অন্তরা আচার্য। তিনি এই ঘটনায় কড়া অবস্থান নেওয়ার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। আপাতত ডিআই-এর রিপোর্টের অপেক্ষা করছেন তিনি। তদন্তে যাতে কোনওরকম ত্রুটি বিচ্যুতি না হয় তা দেখার জন্যও ডিআই-কে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন বলে সূত্রের খবর।