স্কুলে সবুজ সন্ত্রাস, হেনস্থায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত প্রধানশিক্ষক, দেখুন ভিডিও
স্কুলে এবার সবুজ সন্ত্রাস। রে রে করে স্কুলের মধ্যে ঢুকে পড়ল একদল তৃণমূল কর্মী। আর তারপরই শুরু হয়ে গেল প্রধানশিক্ষককে ধরে হেনস্থা।
স্কুলে এবার সবুজ সন্ত্রাস। রে রে করে স্কুলের মধ্যে ঢুকে পড়ল একদল তৃণমূল কর্মী। আর তারপরই শুরু হয়ে গেল প্রধানশিক্ষককে ধরে হেনস্থা। তৃণমূল কংগ্রেসের দাদা-রা প্রবীণ প্রধানশিক্ষকের প্রায় ঘাড় ধরে প্রতিটি জিনিসের হিসাব নিতে থাকেন। সেই ভিডিও এখন ভাইরাল হয়ে গিয়েছে নেট দুনিয়ায়।
ঘটনাটি নদিয়ার হরিণঘাটার বিরহি -১-এর বেলেডাঙা বাগানেপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৫ সেপ্টেম্বর বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ স্কুলে ঢুকে পড়ে একদল তৃণমূলকর্মী। মুখে মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়ের নামে স্লোগান দিতে দিতে তাঁরা প্রধানশিক্ষককে পাকড়াও করেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেখানে স্কুল পড়ুয়াদের জন্য এত ব্যবস্থা করেছেন সেখানে এই স্কুলের ছেলে-মেয়েরা জুতো পায় না কেন? স্কুল ব্য়াগ নেই কেন? এমনসব প্রশ্ন করতে থাকেন। এখন সিপিএম-এর জামানা নেই। তারপরেও স্কুলে কেন অনুন্নয়ন প্রশ্ন তুলতে থাকেন বহিরাগতদের দল।
প্রবীণ প্রধানশিক্ষককে এরপর হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাওয়া স্কুলের রুমের ভিতরে। একদল আবার ঢুকে পড়ে একটি ঘরে। সেখানে কিছু ছাত্র-ছাত্রী মেঝেতে আসন পেতে ক্লাস করছিল। তাদেরকেও প্রশ্ন করে এই তৃণমূলকর্মীরা। প্রধানশিক্ষক ভালো না খারাপ?মিড ডে মিল রোজ পাওয়া যায় কি না? রোজ ডিম দেওয়া হয় কি না থেকে শুরু করে মাছ-মাংস মিড ডে মিলে জোটে কি না-- এমনসব প্রশ্নও ওইসব তৃণমূলকর্মীরা ছোট-ছোট ছেলে মেয়েদের কাছে জানতে চায়। এই ক্লাসরুমের একদিকেই ছিল মিড ডে মিলের চালের বস্তা। বস্তায় ইঁদুরের ফুটো দেখতে পেয়ে প্রবীণ প্রধানশিক্ষককে চেপে ধরেন তৃণমূলকর্মীরা। কেন এভাবে ইঁদুর বস্তায় ফুটো করবে? সে প্রশ্নও করা হয় প্রধানশিক্ষকে। গোটা ঘটনায় হতচকিত, হতবম্ভ অবস্থা তখন প্রধানশিক্ষকের। এমন প্রশ্নের উত্তরে কী জবাব দেবেন ভেবে পাচ্ছেন না। কারণ, গ্রামবাংলার এইসব স্কুলে মেঠেয়ালি ইঁদুরের উৎপাত প্রবল। এইসব ইঁদুরের হাত থেকে চালের বস্তা রক্ষা করতে গেলে যে পরিকাঠামো থাকা উচিত তা একটা সাধারণ প্রাথমিক বিদ্য়ালয়ের পক্ষে দেওয়াটা সহজ কথা নয়।
এতকিছুর পরও হম্বিতম্ভি থামেনি তৃণমূল মাতব্বরদের। স্কুলের আরও নানান ব্য়বস্থার খামতি নিয়ে প্রশ্ন ছুটে আসতে থাকে। আর সেই সঙ্গে সমানে মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়ের নামে স্লোগান। ওয়ান ইন্ডিয়া বেঙ্গলির তরফে কথা বল হয় প্রধান শিক্ষক নিরঞ্জন মৃধার সঙ্গে। তিনি প্রথমে পুরো ঘটনা নিয়ে কোনও কথা বলতেই রাজি ছিলেন না। পরে যখন তাঁকে জানানো হয় ওয়ান ইন্ডিয়া বেঙ্গলির হাতে গোটা ঘটনার ভিডিও রেকর্ডিং পৌঁছেছে, তখন তিনি মুখ খোলেন। এতবড় একটা ঘটনা ঘটে গেল কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে কেন জানালেন না? প্রশ্নের উত্তরে নিরঞ্জন মৃধা জানান ১৫ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পরের মুহূর্ত থেকেই তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। কি করবেন বুঝতে পারছেন না। বহিরাগত যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা যে তৃণমূলের লোক তা মুখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্লোগান দেওয়া থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু এঁদের কাউকে-ই তিনি চেনেন না বলে দাবি করেন নিরঞ্জন মৃধা।
নিরঞ্জন মৃধা জানিয়েছেন, গত জুলাই মাসে সহকারী শিক্ষকরা স্কুলে বৈদ্যুতিক পাখা লাগানোর দাবি জানান। কিন্তু, তিনি জানান বছরে সবমিলিয়ে তাঁকে স্কুলের রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরীক্ষা পরিচালানোর জন্য ১৫,০০০ টাকা দেয় জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সাংসদ। এর বাইরে অতিরিক্ত কোনও আয় নেই। এই সামান্য অর্থে বৈদ্যুতিক পাখা লাগানো সম্ভব নয়। এসআই লিখিত অনুমতি দিলে তিনি এই ১৫,০০০ টাকা দিয়ে বৈদ্যুতিক পাখা লাগানোর জন্য খরচ করবেন বলেও সহকারী শিক্ষকদের নাকি জানিয়েছিলেন নিরঞ্জন মৃধা। এই স্কুলের নামে স্থায়ী কোনও বৈদ্যুতিক সংযোগ নেই। ফলে নতুন করে বিদ্যুৎ সংযোগ এবং স্কুলের মধ্য়ে ইলেক্ট্রিক ওয়ারিং-এর জন্য ৮০,০০০ টাকাও দরকার ছিল। সবমিলিয়ে এরপর বৈদ্যুতিক পাখার বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল।
এরপর সেপ্টেম্বরে স্কুলের মধ্যে তৃণমূলকর্মীদের এভাবে ঢুকে পড়ার ঘটনা। মিড ডে মিল-এর বিষয়েও নিরঞ্জন মৃধা জানান, মিল প্রতি ৪.১৩ পয়সা বরাদ্দ। এতে রোজ রোজ ডিম বা মাছ-মাংস দেওয়া যায় না। একটা ডিমের দামই ৬টাকা। মাঝে নিজের পকেট কেটে রোজ ডিম এবং মাংস খাইয়েছেন। কিন্তু সে অর্থ তিনি ফেরতই পাননি। ফলে, এখন মিড ডে মিল বাবদ সরকার যে অর্থ দেয় তারমধ্যেই সবকিছু সংস্থানেই তিনি নজর দিয়েছেন বলে ওয়ানইন্ডিয়া বেঙ্গলি-কে জানিয়েছেন নিরঞ্জন মৃধা।
বেলেডাঙা বাগানেপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিষয়টি নিয়ে এই অঞ্চলের স্কুল ইনস্পেক্টর শ্রাবন্তী কর্মকারের সঙ্গেও কথা বলা হয়। ওয়ানইন্ডিয়া বেঙ্গলিকে তিনি জানান, এই নিয়ে কোনও অভিযোগ তাঁর কাছে জমা পড়েনি। তিনি ওয়ানইন্ডিয়া বেঙ্গলির কাছ থেকেই প্রথম বিষয়টি জেনেছেন। সরকারিভাবে অভিযোগ পেলে তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন বলে জানিয়েছেন।
এই ঘটনার তীব্র ভাষায় নিন্দা করেছেন শিক্ষক ঐক্য মুক্ত মঞ্চের মইদুল ইসলাম। তাঁর অভিযোগ, নামখানার চঞ্চলাময়ী বিদ্যাপীঠ থেকে ইসলামপুরের দড়িভিট স্কুল তৃণমূলের জড়িত থাকার ঘটনা সামনে এসেছে। চঞ্চলাময়ীতে স্কুলে ঢুকে শিক্ষকদের মারধর করা হয়েছে। ইসলামপুরেও গণ্ডগোলে গুলি চলেছে। আর এবার তৃণমূল মাতব্বররা স্কুলে ঢুকে প্রধানশিক্ষককে হেনস্থা করা হচ্ছে। সবমহলে এর প্রতিবাদ হওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন মইদুল।
এদিকে, বহিরাগত তৃণমূলকর্মীদের মধ্যে একজনের পরিচয় এখন পর্যন্ত সামনে এসেছে। যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে তাতে লাল গেঞ্জি এবং সানগ্লাস পরিহিত এক যুবককে দেখা গিয়েছে। এনার নাম সুপ্রতিম রায় ওরফে বুবুন। পেশায় আইনজীবী। এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে হরিণঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির ১৪ নম্বর আসনে প্রার্থী হয়েছিলেন।