বোধনের আগেই বিসর্জন! কোন পরিস্থিতিতে বিদায়-বাদ্য বাজালেন মুকুল রায়
সাংগঠনিক ও সংসদীয় সমস্ত পদ কেড়ে নেওয়া হয়েছিল মুকুল রায়ের। স্রেফ সাধারণ সৈনিকে পরিণত হয়েছিলেন দলে। মুকুলের বিসর্জন ছিল স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।
গুরুত্ব হারাতে হারাতে তৃণমূলে একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন মুকুল রায়। একে একে সব পদ খুইয়েছিলেন। দলের সেকেন্ড ইন কম্যান্ড থেকে এক লহমায় বনে গিয়েছিলেন একেবারে সাধারণ একজন সৈনিকে। শেষ কোর কমিটির বৈঠকের পরই তিনি শুধু তৃণমূলের একজন ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ছিলেন। কেড়ে নেওয়া হয়েছিল সাংগঠনিক সর্বভারতীয় সহ সভাপতির পদটুকুও।
[আরও পড়ুন:২ বছরেও জোড়া লাগল না ভাঙা সম্পর্ক, মুকুলের দলত্যাগের নেপথ্যে কি বিজেপি ]
তাই
মুকুলের
বিসর্জন
ছিল
স্রেফ
সময়ের
অপেক্ষা।
মা
দুর্গার
বোধনের
আগেই
মহাপঞ্চমীতে
মুকুল
রায়
ঘোষণা
করে
দিলেন
তিনি
তৃণমূল
ছাড়ছেন।
পুজোর
পরই
তিনি
রাজ্যসভার
সাংসদ-সহ
সমস্ত
পদ
থেকে
ইস্তফা
দেবেন।
কিন্তু
কীভাবে
দলের
দ্বিতীয়
প্রভাবশালী
ব্যক্তির
এই
হাল
হল?
কোন
অবস্থার
মধ্য
দিয়ে
তিনি
নিজেকে
সরিয়ে
নিতে
বাধ্য
হলেন।
ফিরে
দেখা
বাংলা
ওয়ান
ইন্ডিয়ায়।
২১ জুলাই : একুশের মঞ্চেই দলে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাঁর উপস্থিতি সত্ত্বেও তিনি যেভাবে অপমানিত হয়েছিলেন, তাতে তাঁর তৃণমূল ত্যাগ ছিল স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। যাঁকে হাতে ধরে তিনি রাজনীতির পাঠ দিয়েছিলেন, তাঁর কাছেই তিনি পদ খুইয়ে গুরুত্ব হারিয়ে ছিলেন। এমনকী মঞ্চে রাজনৈতিক গুরুর উপস্থিতি সত্ত্বেও একটিবারের জন্যও তাঁর নাম মুখে আনেননি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাঁর নাম উচ্চারণ করেছিলেন ১০-১২ জনের পরে। সেই থেকেই জল্পনা শুরু।
১ আগস্ট : কমিশন গেটে কেলেঙ্কারির কালি লাগল অভিযেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গায়ে। তৃণমূলের একাংশের মতে, এর পিছনে ছিলেন মুকুল রায়ই। তাঁর অঙ্গুলিহেলনেই আট বছর পর ফের অভিষেকের বিরুদ্ধে কমিশন গেট কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠে। এতে তৃণমূল কংগ্রেস নতুন করে অস্বস্তিতে পড়ে। আর তৃণমূল তথা তৃণমূলের নতুন মুখকে সমস্যায় ফেলতেই যে এই পুরনো অভিযোগের উত্থাপন করা হয়েছে তা পরিষ্কার হয়ে যায়। আর এর পিছনে মুকুল রায়ের কারসাজি রয়েছে বলে মনে করে তৃণমূলের একাংশ।
২ আগস্ট : তাঁর দলবদল নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে ওঠে। তিনি নতুন দল গড়ছেন বলে খবর রটে যায়। শীঘ্রই তাঁর নেতৃত্বে পথ চলা শুরু করছে নতুন দল জাতীয়তাবাদী তৃণমূল কংগ্রেস। তিনি এই দলের রেজিস্ট্রেশন আগেই করে রেখেছিলেন। সেই সারদা কালি লাগার সময় থেকেই তিনি তাঁর তৃণমূল ছাড়ার পথ পরিস্কার করে রেখেছিলেন নিজেই। সেই পথে হেঁটেই এবার নয়া দল গড়ার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন মুকুল রায়।
৪ আগস্ট : বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের মন্তব্যে নয়া জল্পনার সূত্রপাত। এখনই নতুন দল না করে বিজেপিতে যেতে পারেন তিনি। মুকুলের বিজেপিতে যাওয়ার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন স্বয়ং দিলীপ ঘোষ। তিনি বলেন, শুধু মুকুল রায়ই নন, তৃণমূলের অনেকেই লাইন দিয়ে আছেন বিজেপিতে নাম লেখানোর জন্য। স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। তারপরই বিজেপিতে আসার লাইন পড়ে যাবে তৃণমূল ছেড়ে।
৫ আগস্ট : এরই মধ্যে মুকুল রায় দিল্লিতে গিয়ে কেন্দ্রীয়মন্ত্রী অরুণ জেটলির সঙ্গে দেখা করেছেন বলে জানা যায়। তাঁদের মধ্যে গোপন আলোচনা হয়েছে। তাতে মুকুলবাবুর বিজেপিতে যাওয়ার রটনা আরও জোরদার হয়। যদিও মুকুল রায় তাঁর বিজেপিতে যাওয়ার বিষয়টি এড়িয়ে যান। তিনি প্রথমবার মুখ খুলে বলেন, আমি তৃণমূলের একজন সৈনিক। আমি তৃণমূলেই আছি।
৭ আগস্ট : মুকুল রায়কে নিয়ে বার্তা দেন দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তিনি মুকুলের নাম না করেই বুঝিয়ে দেন, দলে একদা সেকেন্ড ইন কম্যান্ডের অবস্থান ঠিক কোথায়। পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, তৃণমূল কংগ্রেসই শেষ কথা। তাঁর কোনও বিকল্প নেই। রাজ্যবাসী একমাত্র তাঁর উপই ভরসা রাখেন। তাঁর এই কথা কোন প্রেক্ষিতে তা নিয়েই নয়া জল্পনার সূত্রপাত।
১৫ আগস্ট : মুকুল রায়ের সঙ্গে আরএসএসের বৈঠক নিয়ে জল্পনা তৈরি হয়। মুকুল রায় ঘনিষ্ঠ বাবান ঘোষের বিজেপিতে যোগদানের পর তাঁর এই বৈঠক যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেছিল রাজনৈতিক মহল। তাঁর বিজেপি যোগের সম্ভাবনা আরও বাড়িয়ে দেয় এই বৈঠক।
৩০ আগস্ট : পদ খোয়ালেন মুকুল রায়। তাঁকে পরিবহণ, পর্যটন ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন রাজ্যসভার তৃণমূলের দলনেতা ডেরেক ওব্রায়েন। রাজ্যসভার অধ্যক্ষ বেঙ্কাইয়া নাইডুকে তা চিঠি দিয়ে তৃণমূলের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়। ফলে রাজ্যসভাতেও গুরুত্ব হারাতে শুরু করেন মুকুল রায়।
৪ সেপ্টেম্বর : সংসদীয় কমিটির আরও একটি পদ থেকে অপসারিত তৃণমূল সাংসদ মুকুল রায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের স্থায়ী কমিটি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। মুকুল রায়ের জায়গায় মনীশ গুপ্তের নাম তৃণমূলের তরফে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের স্থায়ী কমিটিতে আনে তৃণমূল।
৯ সেপ্টেম্বর : তৃমমূলের কোর কমিটির বৈঠকে মুকুল রায়ের উপস্থিতিতেই দলনেত্রী মমতা বার্তা। যাঁরা বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছেন তাঁদের দরজা দেখিয়ে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বলেন, বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছেন যাঁরা তাঁদের তৃণমূলে দরকার নেই বলে সাফ জানিয়ে দেন তিনি। পরোক্ষে মুকুল রায়কেই এই বার্তা।
১৬ সেপ্টেম্বর : দলের সেকেন্ড ইন কম্যান্ড থেকে একেবারে মাটিতে নামিয়ে আনা হল মুকুল রায়কে। তৃণমূল কংগ্রেসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরে যাঁর নাম উচ্চারিত হত, সেই মুকুল রায় পরিণত হলেন একেবারে সাধারণ সৈনিকে। দল থেকে তুলে দেওয়া হল সহ সভাপতি পদ। তাই স্বাভাবিক নিয়মেই পদ খুইয়ে সাধারণ সদস্য বনে গেলেন মুকুল রায়। নির্বাচন কমিশনে ২১ জন পদাধিকারীর যে তালিকা পেশ করা হয় দলের পক্ষ থেকে, তাতে নাম নেই মুকুল রায়ের। উধাও সহ সভাপতি পদটিই।
১৮ সেপ্টেম্বর : তৃণমূল ভবনের ডাক সত্ত্বেও তিনি এড়িয়ে গেলেন। তৃণমূল ভবনের বিশ্বকর্মা পুজোয় তিনি গেলেন না। তাঁর অনুপস্থিতি ফের প্রশ্ন তুলে দিল- তৃণমূলের সঙ্গে কি সম্পর্ক ছিন্ন করতে শুরু করে দিলেন মুকুল রায়? ওইদিন তৃণমূলের একদা সেকেন্ড ইন কম্যান্ড ছিলেন তৃণমূল ভবন থেক ছিল ছোড়া দূরত্বে একটি রিসর্টে। তারপর তিনি দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান।
২০ সেপ্টেম্বর : সম্মান বজায় রাখতে জেড ক্যাটাগরির নিরাপত্তা নিজে থেকেই ছেড়ে দিলেন একদা তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কম্যান্ড মকুল রায়। এর ফলে তাঁর সঙ্গে তৃণমূলের দূরত্ব আরও বেড়ে যায়। রাজনৈতিক মহলের ব্যাখ্যা, তাঁর নিরাপত্তা তুলে নেওয়ার আগেই তা ছেড়ে দিয়ে মোক্ষম চাল দিলেন মুকুল রায়। একদিকে যেমন তিনি নিজের সম্মান বজায় রাখলেন, তেমনই তৃণমূলকে বার্তাও দেন তিনি।
২২ সেপ্টেম্বর : মুকুল রায়ের সঙ্গে তৃণমূলের সম্পর্কের ফাটল আরও চওড়া হল। সরাসরি মুকুল রায়কে বার্তা দিলেন দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ফের একবার তাঁকে সাবধান করে দিলেন বিজেপি-র সঙ্গ নিয়ে। মুকুল রায়ের গতিবিধি আতস কাঁচের তলায় রাখা হয়েছে বলে মন্তব্য করে পার্থবাবুর সাফ জবাব, 'সীমা ছাড়ালে দল বাধ্য হবে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে।'
২৪ সেপ্টেম্বর : মুকুলের দিল্লি যাত্রা নিয়ে জল্পনা চলছিলই। তিনি কেন ঘনঘন দিল্লি যাচ্ছেন? বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে সেটিং করতেই কি তাঁর দিল্লি গমন। নাকি নতুন দল গঠনের বিষয়টি পাকাপোক্ত করাই তাঁর লক্ষ্য? মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে যায় তৃণমূল ছাড়ছেনই তিনি। এদিকে দিল্লি থেকে ফিরেই তৃণমূলের সাসপেন্ডেড সাংসদ কুণাল ঘোষের পুজো উদ্বোধনে দেখা যায় তাঁকে। ফলে তৃণমূল ছাড়ার জল্পনা আরও চূড়ান্ত হয়ে যায়।
২৫ সেপ্টেম্বর : দুর্গা পঞ্চমীর দিনেই কিছু একটা ঘটতে চলেছে সকাল থেকেই আভাস পাওয়া গিয়েছিল। বেলা বাড়তেই সাংবাদিক বৈঠক ডেকে মুকুল রায় জানিয়ে দিলেন তিনি তৃণমূল ছাড়ছেন। তবে কোথায় যাচ্ছেন তা তিনি স্পষ্ট করেননি। সেইসঙ্গে কেন তিনি তৃণমূলে ২০ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করলেন, তা পুজোর পরে জানাবেন বলে মন্তব্য করেছেন মুকুলবাবু।