দুর্নীতি, কেলেঙ্কারি, পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ সত্ত্বেও ভোট সমীক্ষায় কেন তৃণমূলের জয়জয়কার?
কলকাতা, ১৪ এপ্রিল : পুরভোটের আরমাত্র কয়েকদিন বাকি। জোরকদমে চলছে পুরভোটের প্রচারও। এরই মধ্যে বিভিন্ন সংস্থা পুরভোটের ফল নিয়ে সমীক্ষা শুরু করে দিয়েছে। মার্চ মাসে এবিপি আনন্দ-এসি নিয়েলসেন যৌথভাবে যে ভোটসমীক্ষা চালিয়েছিল তাতেই স্পষ্ট হয়ে গিয়ছিল বিজেপি পুরভোটে খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না। পুরভোটের মাত্র কয়েকদিন আগে আরও একবার সমীক্ষা চালাল এবিপি আনন্দ-এসি নিয়েলসেন। দ্বিতীয় সমীক্ষায় তো বিজেপির অবস্থা আরও শোচনীয়।[কলকাতা পুরসভা নির্বাচনে ভোট বাড়তে পারে তৃণমূলের, বলছে সমীক্ষা]
সমীক্ষায় মার্চ মাসে বলা হয়েছিল ১০১টি ওয়ার্ডে জিতে ক্ষমতায় আসতে পারে তৃণমূল। তবে চূড়ান্ত সমীক্ষায় তা বেড়ে হয়েছে ১০৩টি ওয়ার্ড। বিজেপির ক্ষেত্রে যেখানে বলা হয়েছিল ৮টি আসনে জিততে চলেছে বিজেপি, সেখানে এবারের সমীক্ষায় তা আরও কমে মাত্র ৬টি ওয়ার্ড হতে পারে। তবে সুখবর বামফ্রন্টের জন্য। বলা হয়েছিল বামফ্রন্টের আসন সংখ্যা ৩২ থেকে কম ২৫ হতে পারে বলে সমীক্ষায় উঠে এসেছে। তবে বামফ্রন্টের একমাত্র স্বস্তি লোকসভা ভোটে যেখানে তৃতীয় স্থানে ২৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল বামেরা, তা কিছুটা হলেও বাড়বে পুরভোটে। সেই সংখ্যা আরও বেড়ে ৩১ ওয়ার্ড দখলে সিপিএম আনতে চলেছে বলে উঠে এসেছে চূড়ান্ত সমীক্ষায়।

কিন্তু, সারদা, রোজভ্যালি, খাগড়াগড়ের মতো ইস্যু থাকা সত্ত্বেও তৃণমূলের ভোট কীকরে অটুট থাকছে সে প্রশ্ন উঠছেই। এর পিছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। [কলকাতা পুর নির্বাচনে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা তৃণমূল কংগ্রেসের, মেয়র পদপ্রার্থী সেই শোভনই]
১.মূল লড়াই যেন দ্বিতীয় স্থানের জন্য
লোকসভা ভোটে উল্লেখযোগ্য ফল করে সবাইকে চমকে দিয়েছিল বিজেপি। তারপর মোদী হাওয়ায় ভর করে তরতরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। অন্যদিকে ২০১১ সালের পর থেকেই সিপিএমের রেখাচিত্র ক্রমশই নিম্নমুখী হতে শুরু করে।
কিন্তু বিজেপির জনপ্রিয়তা পড়তে শুরু করেছে যে তা বোঝা যাচ্ছে সমীক্ষাগুলির ফলেই। আর তার মূল কারণ সংগঠনের অভাব। আর তারই ফায়দা পাচ্ছে সিপিএম। বিজেপির অধঃপতনে ধীরে ধীরে উঠে আসছে সিপিএম। কিন্তু সিপিএম এখনও তাদের সম্পূর্ণ শক্তি ফিরে পায়নি, ফলে মুখে যাই বলুক না কেন তাদের কাছেও স্পষ্ট আপাতত ১ নম্বরে ওঠা হচ্ছে না। ফলে তাদের প্রধান লড়াইটা এখন বিজেপিরই সঙ্গে, দ্বিতীয় স্থানে থাকার জন্য।
অন্যদিকে আচমকা রাজ্যে বিজেপি উঠে এলেও বিজেপির সেই জনপ্রিয়তা ছিল ক্ষণস্থায়ী তার ফল উপনির্বাচনেও দেখা গিয়েছে। ফলে আপাতত বিজেপিও বুঝতে পারছে সংগঠনের অভাবে এখনও ভোট যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নয় তারা। বিশেষত তৃণমূলের শক্তিশালী দূর্গকে টলানোর ক্ষমতা তাদের এই মুহূর্তে নেই। রাজ্যে কংগ্রেসের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। ফলে বিজেপিরও লক্ষ্য এখন কোনও মতে সিপিএমকে হঠিয়ে দ্বিতীয় স্থানে থাকা।
২. শুধু সারদা বা রোজভ্যালিকে হাতিয়ার বানানোটা ভুল সিদ্ধান্ত
মানুষ যখন মতদান করে তখন তাদের মূল লক্ষ্য থাকে উন্নয়ন। যাকে ভোট দেব সে জিতলে আমাদের উন্নয়নের জন্য কী করবে। আর এই উন্নয়নের বার্তা পুরপ্রচারে অনুপস্থিত।
বিরোধীরা শুধুমাত্র তৃণমূলের গলদ ধরতে উঠে পড়ে লেগেছে। সারদা, রোজভ্যালিকে হাতিয়ার করে তৃণমূলের বিরোধিতায় সরব হয়েছে, এই কেলেঙ্কারির দোহাই দিয়ে তৃণমূলকে কেন ভোট দেওয়া উচিত নয় তা জনসমক্ষে এনেছে। কিন্তু ভোটে জিতলে তারা কী কী উন্নয়নমূলক বা গঠনমূলক কাজ মানুষের জন্য করবেন সে বিষয়ে কোনও নেতার মুখ থেকেই সেভাবে কিছু শোনা যায়নি। ফলে সেদিক থেকে বেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে বিরোধীরা।
৩. তারকা মুখ দিয়ে মানুষ ভোলাতে চেষ্টা করলেও খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি বিজেপি
বিজেপি রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, জর্জ বেকার, লকেট চট্টোপাধ্যায়, নিমু ভৌমিক, পি সি সরকারের মতো চেনা মুখ আনলেও তারা সেভাবে মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারেননি। বিজেপি দলে লোক টানতে ব্যস্ত হয়েছে, কিন্তু তাদের কাজে লাগাত পারেনি। প্রচারের ক্ষেত্রে প্রচন্ড বিভ্রান্ত বিজেপি। [বঙ্গে রূপা গঙ্গোপাধ্যায় বিজেপির বড় ভুল! কিরণ বেদীর পরও শিক্ষা হয়নি ওদের?]
সে অর্থে বড় কোনও চেনা মুখ দলে টানতে ব্যর্থ হয়েছে বিজেপি। টলি পাড়ার অধিকাংশই তৃণমূল শিবির ঘণিষ্ঠ। তাছাড়া গ্রামাঞ্চলে তারকাপ্রীতির জের ভোট বাক্সে পড়লেও কলকাতার বুকে তারকা প্রার্থী আনলেও শুধু চেনা মুখ দেখিয়ে ভোট পাওয়াটা কষ্টকর হবে। এদিকে রূপা গঙ্গোপাধ্যায়কে বিজেপি প্রচারের মুখ করতে চাইলেন শেষ মুহূর্তে গণ্ডগোলের জেরে দিশেহারা বিজেপি।
৪. তৃণমূলকে আটকাতে বিরোধীদের জোটের অভাব
বামেদের ৩৪ বছরের রাজত্ব যখন ভেঙেছিল তৃণমূল কংগ্রেস, তখন তাদের জোট ছিল কংগ্রেসের সঙ্গে। ফলে বামপন্থী বিরোধী ভোটটা পড়েছে এক জায়গাতেই।
কিন্তু তৃণমূলের বিরুদ্ধে কোনও বিরোধী জোট নেই। ফলে তৃণমূল বিরোধী ভোটটা ভাগাভাগি হয়ে যাচ্ছে। যার সুবিধে পাচ্ছে শাসকদল। তৃণমূলকে আটকাতে গেলে রাজ্যে তৃণমূল বিরোধী জোট গঠন করা গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।