সম্পর্কের পূর্ণতায় যৌনতাই কি শেষকথা? কয়েক শ'বছরের বিতর্ক ফের উস্কে দিল সোনারপুর হত্যাকাণ্ড
পুরুষ-নারীর সম্পর্ককে পূর্ণতা দিতে যৌনতার অবদান কতটা? এই নিয়ে কয়েক শ'বছর ধরে চলে আসছে তর্ক-বিতর্ক।
পুরুষ-নারীর সম্পর্ককে পূর্ণতা দিতে যৌনতার অবদান কতটা? এই নিয়ে কয়েক শ'বছর ধরে চলে আসছে তর্ক-বিতর্ক। মহাকাব্য থেকে শুরু করে সাহিত্য, সিনেমা- কোথায় স্থান পায়নি এই বিতর্ক! এক এক জন এক এক ভাবে এর ব্যাখ্যা করেছেন। 'পুতুল নাচের ইতিকথা'-র নায়িকা কুসুম ও শশী ডাক্তারের এই কথোপকথন তো বিখ্যাত। 'কুসুম নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল-আপনার কাছে দাঁড়ালে আমার শরীর এমন করে কেন ছোটবাবু? জবাবে শশী ডাক্তার বললেন, শরীর! শরীর! তোমার মন নেই কুসুম?'
সম্পর্কের বন্ধনে এই শরীরী নেশায় বারবার জড়িয়েছে নারী ও পুরুষ। সে বিবাহিত হোক বা অবিবাহিত- একদল মানুষ আজও শরীরী টানে বারবার সমাজের বেঁধে গণ্ডীকেও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে কসুর করেন না। আর এই শরীরী টানের চোরাবালিতে ঘটে যায় বড় বড় ঘটনা। যার এক ভয়ঙ্কর প্রতিফলন দেখা গিয়েছিল বারাসতের 'মনুয়াকাণ্ড'। তেমনই এক ঘটনার এবার নির্দশন মিলল সোনারপুরে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনে কাজ করা মধুমিতা মিস্ত্রীর সঙ্গে প্রায়ই চোখাচোখি হত সোনারপুর স্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে কাগজ বিক্রেতা চন্দন মন্ডলের। 'আখো-হি আখো মে ইসারা'য় মধুমিতা ও চন্দনের সম্পর্ক দানা বাঁধতে সময় লাগেনি। স্বামী সমীর মিস্ত্রীর পক্ষে তাকে যৌনসুখ দেওয়াটা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল বলেই পুলিশকে জানিয়েছে মধুমিতা। স্বামী-স্ত্রী-র শরীরী সুখের এই শীথিলতা চন্দনের দিকে মধুমিতাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল বলেই মনে করছেন পুলিশের তদন্তকারী অফিসাররা।
পুলিশের দাবি, মধুমিতা এও জানিয়েছে যে বারুইপুরে চন্দনের ফ্ল্যাটেও দু'বছরের বেশি সময় ধরে তারা উদ্দাম শারীরিক সম্পর্কে মেতেছিল। শরীরী সুখের এই উদ্দামতায় নাকি ঘোর লেগে গিয়েছিল চন্দনেরও। সে বারবারই চাপ দিচ্ছিল মধুমিতাকে যাতে সে সমীরকে ছেড়ে দেয়। মধুমিতার সঙ্গে যে পরপুরুষ চন্দনের সম্পর্ক আছে তাও জেনে ফেলেছিলেন সমীর। পেশায় ট্যাক্সিচালক এবং ডাকসাইটে স্থানীয় আইএনটিটিইউসি নেতা বলে পরিচিত সমীর অনেকটা ধমক আর হুমকি দিয়েই তাকে আটকে রেখেছিল বলে পুলিশকে নাকি জেরায় জানিয়েছে মধুমিতা। সমীরের চাপের সঙ্গে সঙ্গে ছিল সন্তানদের টানও। ফলে চন্দনের কাছ থেকে হাজারো চাপ সত্ত্বেও সমীরের ঘরসংসার ছাড়তে পারেছিলেন না মধুমিতা। তার আরও এক স্থীর বিশ্বাস ছিল সমীর যতদিন বেঁচে আছে ততদিন চন্দনের সঙ্গে ঘর বাঁধার স্বপ্ন অসম্ভব।
প্রেমিক চন্দনকে নাকি এই কথা জানিয়েও দিয়েছিল মধুমিতা। এরপর থেকেই বেপরোয়া হয়ে ওঠে চন্দন। সমীরকে পৃথিবী থেকে সরানোর ষড়যন্ত্র ছকতে থাকে। এই কাজে সে রাজিও করিয়ে ফেলেছিল মধুমিতাকে। কিন্তু, সমীরের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ চেয়ে মামলা করা মধুমিতা তাহলে খুনের পথ ধরল কেন? অন্যদিকে চন্দনও বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা করেছিল। সুতরাং, বিবাহ বিচ্ছেদ হলেই মধুমিতা ও চন্দনের বিবাহে কোনও বাধা থাকত না।
পুলিশ সূত্রে খবর, মধুমিতা আশঙ্কা করেছিল যে, বিবাহ বিচ্ছেদ হলেও সন্তানের অধিকার সে পেত না। কারণ, সমীরের হাতে এমনকিছু প্রমাণ ছিল যা দিয়ে তিনি মধুমিতাকে খুব সহজেই সন্তানের হেফাজত পাওয়াটা রুখে দিতে পারতেন। এই জন্য কি সমীরকে খুনের ষড়যন্ত্রকে কার্যকর করা? এই বিষয়ে পুলিশ এখন কিছু নিশ্চিত করেনি।
ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে খুব সহজেই সমীরকে গুলি করে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছিল চন্দন। আইপিএল-এর ম্যাচ চলায় লোকজনও টিভি দেখতে ব্যস্ত ছিলেন। তারমধ্যে ঘড়ির কাঁটা রাত ১০টা পার করায় কেউই সেভাবে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে বাইরের রাস্তার কারোর দৌড়ে পালানোর শব্দটা টের পায়নি। এমনকী, সমীরের বাড়ির মালিকও প্রথমে গুলির শব্দকে গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে যাওয়ার শব্দ বলে ভুল করেছিলেন।
বাড়ির মালিকের কথায়, তাঁরা যখন ছুটে আসেন দেখেন সমীরকে জড়িয়ে ধরে রয়েছেন মধুমিতা। সমীরের পিঠ দিয়ে রক্ত ঝরছে। তার উপরে গামছা চাপা দিয়ে সমানে কেঁদে চলেছে মধুমিতা। পুলিশ জানিয়েছে, পরিকল্পনা মতোই সমীর ফিরতে বারান্দা থেকে ঘরে যাওয়ার রাস্তার কাঠের দরজা হাট করে খোলা রেখেছিল মধুমিতা। এমনকী অন্যদিন দরজা খোলা থাকলেও পর্দা টানা থাকত। ৯ এপ্রিল রাতে দরজা পর্দাটাও একদিকে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। দরজার মুখেই রাস্তার দিকে পিছন ফিরে টিভি দেখতে দেখতে মেঝেতে বসে রাতের খাবার খাচ্ছিলেন সমীর। আর সেই সময়ই সোনারপুরের নোয়াপাড়া ঢোকে চন্দন। সমীরদের বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে পিস্তল ঢুকিয়ে সমীরের পিঠে গুলি দেগে দিতে কোনও অসুবিধা হয়নি চন্দনের।
এই পিস্তল কোথায় পেয়েছিল চন্দন? তাকে জেরার করার মাধ্যমে তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছে পুলিশ। তদন্তকারী পুলিশ অফিসারদের কারোর কারোর মতে, ভালবাসার এক অবশেসন তাড়া করছিল চন্দন ও মধুমিতাকে। আর তারই পরিণতি এই খুন। তবে, সমীরের খুনের পর যেভাবে মধুমিতা কান্না-কাটি করছিলেন তাতে ঘূণাক্ষরেও টের পাওয়া যায়নি যে আসল খুনি ঘরের মধ্যেই রয়েছে। পাকা অপরাধীর মতোই মধুমিতা আচরণ করেছিলেন বলে মনে করছে পুলিশ।