মে মাস এলেই ঘূর্ণিঝড়ের অশনি সংকেত মেলে, আম্ফানের স্মৃতি উসকে দেয় আবহাওয়া পরিস্থিতি
মে মাস এলেই ঘূর্ণিঝড়ের অশনি সংকেত মেলে, আম্ফানের স্মৃতি উসকে দেয় আবহাওয়া পরিস্থিতি
মে মাস মানেই দাবদাহ। মে মাস মানেই আবহাওয়া দফতরের ঘূর্ণিঝড়ে সতর্কতা। আন্দামান ও বঙ্গোপসাগর ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাসের সঙ্গে সঙ্গেই আম্ফানের স্মৃতি উসকে উঠেছে। ঘূর্ণিঝড়ের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে বাংলার উপকূলবর্তী জেলাগুলিতে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস আন্দামান সাগরে তৈরি হওয়া ঘূর্ণাবর্তটি নিম্নচাপ থেকে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হওয়ার পর রূপান্তরিত হতে পারে ঘূর্ণিঝড়ে। মে মাসে ফের একবার ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে বঙ্গোপসাগর ও সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা।
আম্ফানের থেকেও বিধ্বংসী! আতঙ্ক ঘূর্ণিঝড়ের
এখনও ঘূর্ণিঝড় সাগরের বুকে বাসা বাঁধলেই আম্ফান আতঙ্ক তাড়া করে বেড়ায় বাংলার উপকূলে। এবারও তার অন্যথা হল না। কিন্তু কতটা ভয়ঙ্কর হবে এবারের ঝড়? নেটদুনিয়া তোলপাড় হয়ে উঠেছে মে মাসের শুরুতে আন্দামান সাগরে ঘূর্ণাবর্ত বাসা বাঁধায়। এটি ঝড়ে পরিণত হলে তা আম্ফান বা আম্ফানের থেকেও বিধ্বংসী রূপ নেয় কি না আবহাওয়া দফতর জানাবে ৪৮ ঘণ্টা পর।
২০২০ ও ২০২১ সালে আম্ফান ও ইয়াসের তাণ্ডব
গত দু'বছর ধরে মে মাস বিধ্বংসী রূপ নিয়েছে। ২০২০ সালে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান এবং ২০২১ সালে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে বিধ্বস্ত হয়েছে বাংলার উপকূল। এবার ২০২২ সালেও উপকূল কাঁপাতে গভীর নিম্নচাপ বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের চেহারা নিতে পারে বলে ইন্ডিয়া মেটিওরোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট বা আইএমডি পূর্বাভাসে জানিয়েছে। আইএমডি বঙ্গোপসাগরে আরও একটি নিম্নচাপের তীব্রতা সম্পর্কে সতর্ক করেছে সম্প্রতি।
আগামী পাঁচ দিন বঙ্গোপসাগরে না যাওয়ার পরামর্শ
ইতিমধ্যেই আন্দামান সাগরে তৈরি হয়েছে ঘূর্ণাবর্ত। দক্ষিণ আন্দামান সাগরে অবস্থিত ঘূর্ণাবর্ত নিম্নচাপে পরিণত হয়ে নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ভারী বৃষ্টিপাত ঘটাচ্ছে। তা তীব্র হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আইএমডি জানিয়েছে নিম্নচাপটি পরবর্তী ৪৮ ঘন্টার মধ্যে উত্তর-পশ্চিম দিকে সরে যেতে শুরু করবে। এ জন্য মৎস্যজীবীদের আগামী পাঁচ দিন বঙ্গোপসাগরে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে আইএমডি।
কোথায় কী সতর্কতা জারি করল আবহাওয়া দফতর
আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, এটি ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নিলে ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম, উত্তর-পূর্ব, বিহার এবং ঝাড়খণ্ডে ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটার বেগে ঝড় ও ঝোড়ো বাতাস বইবে। সেইসঙ্গে বজ্র-বিদ্যুৎসহ বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, পুদুচেরি এবং কেরালায় ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। ওড়িশা ইতিমধ্যেই একটি ঘূর্ণিঝড়ের জন্য সতর্কতা জারি করেছে। উপকূলীয় জেলা প্রশাসনকে যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়ের মে মাস সংযোগে ভাবনা বেড়েছে জনমানসে
সবথেকে ভাবাচ্ছে এই ঘূর্ণিঝড়ের মে মাস সংযোগ। গত কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরে বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড়ের জন্য মে মাস হল মোক্ষম সময়। ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ২০২১ সালে ১৫৫ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায় ওড়িশা উপকূলে আঘাত হেনেছিল। তার জেরে বাংলার উপকূলও ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ফুঁসে ওঠা সমুদ্র। আর ২০২০ সালে পশ্চিমবঙ্গে ১৮৫ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায় আছড়ে পড়েছিল আম্ফান, যা উপকূলবর্তী সুন্দরবন এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল।
২০১৯ থেকে পর পর তিনবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি
শুধু ২০২০ বা ২০২১-ই নয়, ২০১৯ সালের মে মাসেও ঘূর্ণিঝড় ফণী ২০৫ কিলোমিটার গতিতে ওড়িশা উপকূলে আঘাত হানে। তার আগে ২০১৩ সালে ভায়ারু, ২০১৬ সালে রোয়ানু এবং ২০১৭ সালে মোরা আছড়ে পড়েছিল এই মে মাসেই। বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড়গুলি আগাত করেছিল বাংলাদেশ উপকূলে।
কেন বারবার মে মাসেই ঘূর্ণিঝড়ের হানা উপকূলে
কিন্তু এর কারণ কী? কেন বারবার মে মাসেই সাগরকে উত্তাল করে ঘূর্ণিঝড় হাজির হয় উপকূলে? তছনছ করে দেয় একটার পর একটা উপকূল? আবহবিজ্ঞানীরা বলেন, মে মাসের তাপ বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের বিকাশের জন্য অনুকূল। এই মে মাসে সমুদ্রের তাপমাত্রা ঘূর্ণিঝড়ের পক্ষে অনুকূল পরিসর আরও বাড়িয়ে দেয়। এই কারণেই ঘূর্ণিঝড় বেশি আছড়ে পড়ে মে মাসে। এই একই কারণেই ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদ ২০২১ সালের ডিসেম্বরে উপকূলের কাছাকাছি এসেও আছড়ে পড়েনি, শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল।
ভারত মহাসাগরের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের সময়
আবহবিদদের মতে, বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগর-সহ ভারত মহাসাগরের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় তৈরির মোক্ষম সময় হল মে ও নভেম্বর মাস। সাধারণ দুটি পর্যায়ে বাংলা তথা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলির উপকূলবর্তী এলাকায় ধেয়ে আসে ঘূর্ণিঝড়। ঝড় ধেয়ে আসার একটা সময় হল মার্চ থেকে মে। আর একটি সময় হল বর্ষা পরবর্তী অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর। আর এর মধ্যে ঘূর্ণিঝড় তৈরি হওয়ার সবথেকে মোক্ষম সময় হল মে ও নভেম্বর।
মে মাসে যখন বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ তৈরি হয়!
আইএমডির ডিজি মুত্যুঞ্জয় মুখপাত্র জানিয়েছেন, মে মাসে যখন বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ তৈরি হয়, তখন তা ঘণীভূত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এখনও পর্যন্ত এ নিয়ে কোনও পূর্বাভাস নেই। আগামী ৬ মে দক্ষিণ আন্দামান সাগর এবং সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে ঘূর্ণাবর্তটি। এখন দেখার আগামী ৪৮ ঘণ্টায় এই সিস্টেমটি কী রূপ নেয়। তার উপর নির্ভর করবে পুরো পরিস্থিতি।
আম্ফানের মতো সাংঘাতিক রূপ নেবে, আতঙ্ক!
আবহবিদরা জানিয়েছেন, মার্চ মাসে দুটি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছিল বঙ্গোপসাগরে। কিন্তু পরিস্থিতি প্রতিকূল থাকায় তা সমুদ্রেই শক্তি হারিয়ে ফেলে। উপকূল পর্যন্ত আসার শক্তি ছিল না তাদের। এবার মে মাসে নিম্নচাপ তৈরি হয়েছে আন্দামান ও বঙ্গোপসাগরে। তা ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়ে আম্ফানের মতো সাংঘাতিক রূপ নেয় কি না, তা জানা যাবে আগামী ৪৮ ঘণ্টায়।
শুধু উষ্ণতা নয়, আরও কয়েকটি অনুঘটক দরকার
আবহবিদরা জানিয়েছেন, জলের উষ্ণতা ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে অতিক্রম করলে অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে ঘূর্ণিঝড় তৈরির। আর তাপমাত্রা ৩০-৩১ ডিগ্রিতে পৌঁছলে পরিস্থিতি আরও অনুকূল হবে পরিস্থিত। এখন তেমনই পরিস্থিতি। তবে শুধু জলের উষ্ণতা বৃদ্ধি নয়, আবহাওয়ামণ্ডলের আরও কয়েকটি অনুঘটক ক্রিয়া করলেই ঘূর্ণিঝড় তৈরি হতে পারে।