উৎসবের মাঝে এখন বিদায়ের সুর, মেয়ের সঙ্গে বিছিন্ন হওয়ার দুঃখে ভারাক্রান্ত মেনকা
নিশুতি রাত। নদীর বুকে বয়ে চলা সাপের মতো স্রোতের বুকে তিরতির করে এগিয়ে চলেছে নৌকাটি। হাল ধরে বসে থাকা মাঝির মুখে ভাটিয়ালি সুর। নদীর বুক চিরে বয়ে চলেছে বাতাসের খেলা। শরতের আবহে যেন শীতের আভাষ।
নিশুতি রাত। নদীর বুকে বয়ে চলা সাপের মতো স্রোতের বুকে তিরতির করে এগিয়ে চলেছে নৌকাটি। হাল ধরে বসে থাকা মাঝির মুখে ভাটিয়ালি সুর। নদীর বুক চিরে বয়ে চলেছে বাতাসের খেলা। শরতের আবহে যেন শীতের আভাষ। অন্ধকারে নদীর জল নিকষ কালো। নদীর দিগন্ত বিস্তারের দু'পারে অনেকটা চর। সেই চর পেরিয়ে উঁচু মাটির বাঁধ। আর তারপাশে ছোট্ট-ছোট্ট সব গ্রাম। যেখানে এই গভীররাতেও উৎসবের আনন্দ। নদীর বুক থেকে সেই উৎসবের আলোর খানিকটা চোখেও পড়ছে। কানে আসছে উল্লাস হর্ষধ্বনি। ভেসে আসছে মাইকে বেজে চলা উদ্দাম গান। বাংলা এখন মাতোয়ারা মা-দুর্গা আরাধনায়।
হাল বয়ে চলা মাঝির নিস্তার নেই। উৎসব বলে ঘরে বসে থাকলে তো হবে না। মাছ না ধরলে পেট চলবে কি করে! তাই উৎসবের মাঝেও রাতের অন্ধকারে নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়া মাছের খোঁজে। নবমী পেরিয়ে দশমী মানেই তো মাছের জোর বাজার। পলকে বিক্রি হয়ে যাবে সমস্ত মাছ। রাতের অন্ধকারে তাই নদীর বুকে মাছ শিকার করতে বেরিয়েছে অনেকেই। অন্ধকার ঘুটে-ঘুটে চেহারা নদীর বুকে। কিন্তু, দশমী-তে এই অন্ধকার প্রায় কেটে যায়। ভাসানের আলোয় ভরে যায় নদীর দু'পার। নদীর ঘাটে আসতে থাকে একের পর এক প্রতিমা। জলে সাতবার প্রদক্ষিণ করার পর 'জয় মা দুর্গা' বলে বিসর্জন দেওয়া হয় মাটির প্রতিমার। অনেকে আবার নৌকায় প্রতিমা তুলে নিয়ে মাঝ নদীতে চলে যায়। নৌকাতে লাগানো থাকে রঙ-বেরঙের আলো। রাতের অন্ধকার কাটিয়ে নদীর বুকে তখন বিসর্জনের উৎসব।
বিসর্জনের আগমনী বেজেছে হিমালয় রাজের প্রাসাদেও। সেখানে এক বিয়োগান্তক পরিস্থিতি। কারণ, বাপের বাড়ি এসে উমার থাকার সময় এদিন-ই শেষ হয়ে যাচ্ছে। রাতের মধ্যেই শিব চলে আসবেন হিমালয় রাজের রাজপ্রসাদের সামনে। সারারাত সেখানেই ছাই মেখে বসে থাকবেন। আর সকাল হলেই শুরু করবেন হাক-পাক। বউ-বাচ্চা-র যদি একটু বের হতে দেরি হয় তাহলে তাণ্ডব নৃত্য শুরু হয়ে যাবে। রাজপ্রাসাদের বাইরে থেকে উমা-র নাম ধরে ডাকতে শুরু করবেন। যদি এতে কাজ না হয় তখন গণেশ, লক্ষ্মী, কার্তিক, সরস্বতী-র নাম ধরে ডাকতে থাকবেন। পাগলাটে জমাই-কে নিয়ে বিড়ম্বনার শেষ নেই মেনকা ও হিমালয়ের। চারদিন ধরে স্বামীর ঘর ছেড়ে বাপের বাড়িতে রয়েছেন উমা। শিবের এই জিনিসটা একদমই পছন্দ নয়। নিজে গেলে তাও হয়, ছেলে-মেয়ে এমনকী তাদের পৌষ্যগুলোকে পর্যন্ত বাপের বাড়়িতে নিয়ে এসে রেখেছেন উমা। শিব মনে করেন খাঁ-খাঁ কৈলাস দেখে তাঁর রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই কোনওভাবেই নবমীর নিশি পার করার পর বউ-বাচ্চাদের শ্বশুরবাড়িতে থাকতে দিতে রাজি নন শিব।
অষ্টমীর রাত থেকেই সমানে চোখে জল মেনকার। মেয়ের কথা ভেবে কেঁদে কেঁদে কুল পাচ্ছেন না। ছন্নাছাড়া শিবের সংসারে কৈলাসে উমা যে ভালো করে খাওয়া-দাওয়া পান না তা ভালোই বোঝেন হিমালয় রাজের সহধর্মিনী। তাই এই কদিন ধরে মেয়ে এবং নাতি-নাতনিদের যত্ন-আত্তিতে কোনও ত্রুটি রাখেননি। বাপের বাড়িতে উমার থাকার সময় যেন বিদ্যুত গতিতে শেষ হওয়ার পথে। আজ মহানবমী। নিশি ফুরোলেই মেয়েকে ও নাতি-নাতনিকে বছর ভরের জন্য বিদায় জানাতে হবে। এদিকে, হিমালয় রাজ পুরোহিত ডেকে পুজো শুরু করে দিয়েছেন। মেনকা এবং অন্যান্য় এঁয়োরা এই পুজোতে হাত লাগিয়েছেন। মেয়ে ও নাতি-নাতনিদের মঙ্গলকামনায় নবমীর পুজো হয়েছে। মেয়ে ছাড়াও নাতি-নাতনি এবং প্রত্যেকটি পোষ্য-র নামে আলাদা আলাদা করে পুজো হয়েছে।
মেনকার মানসিক অবস্থা দেখে অন্যান্য মা-য়েদের মনও ভারাক্রান্ত। তাঁদেরও চোখে জল। কারণ উমার বিদায় মানে তো তাঁদের ঘরের বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়েটাকেও স্বামীর ঘরে ফেরত পাঠাতে হবে। মেনকার ঘর খালি করে উমা কৈলাসের পথে পা বাড়ালে তারাই বা কীভাবে তাঁদেরে বিয়ে হওয়া মেয়েটাকে ঘরে রেখে দিতে পারেন!
মুখে হাসি রেখেই মেয়ে উমার সামনে ঘোরাফেরা করছেন মেনকা। কিন্তু, মনে মনে প্রার্থনা 'নবমীর নিশি যেন শেষ না হয়', কারণ নিশি যত দীর্ঘ হবে ততই তো উমার বাপের ঘরে থাকার সময়টা বৃদ্ধি পাবে। হিমালয় অনেক করে মেনকা বোঝান এমনভাবে ভেঙে না পড়তে। মেয়ে তো তাদেরই সে ঠিক ফের বাপের বাড়ি আসবে। তার সঙ্গেই বছর বাদে বাপের বাড়ি ফিরবে বাকি মেয়েরাও। আর এই মিলনকে ঘিরে ফের তাঁরা এক মহা উৎসবে মাতবেন। সুতরাং বিদায়ের মধ্যেও থাকছে মিলনের সূচনা।
হিমালয়ের বোঝানোতেও মন মানছে না মেনকার। কিন্তু, কিছুই তো তার করার নেই। বারো মাসের প্রতীক্ষা কাটিয়ে মাত্র দিন চারেকের এই মিলন যেন এক পরম পাওনা তাঁর কাছে। মা-এর এই মিলনের এই মহা-উৎসবের মধ্যে বেজে ওঠা বিদায়ের সুর ছুঁয়ে গিয়েছে সকলকেই। আর তাই উৎসবের শেষমুহূর্তকে স্মরণীয় করে রাখতে আরও জোরদার করে বেজে উঠেছে উৎসবের বাদ্যি। সকলেই চাইছেন নবমীর এই ক্ষণে আনন্দ যেন সব মাত্রা ছাপিয়ে যেতে পারে। এদিকে, অন্ধকারে নদীর সর্পিল স্রোতে নৌকা টেনে নিয়ে যেতে যেতে ভাটিয়ালি সুরে আরও জোর দেয় মাঝি। এক গান থেকে আর এক গান। মা ও মেয়ের সম্পর্ক নিয়ে মেঠোয়ালি সুরে মনকে আনমানা করে দিতে থাকে সে।