ধর্মীয় সম্প্রীতির বার্তা দিয়ে বসু বাড়ির 'কলারছড়া দুর্গাপুজো'-র আনন্দ আজও অটুট
উত্তর ২৪ পরগনার প্রাচীন পুজোগুলোর মধ্যে অন্যতম হল 'বসু বাড়ির, কলার ছড়া দুর্গাপুজো'।
শুধু সময়ের অপেক্ষা। আর মাত্র কয়েকটা দিন। পুজো একেবারেই দোড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে। আধুনিক পুজো গুলির পাশাপাশি প্রাচীন পুজোগুলিতেও সমান তালে চলছে মণ্ডপসজ্জা অর্থাৎ ঠাকুর দালন মেরামতি, রং ইত্যাদি ও প্রতিমা তৈরির ধুম। ব্যতিক্রম নয় কলকাতার পাশের জেলা উত্তর ২৪ পরগনার প্রাচীন পুজোগুলোও। তার মধ্যে অন্যতম হল 'বসু বাড়ির, কলার ছড়া দুর্গাপুজো'।
প্রাচীন এই পুজোর ইতিহাস, নামকরণ ও বেশ কিছু প্রাচীন প্রথা আজও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বহন করে আসছে উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাটের মানুষ। এই পুজোর নামকরণের ও কাঠামো তৈরির কথকতা আজও ঐতিহ্যের সঙ্গে পালন করে আসছে বসু বাড়ির বর্তমান সদস্যরা। আজও দেবীর আরাধনার দিন, মহালয়ার দিন থেকে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বসু বাড়ির সদস্যরা হাজির হন 'তাঁদের নিজেদের' বাড়িতে।
বসু পরিবারের তরফে জানানো হয়, এই পুজো শুরু ১৪৬০ থেকে ১৪৭০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের দ্বিতীয় স্ত্রীর বাবা ঈশ্বরীগুপ্ত বসু এই পুজো শুরু করেন। সেখান থেকেই চলে আসছে এই পুজো। কথিত আছে প্রতাপাদিত্যও এই পুজোতে অংশগ্রহণ করেছেন। তবে প্রথমে থেকেই এই পুজোর নাম 'কলার ছড়া দুর্গাপুজো' ছিল না। এই নামটির পিছনে রয়েছে এক কথকতা। ১৭৯৩ সালে প্রতিমা তৈরির সময় মহামায়ার পেছনের ৮টি হাত বারবার ভেঙে যেতে থাকে। বারবার সেই হাতগুলির মেরামতি করে তবেই পুজো দিতে হয়েছে। প্রতিমা তৈরির সময়ে পায়রা গিয়ে হাতগুলির উপর বসার ফলে সেগুলি ভেঙে যাচ্ছিল। কিন্তু পায়রার আসা কোনওভাবেই আটকানো যাচ্ছিল না। ফলে বহু চেষ্টা করেও প্রতিমার হাত ভাঙা কিছুতেই আটকানো যায়নি।
১৭৯৩ থেকে ১৭৯৭ সাল পর্যন্ত এই পাঁচ বছর এভাবেই পায়রা দ্বারা প্রতিমার হাত ভাঙার ঘটনা ঘটতে থাকায় পরিবারের পক্ষ থেকে অমঙ্গলের সংকেত আঁচ করা হয়। ১৭৯৭ সালের পর তৎকালীন বসু পরিবারের প্রধান গোপাল বসু স্বপ্নাদেশ পান প্রতিমার ১০টি হাতের মধ্যে পিছনের ৮টি হাত ছোট করে দিতে। সেই মত সামনের দুটি হাত প্রমাণ সাইজের থাকলেও পেছনের ৮টি হাত ছোট করে দেওয়া হয়। তার পর থেকেই প্রতিমার হাত ভাঙা বন্ধ হয়ে যায়। হাত ছোট হয়ে যাওয়ার ফলে প্রতিমাকে দেখলে ওই ছোট হাতগুলিকে অনেকটা কলার ছড়ার মত দেখায়। তাই তখন থেকেই বসু বাটির পুজোর প্রতিমার নাম হয়ে যায় 'কলারছডা দুর্গাপুজো'।
শুধু এই ঘটনাই নয় প্রতিমার কাঠামো ও প্রতিমা গড়ার ক্ষেত্রেও আছে ইতিহাস। জানা যায়, পুজো শেষে সিঁদুর খেলার সময় সবার অজান্তে মুসলিম সমাজের একজন এসে প্রতিমার কাঠামো থেকে একটা কাঠের টুকরো ভেঙে নিয়ে যায়। পরবর্তী বছর সেই কাঠামোর কাঠের ভাঙা অংশের সঙ্গে নতুন কাঠ জুড়ে নতুন করে কাঠামো বানানো হয়। তবে গোটা ঘটনার পিছনে যে কাহিনি রয়েছে তার খোঁজ বসু পরিবারের লোকেরাও ভালো করে জানেন না। বা বলা ভালো তা ভাঙতে চান না।
[আরও পড়ুন:দেবীর আরাধনায় শৈশব বাঁচাও-এর ডাক! বেহালা নতুন দলের এবারের আকর্ষণ ]
পাঁচ পুরুষ ধরে টাকির বসু পরিবারে পুজো হচ্ছে। বসু বাড়ির প্রতিমা শিল্পী মদন মোহন বসুর কথায়, কি কারণে, কে বা কারা, কীভাবে প্রতিমার কাঠামোর কাঠ ভেঙে দিয়ে যায় তা আমরাও জানি না। আমাদের জানানোও হয় না। শুনেছি আফগানিস্থান থেকে এক পাঠান তার পরিবার নিয়ে ওই এলাকায় এসেছিল। তাদের সংখ্যা বেড়ে অনেক হয়েছে। তাদের পদবী এলাকায় গাঁজি। তাদেরই কেউ কাঠামোর কাঠ ভেঙে নতুন কাঠামো বানানোর আগে দিয়ে যায়।
[আরও পড়ুন:সাবেকিয়ানায় চির উজ্জ্বল শতাব্দী প্রাচীন বাগবাজার সর্বজনীন]
জানা গিয়েছে ১৮৫১ সাল থেকে এই কাঠামোর কাঠ ভাঙার বিষয়টি চলে আসছে। এই সব ঐতিহ্য নিয়েই বসিহাটের প্রাচীনতম পুজো 'কলারছড়া দুর্গাপুজো' আজও শ্রদ্ধাভরে ধর্মীয় সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে পূজিত হচ্ছে।