বালুরঘাটে প্রতিবাদ সভা করতে গিয়ে আক্রান্ত অম্বিকেশ-বিকাশ-মন্দাক্রান্তা, দর্শক পুলিশ
ফের খবরের শিরোনামে বালুরঘাট। বর্তমান শাসকদলের আমলে পুলিশি নির্লিপ্ততা কোথায় পৌঁছেছে তার আরও এক ছবি প্রকাশ্যে এল। বালুরঘাটে পুজোর সময়ের ফেসবুকে প্রতিবাদ করে গ্রেফতার হওয়ার ঘটনায় এক প্রতিবাদ সভায় যোগ দিতে মঙ্গলবার সেখানে যান আক্রান্ত আমরা-র অম্বিকেশ মহাপাত্র, বিকাশ ভট্টাচার্য, মন্দাক্রান্তা সেনরা।

বালুরঘাট নাট্য মন্দিরে এই সভা শুরু হওয়ার কথা ছিল বিকেল চারটা নাগাদ। কিন্তু, দুপুর থেকেই নাট্য মন্দির সংলগ্ন এলাকা ঘিরে ফেলে অবরোধ শুরু কয়ে দেয় কয়েক'শ টোটো চালক। এই অবরোধের জেরে নাট্যমন্দির সংলগ্ন কয়েক কিলোমিটার এলাকা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। সেইসঙ্গে টোটা চালকরা সমানে স্লোগান দিতে থাকেন। অভিযোগ স্লোগানের মাঝে মাঝে অম্বিকেশ মহাপাত্র, বিকাশ ভট্টাচার্য, মন্দাক্রান্ত সেনদের উদ্দেশে হুমকি ও শাসানিও ভেসে আসতে থাকে। নাট্যমন্দির লাগোয়া রেনুকা লজেই অম্বিকেশ মহাপাত্র, বিকাশ ভট্টাচার্য এবং মন্দাক্রান্তা সেনদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। দুপুরে অবশ্য লজ থেকে বেরিয়ে কাছেই এক জনের বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজ সারতে যান আমরা আক্রান্ত-র প্রতিনিধিরা। কিন্তু, সে সময় অম্বিকেশদের বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়া হলেও তাঁদের শারীরিকভাবে কেউ হেনস্থা করেনি।

যদিও, এর আগেই সকালে একপ্রস্থ অবরোধের সামনে পড়েছিলেন আক্রান্ত আমরা-র প্রতিনিধিরা। সড়কপথে বালুরঘাটে ঢোকার মুখে তাঁদের কনভয় আটকে দিয়েছিল টোটো চালকরা। কালো পতাকা দেখিয়ে টোটো চালকরা অম্বিকেশ, বিকাশ এবং মন্দাক্রান্তাদের উদ্দেশে গো-ব্যাক স্লোগান দিতে থাকে। পরে বিকাশ ভট্টাচার্য ডিজি-কে ফোন করতেই বালুরঘাট থানার পুলিশ গিয়ে তাঁদের উদ্ধার করে।
পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয় বিকেলে। চারটার খানিক আগে নাট্যমন্দিরের সভাস্থলের উদ্দেশে লজ থেকে বের হন অম্বিকেশ মহাপাত্র, বিকাশ ভট্টাচার্য, মন্দাক্রান্তা সেনরা। তাঁদের সঙ্গেই ছিলেন বালুরঘাটে গ্রেফতার হওয়া দুই প্রতিবাদী অনুপম তরফদার এবং দেবজিত রায়। এছাড়াও ছিলেন প্রতিবাদী সভার আয়োজক নাগরিক কমিটির সদস্যরা।

অভিযোগ, লজ থেকে বের হতেই অম্বিকেশ মহাপাত্র, বিকাশ ভট্টাচার্য, মন্দাক্রান্তা সেন, অনুপম তরফদার, দেবজিত রায়দের উপরে প্রায় হামলে পড়ে টোটা চালকরা। এমনকী নাট্যমন্দিরের মূল ফাটকের সামনেও টোটো চালকরা এমনভাবে অবরোধ করে রেখেছিল যে অম্বিকেশরা সভার জন্য নির্দিষ্ট করা অডিটোরিয়ামে ঢুকতেও ব্যর্থ হন। টোটো চালকদের সঙ্গে অবরোধে সামিল হয় স্থানীয় ল'কলেজের টিএমসিপি-র সদস্য ছাত্রদের একটি দল।
শেষমেশ, রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে নিজেদের বক্তব্য জানাতে শুরু করেন অম্বিকেশ মহাপাত্র, বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য, মন্দাক্রান্তা সেন, দেবজিত রায়, অনুপম তরফদাররা। এই সময়ই বক্তাদের লক্ষ করে উড়ে আসতে থাকে ঢিল, পাথরের টুকরো। বক্তব্য রাখার সময় অম্বিকেশ মহাপাত্র-র কপালে এসে লাগে পাথরের টুকরো। ঢিলের আঘাত থেকে বাদ যাননি মন্দাক্রান্তা সেন, বিকাশ ভট্টাচার্যরাও। মন্দক্রান্তা বক্তব্য রাখার সময় তাঁর শরীর লক্ষ করে ঢিল ছোড়া হয় বলে অভিযোগ। বিকাশ ভট্টাচার্য-র নাকেও গিয়ে লাগে ঢিলের টুকরো। এমনকী, বালুরঘাটের দুই প্রতিবাদী অনুপম ও দেবজিত রায়কেও লক্ষ করে বড় বড় পাটকেল এবং পাথরের ঢিল ছোড়া হতে থাকে।

দুটি বড় আকারের ঢিল অনুপমের মাথা এবং কানের পাশ দিয়ে পিছনের দোকানের শাটারে আছড়ে পড়ে। বক্তব্য রাখার সময় অনুপমের নাকেও ঢিলের আঘাত লাগে। দেবজিত রায়ও একই ধরনের ঘটনার শিকার হন।
অভিযোগ, টোটো চালকরা এদিন পুলিশের চোখের সামনেই দুপুর থেকে যে ভাবে নাট্যমন্দির এলাকায় বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছিল তা বালুরঘাটের ইতিহাসে একটা লজ্জা। টোটো চালকরা যে এই প্রতিবাদী সভাকে ঘিরে বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে তার খবরে কোনও রাখ-ঢাক ছিল না। অথচ, প্রথম থেকেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ যথেষ্ট পরিমাণে নিস্ক্রিয় ছিল বলেই অভিযোগ।

দুপুর থেকে আইন-শৃঙ্খলাকে লাটে তুলে শহরের একটা অর্ধেক অংশ কার্যত গুণ্ডামি করে নিজেদের দখলে নিয়ে নেয় টোটো চালকরা। অথচ, পুলিশ প্রশাসন এই অবরোধ তুলতে বিন্দুমাত্র আগ্রহই প্রকাশ করেনি। বিকেলে সভার আগে পুলিশ প্রশাসনের কিছু উচ্চ-পদস্থ কর্তা সেখানে হাজির থাকলেও টোটো চালকদের নৈরাজ্য তৈরির প্রচেষ্টাকে বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ করা হয়নি। টোটো চালকরা পুলিশের কর্তাদের সামনে দাঁড়িয়েই হুমকি ও শাসানি দিয়ে যেতে থাকে। সভাস্থলের বক্তাদের উদ্দেশে ইট-পাটকেল-পাথরের ঢিল ছোড়ার পাশাপাশি টোটোর গায়ে জোরে জোরে লাঠির আঘাত মেরে চরম বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা চলে। কিন্তু, ফেসবুকে প্রতিবাদ করা নিয়ে গত দেড় মাস ধরে পুলিশ প্রশাসন বনাম বালুরঘাটের আম জনতার যে নৈতিকতার লড়াই শুরু হয়েছে তাকে সমর্থন জানাতে এদিন কাতারে কাতারে মানুষ নাট্যমন্দিরে এসেছিলেন। যদিও, এই সমবেত জনতা টোটো চালকদের প্ররোচনায় পা দেয়নি।

সভা শেষে ঢিলের আঘাত লাগা অম্বিকেশ মহাপাত্র, বিকাশ ভট্টাচার্য, মন্দাক্রান্তা সেনদের প্রাথমিক শুশ্রূষা করা হয়। গোটা ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা করেন অম্বিকেশ মহাপাত্র। তাঁর অভিযোগ, রাজ্যে কার্টুনকাণ্ডে তাঁর গ্রেফতারি ঘটনার পর থেকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে আন্দোলন করছেন। এর আগেও বহু স্থানে গেলেও বালুরঘাটে বুকে যে ভাবে পুলিশি নিস্ক্রিয়তাকে প্রত্যক্ষ করলেন তা অতিব ভয়ানক বলেই মনে করছেন অম্বিকেশ। যে ভাবে টোটো চালকরা দুপুর থেকে তাঁদের ঘেরাও করে হামলা চালাল তাতে পুলিশের প্রত্যক্ষ মদত আছে বলেই মনে করছেন তিনি। আক্রান্ত আমরার আর এক প্রতিনিধি বিকাশ ভট্টাচার্য-রও অভিযোগ, 'এদিন যা ঘটল তা পুলিশের মদতেই হল। আমি বালুরঘাটে ঢোকার মুখে অবরোধে পড়ে ডিজি-কে ফোন না করলে হয়তো বিকেশে সভাস্থলে পুলিশেও দেখা মিলত না।' এই ঘটনায় অভিযুক্ত টোটো চালকদের গ্রেফতারি দাবি করেছেন বিকাশ ভট্টাচার্য। গোটা ঘটনায় তীব্র আতঙ্কে সাহিত্যিক মন্দাক্রান্তা সেন। তাঁর অভিযোগ, 'যে ভাবে মানুষের স্বাধীন মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে কাড়া হচ্ছে তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। আর বালুরঘাটকাণ্ডে খোদ পুলিশই শহরে এক মাৎসন্যায় পরিস্থিতি তৈরি করেছে।'
এদিকে, দক্ষিণ দিনাজপুরের পুলিশ সুপার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ওয়ান ইন্ডিয়া বাংলার পক্ষ থেকে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু, মোবাইল ফোন বেজে গেলেও তা ধরেননি পুলিশ সুপার। যদিও, সূত্রের খবর অনুযায়ী, গোটা ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রাক্তন বিচারপতি তথা আক্রান্ত আমরার অশোক গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতা থেকে দক্ষিণ দিনাজপুরের পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলেন। অম্বিকেশদের নিরাপদে বালুরঘাট ছাড়ার ব্যাপারে পুলিশ সুপার আশ্বাসও দেন বলে জানা যায়।
[আরও পড়ুন:ফেসবুকাণ্ডে প্রতিবাদ সভা নিয়ে উত্তপ্ত বালুরঘাট, অম্বিকেশ-বিকাশদের কালো পতাকা]
পরে নিরাপদে গাড়িতে করেই বালুরঘাট স্টেশন থেকে রাতে অম্বিকেশ মহাপাত্র, বিকাশ ভট্টাচার্য, মন্দাক্রান্তা সেন এবং তাঁদের অন্য সঙ্গীরা কলকাতার ফেরার ট্রেন ধরেন। পুজোর সময় বালুরঘাটে বিকেল চারটা থেকে ভোর চারটা পর্যন্ত টোটো ছাড়া সমস্ত ধরনের যান-বাহন চলাচল নিষিদ্ধ করেছিল পুলিশ প্রশাসন। এই নিয়ে ফেসবুকে বহু মানুষ ক্ষোভ উগরে দেন। টোটো চালকদেরও এতে দায়ী করা হয়। এরপর থেকেই পুলিশ প্রশাসন এই ঘটনা নিয়ে ফেসবুকে প্রতিবাদ জানানোদের বেছে বেছে থানায় ঢেকে নিয়ে গিয়ে হুমকি দিতে থাকে বলে অভিযোগ। বহু মানুষ পুলিশি হুমকির সামনে পড়ে ফেসবুক থেকে মন্তব্য ডিলিটও করে দেন বলে দাবি ওঠে। কিন্তু, অনুপম তরফদার, দেবজিত রায়, কৌশিকরঞ্জন খাঁ এবং ব্রতীন সরকারে মতো কিছু জন পুলিশের বিরুদ্ধে ফেসবুকেই রুখে দাঁড়ান। এতে উল্টে এঁদের বিরুদ্ধে পুলিশ বিভিন্ন ধারায় অপরাধের স্বতঃপ্রণোদিত মামলা দায়ের করে। অনুপম ও দেবজিত পুলিশের বিরুদ্ধে পাল্টা কলকাতা হাইকোর্টে দক্ষিণ দিনাজপুরের পুলিশ সুপার, জেলা শাসকদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এরমধ্যে দেবজিত পুলিশি হুমকির অভিযোগ তুলে সপরিবারে আত্মহুতির জন্য জেলা শাসকের কাছে আবেদনও রাখেন। এরপরই অনুপম ও দেবজিত-কে গ্রেফতার করে পুলিশ। এতে আরও প্রতিবাদী হয়ে ওঠে বালুরঘাটবাসী। শেষমেশ দিন কয়েকের পুলিশি হেফাজতের পরই আদালতে জামিন পান অনুপম ও দেবজিত। কিন্তু, বারবার অভিযোগ উঠতে থাকে পুলিশের বিরুদ্ধে। চক্রান্ত করে টোটোচালকদের বালুরঘাটের সাধারণ মানুষদের বিরুদ্ধে পুলিশের একটি মহল খেপিয়ে তুলছে বলেও অনেকে অভিযোগ করছেন। মঙ্গলবার তারই নমুনা যেন দেখা গেল।