গব্যথোড় আর কুঁড়োর নৈবেদ্যই আজও দীনদুখিনী টুকির মায়ের পুজোর প্রধান উপাচার
বাবুদের শখের জীবন, অহঙ্কারের বাহুল্য, শোষণ আর ঔদ্ধত্যে প্রতিবাদে শুরু হওয়া দীনদুখিনী টুকির মায়ের পুজোয় চলে আসছে কুঁড়োর নৈবেদ্য আর গব্যথোড়ের নৈবেদ্য দেওয়ার রীতি।
পুজো মানে অহঙ্কারের বাহুল্য নয়। পুজো মানে ভক্তি-অর্চনার ব্রত। তা-ই 'বাবু'দের শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন দীন দুখিনী টুকির মা। দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে তিনি আয়োজন করেছিলেন দুর্গাপুজোর। তারপর দেবীর স্বপ্নাদেশ- 'সম্বল না থাকলে গব্যথোড় আর নৈবেদ্য সাজিয়েই আমাকে পুজো দে। আমি তা-ই গ্রহণ করব।' দেবীর স্বপ্নাদেশ মেনে আজও সেই ধারা চলমান।
[আরও পড়ুন:রামকৃষ্ণের স্মৃতি বিজরিত দুর্গা পুজো রানি রাসমণির বাড়িতে]
বাবুদের শখের জীবন, অহঙ্কারের বাহুল্য, শোষণ আর ঔদ্ধত্যের প্রতিবাদে শুরু হওয়া দীনদুখিনী টুকির মায়ের পুজোয় চলে আসছে কুঁড়োর নৈবেদ্য আর গব্যথোড়ের নৈবেদ্য দেওয়ার রীতি। নিজের ভিটেতেই দেবী দুর্গার আবাহন করেছিলেন উদয়নারায়ণপুরের ভবানীপুরের বাসিন্দা ওই ধাত্রী মা। কালের নিয়মে টুকির মায়ের পুজো ভবানীপুর সর্বজনীন দুর্গোৎসবে রূপ পেলেও আজও বদলায়নি রেওয়াজ।
এখনও
টুকির
মায়ের
বংশধররাই
সন্ধিপুজোয়
গব্যথোড়
আর
কুঁড়োর
নৈবেদ্য
সাজিয়ে
দিয়ে
যান।
'গব্যথোড়'
আর
'কুঁড়ো'
দিয়ে
সাজানো
হয়
সন্ধিপুজোর
নৈবেদ্য।
আড়াইশো
বছর
ধরেই
এই
রীতি
চলে
আসছে
উদয়নারায়ণপুরের
টুকির
মায়ের
দুর্গাপুজোয়।
বাংলায়
দুর্গাপুজো
শুরু
হয়েছিল
রাজা-মহারাজা-জমিদার-ভুস্বামীদের
হাত
ধরে।
দালান-দেউলে
এইসব
দুর্গাপুজো
রাজবাড়ির
অহঙ্কারের
বাহুল্য
প্রচার
করাই
ছিল
উপলক্ষ।
কাঙালি
ভোজন
করিয়ে
বাবুরা
অহঙ্কার
প্রদর্শন
করত।
আভিজাত্যের
বড়াই
দেখাত
বাঈজিদের
নাচ-গানে।
পুজোর
আড়ম্বরের
সঙ্গে
ঝাড়বাতির
নিচে
জমত
অন্ধকারের
রসদ।
এসব একেবারেই পছন্দ হয়নি দীনদুখিনী টুকির মায়ের। প্রতিবাদ করার ভাষা খুঁজে পাননি, পাননি সাহসও। ওঁরা যে জমিদার, প্রভুত ক্ষমতার অধিকারী। তাই মুখে প্রতিবাদ না জানাতে পেরে, টুকির মা স্থির করেছিলেন রাজবাড়ির এই ঔদ্ধত্যের তিনি জবাব দেবেন দুর্গাপুজোর আয়োজন করে। বিলাসবহুল আয়োজনে উপলক্ষের দুর্গা আরাধনা নয়, সেই পুজো হবে নিষ্ঠা সহকারে, ভক্তি-অর্চনা দিয়ে।
লোকশ্রুতি
রয়েছে,
এই
ধাত্রী
মা
ছিলেন
নিম্নবর্গীয়
হরিজন
সম্প্রদায়ের।
ভবানীপুর,
সোনাতলা,
গড়ভবানীপুর,
চিত্রসেনপুর
গ্রামে
ধাত্রীমায়ের
কাজ
করেই
তাঁর
দিন
চলত।
তখনই
তিনি
বিভিন্ন
রাজবাড়ি,
জমিদার
বাড়িতে
ঘুরে
দেখেছেন
কী
'নোংরা'
ছিল
সেই
মানুষের
রুচি।
প্রতিবাদে
শক্তিরূপী
দেবী
দুর্গাকে
আবাহন
করে
তিনি
সমগ্র
নারীজাতিকে
জাগরণের
ডাক
দিয়েছিলেন।
বহু
যুগ
আগে
তিনি
গত
হলেও
তাঁর
হাত
দিয়ে
গ্রামের
যেসব
সন্তান
পৃথিবীর
আলো
দেখেছিলেন
তাঁরা
এবং
তাঁদের
বংশধররা
পালন
করে
আসছেন
এই
পুজোর
পরম্পরা।
গ্রামের
অতিদরিদ্র
এই
টুকির
মায়ের
নাম
জানা
যায়নি।
তবে
জনশ্রুতি
রয়েছে,
তাঁর
পদবী
ছিল
মণ্ডল।
সম্বল
বলতে
ছিল
নিজের
ভিটেটুকু।
কথিত আছে, টুকির মায়ের মৃত্যুর পর টুকি কিছুদিন এই পুজো চালিয়েছিলেন। এরই মধ্যে ভিটে খুইয়ে তাঁর স্থান হয়েছিল শশীভূষণ চৌধুরী নামে এক হিতাকাঙ্ক্ষীর ডাঙায়। এরপর কিছুদিন জনৈক পশুপতি দাসের উদ্যোগে এই পুজো চলে। মাঝখানে কিছুদিন বন্ধও হয়ে যায় পুজো। তারপর ভবানীপুরের চক্রবর্তীপাড়া, দাসপাড়ার বাসিন্দারা সংগঠিত হয়ে পুজো চালানোর উদ্যোগ নেন। টুকির মায়ের সম্মান, মর্যাদা ও স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে এখন উদ্যোগী ভবানীপুর সর্বজনীন।