শাসকের শাসানিতেও থমকে যায়নি প্রতিবাদের ভাষা, তবু আজও আক্রান্ত হয়ে চলেছেন যাঁরা
বইমেলার এক অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাক স্বাধীনতার হয়ে সওয়াল করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন মত প্রকাশের স্বাধীনতা সকলেরই রয়েছে। তা থাকা প্রয়োজন। তবু আক্রান্ত ওরা।
বইমেলার এক অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাক স্বাধীনতার হয়ে সওয়াল করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন মত প্রকাশের স্বাধীনতা সকলেরই রয়েছে। তা থাকা প্রয়োজন। তাঁর সরকার কাজে স্বচ্ছতা আনার জন্য স্থানীয় মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করতে বারবার আবেদন করেছেন। জানিয়েছেন, এলাকার সমস্যা সরকারের কাছে তুলে ধরতে। তবু আক্রান্ত ওরা।
কেউ মানুষের দুর্ভোগের কথা তুলে ধরেছেন, কেউ স্বাধীন মত প্রকাশ করেছেন। কেউ বা ব্যঙ্গ চিত্রে ইঙ্গিত করেছেন সমাজের কোনও বিশেষ একটা দিক। কিন্তু বারবার প্রতিবাদের সেই ভাষার কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা হয়েছে। তবু আজও চলছে প্রতিবাদ। শুরু হয়েছিল শিলাদিত্য চৌধুরী, তানিয়া ভরদ্বাজ, অম্বিকেশ মহাপাত্রদের দিয়ে, এখন সেই ধারা জারি রেখেছেন অমিত ঘোষ, স্বপন মালাকারদের সৌজন্যে।
শিলাদিত্যকে মাওবাদী তকমা
বেলপাহাড়ির শিলাদিত্য চৌধুরী মুখ্যমন্ত্রীকে সারের দাম নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। বেলপাহাড়িতে সভায় সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীকে সারের দাম নিয়ে প্রশ্ন করায় খেতমজুর শিলাদিত্যের গায়ে মাওবাদী তকমা সেঁটে দিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এরপরই শিলাদিত্য হয়ে উঠেছিলেন প্রতিবাদী আন্দোলনের মুখ। পরে তিনি জামিনে মুক্ত হন। তিনি বিজেপির দিকেও ঢলে পড়েন পরে। এখন অবশ্য তিনি বিজেপি থেকে সমদূরত্ব বজায় রেখে চলেন। বরং তিনি ‘আক্রান্ত আমরা'দের দলেই।
[আরও পড়ুন: 'বিপাকে' বিজেপি নেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়! গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি]
ছাত্রী তানিয়া ভরদ্বাজও মাওবাদী
তানিয়া প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী। এক সর্বভারতীয় নিউজ চ্যানেলের ‘টক শো'তে তিনি সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন। প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন নেতা-মন্ত্রীদের আচার-আচরণ নিয়ে, প্রশ্ন করেছিলেন রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে। তাতেই অগ্নিশর্মা হয়ে অনুষ্ঠান মঞ্চ ত্যাগ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেবারও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাত্রী তানিয়া ভরদ্বাজকে মাওবাদী তকমা দেন।
[আরও পড়ুন:কেরলের ত্রাণ তহবিলে দান ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর - গুজব না সত্যি]
কার্টুন এঁকে গ্রেফতার অম্বিকেশ
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৎকালীন তৃণমূল নেতা মুকুল রায়ের কার্টুন এঁকে বিপাকে পড়েন অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র। ওই কার্টুন এঁকে তিনি ফরওয়ার্ড করেছিলেন। আর তাতেই চক্ষুশূল হয়ে পড়েন শাসক দলের। তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। রাজ্য আদালতে তিরষ্কৃত হয়। আবার ক্ষতিপূরণের নির্দেশও দেওয়া হয় রাজ্যকে। এখন এই অম্বিকেশই ‘আক্রান্ত আমরা'র মুখ। তিনি তাঁর সামাজিক সংগঠন নিয়ে প্রতিবাদী আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ান। প্রতিবাদের ভাষাকে আরও জোরদার করে তোলেন।
[আরও পড়ুন:দিল্লিতে ইদের সকালে ভয়াবহ আগুন, চাঞ্চল্য এলাকায়]
পরিবেশকর্মী স্বামী-খুনে প্রতিবাদী প্রতিমা
বালির নিহত পরিবেশ কর্মীর স্ত্রী প্রতিমা দত্ত। পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে খুন হয়েছিলেন তৃণমূল নেতা তপন দত্ত। অভিযোগের তির উঠেছিল তৃণমূলেরই দিকে। স্বামীর খুনের বিচার চেয়ে সরব হয়েছিলন প্রতিমাদেবী। তৃণমূল সরকারের এক মন্ত্রীকেও কাঠগড়ায় তুলেছিলেন তিনি। মন্ত্রী গ্রেফতার না হলেও প্রতিবাদের পথ থেকে সরে আসেননি তিনি। আজও ‘আক্রান্ত আমরা' সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রতিবাদ চালিয়ে যাচ্ছেন প্রতিমাদেবী।
টেট-কাণ্ডে প্রতিবাদী মুখ মইদুল
টেটকাণ্ডে গর্জে উঠেছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলপির প্রাথমিক শিক্ষক মইদুল ইসলাম। টেটকাণ্ডে তৃণমূলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন তিনিই। তারপরই কাকদ্বীপে অন্যতম প্রতিবাদী মুখ হয়ে ওঠেন মইদুল। কাকদ্বীপের এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলে সরব হন। গর্জে ওঠে তাঁর প্রতিবাদী সত্ত্বা। এরপর ক্যানিং-এর হেতালখালিতে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের বলি হয়েছিলেন আট বছরের এক বালক ও এক যুবক। সেই ঘটনার প্রতিবাদে এলাকায় তাঁর উদ্যোগে সভা করেছিল আক্রান্ত আমরা। অভিযোগ, সেই সভায় হামলা চালিয়েছিল তৃণমূল। অম্বিকেশ মহাপাত্র থেকে শুরু করে মন্দাক্রান্তা সেন, অরুণাভ গঙ্গোপাধ্যায় এবং মইদুল হেনস্থার শিকার হয়েছিলেন তৃণমূলের হাতে। পরে তৃণমূলের অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার হন মইদুল। তাঁকে ১৫ দিন হাজতবাস পর্যন্ত করতে হয়। এখন তিনি ‘আক্রান্ত আমরা'র সদস্য হিসেবে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন। তাঁরা প্রতিবাদী সত্ত্বাকে কাজে লাগিয়ে তিনি গর্জে ওঠেন প্রতিবাদে। তাঁর প্রতিবাদের ভাষাকে দমিয়ে দিতে পারেনি শাসকের শাসানি।
ফেসবুকে নিরীহ মন্তব্যে গ্রেফতার রোহিত
বিপদের সময় নেতাদের পাশে পাওয়া যায় না। এমনই এক নিরীহ পোস্ট করেছিলেন রোহিত পাশি। ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি কারও নাম উল্লেখ করেননি। তবু কাউন্সিলারের বিরাগভাজন হয়ে পড়েন রোহিত। কাউন্সিলর পুলিন গোলদারের এফআইআর করেন। মালবাজারের ব্যবসায়ীর বাড়িতে সটান চলে যায় পুলিশ। তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশের অতি সক্রিয়তায় অবশ্যা সেবার জল ঢেলে দেন পুলিশ সুপার। তবে নিঃশর্তে মুক্তি পাননি তিনি। জামিন পান আদালত থেকে।
জাতীয় পতাকার অবমাননার প্রতিবাদে রোষানলে
তৃণমূল কার্যালয়ের সামনে উল্টো পতাকা তোলা হয়েছিল স্বাধীনতা দিবসের দিন। সেই ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করায় শাসকের রোষানলে পড়লেন প্যারা মেডিকেলের ছাত্র অমিত ঘোষ।
তার জেরে এক রাত হাজতবাসের পর অমিতকে তোলা হল বর্ধমান আদালতে। সেখানে বিচারকের ভর্ৎসনার মুখে পড়তে হল পুলিশকে। সরকারি আইনজীবীও কথা হারালেন। রবিবার বর্ধমানের ভাতারের মেধাবী ছাত্র অমিত ঘোষের জামিন মঞ্জুর করলেন বিচারক।
সর্বশেষ সংযোজন স্বপন মালাকার
ফেসবুকের পাতায় এলাকার করুণ দশা, এলাকাবাসীর দুরবস্থার কথা তুলে ধরেছিলেন হাওড়ার নিশ্চিন্দার বাসিন্দা স্বপন মালাকার। মানুষের ভোগান্তির সেই কাহিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরে শাসকের রোষানলে পড়ে গেলেন তিনি। নিজে তৃণমূলের কর্মী হয়েও রেহাই হল না, শ্রীঘরে স্থান হল অবশেষে। ভাতারের অমিত তবু জামিন পেয়েছিলেন, নিশ্চিন্দার স্বপন সেটুকুও পেলেন না।
হাওড়ার নিশ্চিন্দা থানার দেওয়ানচকের স্বপন মালাকার এলাকার রাস্তাঘাটের দুরবস্থার কাহিনি ফেসবুকের পাতায় প্রকাশ করে দায়িত্বশীল নাগরিকের ভূমিকা পালন করতে গিয়ে নিজেই নিজের ‘বিপদ' ডেকে আনলেন। হাওড়া আদালতে পেশ করা হলেও জামিন মিলল না স্বপন মালাকারের। জামিন নাকচ করে দিয়ে জেল হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন। আগামী ২৩ অগাস্ট ফের মামলাটি উঠবে।