পঞ্চায়েত প্রধান স্ত্রীর নির্দেশে স্বামী যখন চাকুরে, দুর্নীতির অভিযোগ-বিস্ফোরণে কাঁপছে ভাঙড়
পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। সোমবার জারি হয়েছে বিজ্ঞপ্তিও। কিন্তু, গ্রাম বাংলার এমন নির্বাচনের দামামায় দুর্নীতির অভিযোগে বাজার গরম।
পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। সোমবার জারি হয়েছে বিজ্ঞপ্তিও। কিন্তু, গ্রাম বাংলার এমন নির্বাচনের দামামায় দুর্নীতির অভিযোগে বাজার গরম। অভিযোগ, ভাঙড় ১ নম্বর ব্লকের শাঁকসহর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান স্বপ্না নস্করের বিরুদ্ধে এই দুর্নীতির অভিযোগ। দুর্নীতিতে পঞ্চায়েত প্রধান স্বপ্না নস্কর এতটাই মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছেন যে কোনও বাধাই তিনি মানছেন না। অভিযোগ, ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত গঠনের পর থেকেই আস্তে আস্তে দুর্নীতির আঙিনায় পা রেখেছিলেন স্বপ্না। এখন তাঁকে রোখাই যাচ্ছে না বলে অভিযোগ। একটা সময় স্বপ্না নস্কর, উপপ্রধান ও পঞ্চায়েত ইঞ্জিনিয়ারের বিরুদ্ধে থানায় এফআইআর দায়ের হয়েছিল। গ্রেফতার হওয়ার উপক্রমও তৈরি হয়। অভিযোগ, কোন এক অদৃশ্য বলে গ্রেফতারির সম্ভাবনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিব্যি দুর্নীতির রানি হয়ে বসেছেন স্বপ্না। আর তার এই কাজে শাসক দলের একাংশের মদত তো রয়েছেই, সেইসঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনেরই একাংশকেও কাঠগড়ায় তুলেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু অভিযোগকারী।
ওয়ান ইন্ডিয়া বাংলার অন্তর্তদন্তে ওঠে এসেছে ভয়ঙ্কর সব তথ্য। অভিযোগ, প্রধান স্বপ্না নস্কর শাঁকসহর গ্রাম পঞ্চায়েতের বোর্ডের কোনও সদস্যকে না জানিয়েই স্বামী প্রশান্ত নস্করকে 'নির্মল মিশন বাংলা'-র ফেসিলেটর পদে চাকরি পাইয়ে দেন। সাধারণত, এই ধরনের সুপারিশের জন্য আগ বোর্ডের প্রতিটি সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্টের মত নিতে হয়। এরপর রেজিলিউশন পাস করিয়ে তা পাঠানোর নিয়ম ব্লক আধিকারিকের কাছে। কিন্তু, ২০১৫ সালে প্রশান্ত নস্করের নিয়োগে এই ধরনের কোনও পদ্ধতিতেই স্বপ্না অনুসরণ করেননি বলে অভিযোগ। উল্টে নিজেই পঞ্চায়েতের প্যাডে স্বামী প্রশান্ত নস্করের নাম লিখে, তাতে সই করে ব্লক আধিকারিকের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এই নিয়ে বিপুল হইচই হয়। স্বপ্নার বিরুদ্ধে ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। কিন্তু, কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়নি। পঞ্চায়েত বোর্ডের অধিকাংশ তৃণমূল সদস্য স্বপ্নার বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ আনলেও কোনও লাভ হয়নি।
অভিযোগ, অবশ্য এই বেআইনি নিয়োগের সুপারিশের আগে ২০১৪ সালেই স্বপ্নার বিরুদ্ধে ২,৭৪,৯২২ টাকা তচ্ছরূপের অভিযোগ ওঠে। শাঁকসহর গ্রাম পঞ্চায়েতের তৎকালীন সেক্রেটারি খোদ এই নিয়ে সরব হন। অভিযোগ ওঠে দুই পঞ্চায়েত সদস্যের সই জাল করে প্রধান স্বপ্না নস্কর, উপপ্রধান, নির্মাণ সহায় ভজহরি রায় বিআরবিএফ প্রকল্প থেকে অর্থ তচ্ছরূপ করেন। কোনও রেজিলিউশন ছাড়া কাজ না করেই সই জাল করে বিল দেখিয়ে অর্থ তুলে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ। দেখা যায় ব্লক আধিকারিকের কাছে প্রধানের পেশ করা নকল রেজিলিউশনে ১৪টি রাস্তায় কাজ হয়েছে বলে দেখানো হয়েছে। কিন্তু, কার্যক্ষেত্রে মাত্র ৪টি রাস্তায় কাজের হিসাব পাওয়া যায়। এমনকী যে চার রাস্তায় কাজ হয়েছে তাতেও প্রচুর গোলমাল ধরা পড়ে। এমনকী এই অর্থ তচ্ছরূপে নাম জড়ায় তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতিরও। অভিযুক্ত প্রধানের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে এবং পুলিশে অভিযোগ দায়েরের জন্য বোর্ডের কিছু সদস্য জেলাশাসক থেকে শুরু করে পুলিশ সুপারের কাছে আবেদন করে।
এই নিয়ে শেষমেশ পুলিশে অভিযোগও দায়ের হয়। অভিযোগ অভিযুক্ত প্রধান স্বপ্না নস্কর, উপপ্রধান এবং নির্মাণ সহায়কের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া সম্ভব হয়নি। উল্টে তৎকালীন ব্লক আধিকারিক বিষয়টি শান্তিপূর্ণভাবে মিটিয়ে নেওয়ার জন্য তৃণমূল-এর বোর্ড সদস্যদের পরামর্শ দেন। এতে আরও ক্ষুব্ধ হন পঞ্চায়েত বোর্ডের সদস্যরা।
অভিযোগ, এই ঘটনার পর প্রধান স্বপ্না নস্করের সাহস আরও বৃদ্ধি পায়। যে কোনও ধরনের দুর্নীতি নাকি স্বপ্না নস্করের কাছে এখন জলভাত বলে অভিযোগ। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় স্বপ্না ও উপপ্রধান এবং স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগে সরব তৃণমূল কংগ্রেসরই একাংশ। অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় এবং নির্মল মিশন বাংলার আওতাধীন প্রকল্পে যে সব ইঁট সরবরাহ করা হচ্ছে তা মাটির ডেলা ছাড়া আর কিছুই নয়। কোনও পেশাদার সংস্থার কাছ থেকে এই ইঁট কেনা হচ্ছে না বলে অভিযোগ। প্রধানের ঠিক করা লোকজনই ভিতরে ভিতরে টেন্ডার ভরে এই ইঁট বিক্রির বরাত নিয়ে নিচ্ছে। এত নিম্নমমানের ইঁট দেওয়া নিয়ে ইতিমধ্যে ব্লক আধিকারিকের কাছেও অভিযোগ জানানো হয়। কিন্তু, তাতেও কোনও লাভ হয়নি। উল্টে এই জালিয়াতি আরও রমরমিয়ে বেড়েছে বলে অভিযোগ।
এখানেই শেষ নয় খাল সংস্কারে অর্থ খরচ হয়েছে বলে হিসাবও পেশ করেন স্বপ্না নস্কর। কিন্তু, শাঁকসহর গ্রাম পঞ্চায়েতের এলাকায় কোথাও খালই নেই। তাহলে খাল পেলেন কোথায় স্বপ্না। অভিযোগ, মাটির দেওয়াল তোলার জন্য অনেকে জমির মধ্যে থেকে লম্বা নালির মতো কেটে মাটি তুলেছিলেন। স্বপ্না এবং তাঁর দুর্নীতিবাহিনী ওই মাটির গর্তকেই খাল বলে চালিয়ে কয়েক লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলেও অভিযোগ।
স্বপ্নার দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্তও হয়েছিল। সেই রিপোর্টেও স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয় যে স্বপ্না এবং উপপ্রধান, নির্মান সহায় যে ভাবে কাজ করেছে বিভিন্ন খরচের খতিয়ান পেশ করেছেন তার কোনও বৈধতাই নেই। এমনকী, যেভাবে রেজিলিউশন পাশ করানোর কথা বলা হয়েছে তাতে স্পষ্ট যে এ সমস্তই হয়েছে জালিয়াতি করে। এমনকী, ওই তদন্ত রিপোর্টে আরও বলা হয় যে পঞ্চায়েত বোর্ডের সদস্যদের সইও জাল করেছেন স্বপ্না। প্রশাসনের এমন তদন্ত রিপোর্টের পরও তা ধাপাচাপা পড়ে গিয়েছে। অভিযোগ বহাল তবিয়েতে দুর্নীতির রানি হয়েছেন স্বপ্না।
ওয়ান ইন্ডিয়া বাংলার অন্তর্তদন্তে কথা হচ্ছিল পঞ্চায়েত বোর্ডের তৃণমূল সদস্য ইসমাইল মোল্লা, শফিক মোল্লাদের সঙ্গেও। পঞ্চায়েতের দুর্নীতিতে তাঁরাও হতাশ। মানুষের সেবা করবেন বলে কংগ্রেস ছেড়ে ১৯৯৮সালে তৃণমূল কংগ্রেসে এসেছিলেন ইসমাইল, শফিকদের মতো আরও অনেকেই। বাম আমলে বহু নির্যাতন সহ্য করেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গ তাঁরা ছাড়েননি। কিন্তু, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রধানের জন্য আজ এলাকা জুড়ে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়ায় এঁরা যথেষ্টই ব্যথিত বলে দাবি করেছেন। ওয়ান ইন্ডিয়া বাংলার পক্ষ থেকে টেলিফোনে প্রধান স্বপ্না নস্করের সঙ্গে কথা বলারও চেষ্টা করা হয়। কিন্তু, কল ডাইভার্ট করে রাখায় তাঁর সঙ্গে কথা বলা যায়নি। পরে তাঁর স্বামী প্রশান্ত নস্করের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলা হয়। প্রশান্ত জানান, তাঁর নম্বরটাই এখন ব্যবহার করেন স্বপ্না। তবে তিনি বাড়ি থেকে দূরে আছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রধান স্ত্রী তাঁকে চাকরি পাইয়ে দিয়েছের অভিযোগের কথা শুনে প্রশান্ত কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি। তাঁর একটাই কথা 'বিষয়টা তেমন নয়, সে তো হয়ে গেল অনেকদিন আমি কাজ করছি'। বাড়ি ফিরে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলিয়ে দেবেন বলে ফোন কেটে দেন প্রশান্ত। এদিকে, এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে ফের প্রার্থী হতে চেয়ে দলের কাছে আবেদন করেছেন স্বপ্না।