তৃণমূল হয়েও শাসকের রোষানলে স্বপন, ফেসবুকে এলাকার করুণ চিত্র ফুটিয়েছিলেন যে
ফেসবুকের পাতায় এলাকার দুরবস্থার কথা তুলে ধরেছিলেন হাওড়ার নিশ্চিন্দার বাসিন্দা স্বপন মালাকার। মানুষের ভোগান্তির সেই কাহিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরে শাসকের রোষানলে পড়ে গেলেন তিনি।
ফেসবুকের পাতায় এলাকার করুণ দশা, এলাকাবাসীর দুরবস্থার কথা তুলে ধরেছিলেন হাওড়ার নিশ্চিন্দার বাসিন্দা স্বপন মালাকার। মানুষের ভোগান্তির সেই কাহিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরে শাসকের রোষানলে পড়ে গেলেন তিনি। নিজে তৃণমূলের কর্মী হয়েও রেহাই হল না, শ্রীঘরে স্থান হল অবশেষে। ভাতারের অমিত তবু জামিন পেয়েছিলেন, নিশ্চিন্দার স্বপন সেটুকুও পেলেন না।
হাওড়ার নিশ্চিন্দা থানার দেওয়ানচকের বাসিন্দা স্বপন মালাকার। স্থানীয় রাজচন্দ্রপুর বিদ্যাসাগর সরণির রাস্তার বেহাল দশা ও মানুষের ভোগান্তির নানান কাহিনী সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করেছিলেন তিনি। এলাকার রাস্তাঘাটের দুরবস্থার কাহিনি ফেসবুকের পাতায় প্রকাশ করে দায়িত্বশীল নাগরিকের ভূমিকা পালন করতে গিয়ে নিজেই নিজের 'বিপদ' ডেকে আনলেন।
শাসকদলের হুমকির শিকার তো হলেনই, তারপর পুলিশকে কাজে লাগিয়ে স্বপন মালাকারকে গ্রেফতার করা হল পরিকল্পনা করেই। তা ভিডিও করা হল তৃণমূলের দ্বারা। এতদিন যে দল করেছেন, সেই দলের কাছ থেকেও কোনও সাহায্য পেলেন না। এলাকার বিধায়ক-মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফোন করে আশ্বাসই সার হল তাঁদের। স্বপন মালাকারের স্ত্রী জয়শ্রীদেবীর অভিযোগ, রাজীববাবু তাঁকে আশ্বাস দিলেও, এগিয়ে আসননি কোনও অজানা কারণে।
দেওয়ানচক এলাকার রাস্তায় হাইড্রেন করা নিয়েই বিপত্তি বাধে। ঢালাই করে তিন-চারফুট উঁচু করে দেওয়া হয় রাস্তা। এর ফলে এলাকার অধিকাংশ বাড়িই রাস্তার থেকে নিচু হয়ে যায়। ফলে বৃষ্টি হলেই জল ঢুকে যায় ঘরের ভিতরে। এলাকার হাবুডুবু অবস্থা। এইসব চিত্রই কাহিনি আকারে নিজের ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট করেছিলেন স্বপনবাবু। সেই ফেসবুক পোস্ট যে বিপদ ডেকে আনছে স্বপ্নেও ভাবেননি তিনি।
জয়শ্রীর কথায়, তাঁর স্বামী স্বপন তৃণমূল বিধায়ক তথা মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুগামী হিসেবে এলাকায় পরিচিত। কিন্তু এলাকায় দাপট রাজীব বিরোধী গোষ্ঠীর। স্থানীয় তৃণমূল নেতা পরিমল চক্রবর্তী স্বপনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন, এরপরই সোমবার রাত ১১টা নাগাদ পুলিশ আসে স্বপনের বাড়িতে। নিশ্চিন্দা থানা থেকে কাশীনাথ মণ্ডল নামে এক পুলিশ অফিসার স্বপনের বাড়িতে ঢুকে স্বপনকে গ্রেফতার করেন। স্বপনের মোবাইলও চেক করেন।
স্বপনের স্ত্রী জয়শ্রী জানান, পুলিশ তাঁকে বলে আপনার স্বামী ফেসবুকে বিভিন্ন পোস্ট করেছেন, সেই কারণেই তাঁকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। অভিযোগ, স্বপনকে নিয়ে বাড়ির বাইকে বের হতেই সেই ঘটনা ভিডিও করা হয়। এবং এই ভিডিও করেন তৃণমূলের স্থানীয় কিছু নেতা-কর্মী। কেন তা করা হল, যদি দরকারই থাকে ভিডিও করার, কেন পুলিশ করল না, প্রশ্ন তোলেন জয়শ্রী।
স্বপনের বিরুদ্ধে পরিমলকে মারধরের অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগ, স্বপন মালাকারের সঙ্গে যখন পরিমল চক্রবর্তী কথা বলতে এসেছেনছিলেন হাইড্রেন নিয়ে, তখন স্বপন পরিমলের উপর হামলা করে। কিন্তু জয়শ্রীর দাবি, এমন কোনও ঘটনা ঘটেনি। পরিমল চক্রবর্তীকে আমার স্বামী সরাসরি চেনেনও না। তিনি বলেন, এখন আমার প্রশ্ন, আমার স্বামী ফেসবুকে কোনও আপত্তিকর পোস্ট করেননি, কাউকে গালমন্দ করেনি, শুধু এলাকার দুরবস্থার ছবি তুলে ধরেছিল, মানুষের দুর্দশার কথা বলেছিল, তবু কেন তাঁকে গ্রেফতার হতে হল?
তাঁর অভিযোগ, মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে আমার স্বামীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু এর শেষ দেখে ছাড়ব আমরাও। এদিন হাওড়া আদালতে পেশ করা হয় স্বপন মালাকারকে। কিন্তু আদালত জামিন নাকচ করে দিয়ে জেল হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন। আগামী ২৩ অগাস্ট ফের মামলাটি উঠবে, আমরা ফের জামিনের আবেদন করব।
এই ঘটনায় স্বপন মালাকার ও তাঁর পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে 'আক্রান্ত আমরা'। 'আক্রান্ত আমরা'র আহ্বায়ক অম্বিকেশ মহাপাত্র জানান, ফের রাজ্যে স্বাধীন মতপ্রকাশের মৌলিক অধিকারের উপর আক্রমণ হল রাজ্যে। আমরা রাজ্য প্রশাসনের এই আক্রমণের বিরুদ্ধে এক হয়ে লড়ব। আমাদের প্রতিবাদী সত্ত্বা ফের গর্জে উঠবে। 'আক্রান্ত আমরা'র এক প্রতিবাদী মুখ প্রতিমা দত্ত রয়েছেন বালির নিশ্চিন্দা এলাকায়। তাঁকে আমরা বিষয়টি খোঁজখবর নিতে বলেছি। আমি নিজেও কথা বলেছি স্বপন মালাকারের স্ত্রীর সঙ্গে। তাঁর লড়াইয়ে আমরাও পাশে আছি।
তিনি বলেন, ৭১ বছর স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর 'ভারতীয় সংবিধান' প্রদত্ত মৌলিক অধিকার হল স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার। রাজ্যের এই সরকারের আমলে তা বারেবারে আক্রান্ত হচ্ছে। শাসকদল এবং পুলিশ প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে আক্রমণ নেমে আসছে। আক্রমণ এই প্রথম নয়। আর এটা বিছিন্ন ঘটনাও নয়। পরিকল্পনামাফিক নিরবচ্ছিন্ন ঘটনা এটা। এর আগে তাঁর নিজের সঙ্গে এই ঘটনা ঘটেছে। শিলাদিত্য চৌধুরী, তানিয়া ভরদ্বাজ, রোহিত পাসি, অমিত ঘোষ, অতঃপর স্বপন মালাকার।
তিনি বলেন, ধিক্কার পুলিশ প্রশাসনকে। ধিক্কার সরকারকে। স্বাধীন দেশে স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার রক্ষা করতে হবে। সেজন্য সকল গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ নিজের মত প্রকাশের অধিকারের দাবিতে প্রতিবাদে সোচ্চার হোন। সেইসঙ্গে সবাই গর্জে উঠুন স্বপন মালাকারের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে।