অদ্ভুত সমাপতন! পাহাড়ের রাজনীতিতে নতুন যুগের সূচনায় ‘গুরু’র রাজপাট ‘শিষ্যে’র হাতে
অদ্ভুত সমাপতন! পাহাড়ের রাজনীতিতে নতুন যুগের সূচনায় ‘গুরু’র রাজপাট ‘শিষ্যে’র হাতে
আবহাওয়ার মতোই খামখেয়ালি পাহাড়ের রাজনীতি। কখনও মেঘ, কখনও রোদ্দুর। তেমনই প্রতিনিয়ত পতন আর উত্থানের খেলা চলে পাহাড়ের রাজনীতিতে। আর সেই উত্থান-পতনের সরণি বেয়ে পাহাড় রাজনীতিতে তৈরি হয় পরম্পরা। গুরুর রাজপাট কালের নিয়েম উঠে আসে শিয্যের হাতে। ঠিক যেমন ১৪ বছর আগে হস্তান্তরিত হয়েছিল ক্ষমতা, ২০২২-এও তার প্রতিচ্ছবি।
ঘিসিং থেকে গুরুং, গুরুং থেকে অনীত থাপা
২০০৮ সালে গুরু সুবাস ঘিসিংকে টপকে উল্কার মতো উত্থান হয়েছিল বিমল গুরুংয়ের। এবার সেই গুরুং-জমানার অবসান ঘটিয়ে পাহাড় রাজনীতিতে অধিষ্ঠিত হলেন অনীত থাপা। বিমল গুরুং যেমন ছিলেন সুবাস ঘিসিংয়ের জিএনএলএফের অন্যতম কাণ্ডারি, সেই দল থেকে বেরিয়ে এসে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা গঠন করে পাহাড়ের রাজনীতিতে প্রতিভাত হয়েছিলেন, তেমনই গুরুংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে নতুন দল গড়ে অনীত থাপা হয়ে উঠলেন পাহাড় রাজনীতির নিয়ন্তা।
‘গুরু’ বিমলের পতন, ‘শিষ্য’ অনীতের উত্থান
একুশের বিধানসভা নির্বাচনের পরই অনীক থাপা গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন দল গড়েছিলেন। নতুন দলের নাম দিয়েছিলেন ভারতীয় গোর্খা প্রজাতান্ত্রিক মোর্চা, সংক্ষেপে বিজিপিএম। এবার অনীত থাপার সেই বিজিপিএমই পাহাড় রাজনীতিতে পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে এল জিটিএ নির্বাচনে জিতে। 'গুরু' বিমল গুরুংয়ের পতনের পথ ধরে উত্থান হল 'শিষ্য' অনীত থাপার।
গুরুংয়ের দল থেকে বেরিয়েই নতুন দল অনীতের
অনীত থাপা ছিলেন বিমল গুরুংয়ের দল গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার প্রথম সারির নেতা। পাহাড়ে হিংসার ফলে গুরুংয়ের অপসারণের পর বিনয় তামাং ও অনীত থাপাই হয়ে ওঠেন দলের প্রধান কাণ্ডারি। বিমল গুরুং তিন বছর পর পাহাড়ে ফিরলে বিনয় ও অনীত উভয়েই সরে আসেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা থেকে। বিনয় তামাং যোগ দেন তৃণমূলে। আর অনীত গড়েন নতুন দল ভারতীয় গোর্খা প্রজাতান্ত্রিক মোর্চা।
পাহাড় রাজনীতিতে পরম্পরা মেনে উত্থান ও বিরাট জয়
এবার অনীতের সেই ভারতীয় গোর্খা প্রজাতান্ত্রিক মোর্চা জিটিএ নির্বাচনে বিপুল জয়লাভ করে। ৪৫ আসনের মধ্যে ২৭ আসনে জয়ী হয়ে জিটিএর দখল নেয় অনীতের দল। সেইসঙ্গে চারজন নির্দল প্রার্থীও রয়েছেন তাঁর সমর্থনে। রয়েছে বাংলার শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসও। অর্থাৎ পায়ের তলার জমি শক্ত করেই পাহাড় রাজনীততে জমিয়ে বসলেন অনীত থাপা। বিগত তিন বছর ধরে তিনিই জিটিএ চালাচ্ছিলেন। আর পাঁচ বছর তাঁর হাতেই জিটিএ-র ভার। অতএব পাহাড় রাজনীতিতে পরম্পরা মেনে তাঁর উত্থান হল বলাই যায়।
সুবাস ঘিসিংয়ের গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন থেকে শুরু
১৯৮০ সালে সুবাস ঘিসিং গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট বা জিএনএলএফ প্রতিষ্ঠা করার পর থেকেই পাহাড়ে দাপট শুরু জনজাতি গোষ্ঠীর। ১৯৮৮ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন সুবাস ঘিসিং। তিনিই বাংলায় গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তখন থেকেই দার্জিলিং জেলায় বসবাসকারী গোর্খাদের পৃথক রাজ্যের দাবি জোরালো হতে শুরু করে।
ডিজিএইচসি-র নির্বাচনে হ্যাটট্রিক ছিল ঘিসিংয়ের
১৯৮৬ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত সুবাস ঘিসিংয়ের নেতৃত্বে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন চলেছিল। বাংলায় দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমস্যাটি অস্থায়ী সমাধান হয়েছিল। দু'বছরের সহিংস আন্দোলনে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার দার্জিলিং পাহাড়ে একটি আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রশাসনিক সংস্থা দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল গঠন করে। প্রথম কাউন্সিল নির্বাচনে জয়ী হয়ে ঘিসিং চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ২০ বছর ধরে ওই ডিজিএইচসি-র চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। তিনবার ডিজিএইচসি-র নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল ঘিসিংয়ের জিএনএলএফ।
সুবাস ঘিসিং-এর বিশ্বস্ত সহযোগী ছিলেন বিমল গুরুং
২০০৪ সালে চতুর্থ দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল বা ডিজিএইচসি-র নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। সরকার নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরিবর্তে সুভাষ ঘিসিংকে ডিজিএইচসি-র-একমাত্র তত্ত্বাবধায়ক মনোনীত করে সরকার। দার্জিলিং পাহাড়ে ষষ্ঠ তফসিল উপজাতি পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত এই ঘোষণা কার্যকর করা হয়। কিন্তু ষষ্ঠ তফসিল উপজাতি পরিষদ স্থাপনের বিরোধিতা করেছিল বেশিরভার রাজনৈতিক দলই। ডিজিএইচসির প্রাক্তন কাউন্সিলরদের মধ্যেও যখন দ্রুত ক্ষোভ বেড়ে চলেছে, তখন ঘিসিং-এর বিশ্বস্ত সহযোগী বিমল গুরুং জিএনএলএফ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
গুরুংয়ের পথে হেঁটেই নতুন দল গড়ে চমক অনীতের
প্রবল বিক্ষোভের মুখে ঘিসিং ২০০৮ সালে ডিজিএইচসি-র চেয়ারম্যান পদ থেকে ইস্তফা দেন। তখনই বিমল গুরুং-এর নেতৃত্বে গঠিত হয় একটি নতুন দল গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। জিএনএলএফের অধিকাংশ সমর্থন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার দিকে চলে যায়। শুরু হয় বিমল গুরুং জমানা। পাহাড়ের রাজনীতিতে নতুন নায়কের উত্থান হয়। একইভাবে বিমল গুরুংয়ের দল থেকে বেরিয়ে এসে ভারতীয় গোর্খা প্রজাতান্ত্রিক মোর্চা নামে নতুন দল গড়ে পাহাড়ে নতুন ইতিহাস রচনা করলেন অনীত থাপা। রয়ে গেল 'গুরু-শিষ্যে'র পরম্পরার ঐতিহ্য।
গুরুংয়ের থেকে পাহাড়ের সমর্থন ছিনিয়ে নেন অনীত
২০০৮ সালে সুবাস ঘিসিং পাহাড় থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে জলপাইগুড়ি চলে গিয়েছিলেন। ২০১১-য় পাহাড়ে ফিরেও তিনি রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা ফেরাতে পারেননি। বিমল গুরুংয়ের হাতেই সেই থেকে দীর্ঘদিন ছিল পাহাড়ের শাসন। তিনিও ২০১৭ সালে পাহাড় অশান্ত হওয়ার পর দার্জিলিং ছেড়েছিলেন। তিন বছর পর পাহাড়ে ফিরেও পায়ের তলার জমি ফিরে পাননি। ২০২১-এর ভোটের আগে পাহাড়ে ফিরেও জনসমর্থন আদায় করতে ব্যর্থ হন। গুরুংয়ের দলেরই এক 'অনুগত' সৈনিক অনীত থাপা নতুন দল গড়ে পাহাড়ের সমর্থন ছিনিয়ে নেন। সেই প্রেক্ষাপটেই বিরাট জয়লাভ করে পাহাড়ের ক্ষমতায় আসীন হলেন তিনি।
ছবি সৌ:টুইটার
২০২৪-এ পাহাড়ে অ্যাডভান্টেজ তৃণমূল! জিটিএ-শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদ দিল অক্সিজেন