ঘন অন্ধকার ভেদ করে আলোর দিশা দেখানো মিলখা সিংয়ের জীবন এক উপন্যাস
অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণ, মিলখা সিংয়ের জীবন যেন হাজার পাতার উপন্যাস
এক অদম্য জেদ কাজ করেছে বরাবর। শৈশব থেকেই বড় মানুষ হওয়ার স্বপ্ন বুকে পালন করতেন মিলখা সিং। কীভাবে সম্ভব, কতটা সম্ভব, তা না জেনেই অজানা চ্যালেঞ্জ নিয়ে বাকিদের চমকে দিতেন, পথ দেখাতেন কিংবদন্তি অ্যাথলিট। তাঁর প্রয়াণে পুরনো কথাগুলিই মনে পড়ছে মিলখা ঘনিষ্ঠদের। বক্তব্য, অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরা কিংবদন্তির জীবন যেন হাজার পাতার উপন্যাস। সেদিকে নজর ফেরানো যাক।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
১৯২৯ সালের ২০ নভেম্বর ব্রিটিশ শাসিত পাঞ্জাব প্রভিন্সের মুজাফফরগড় জেলার গোবিন্দপুরা গ্রামে (বর্তমান পাকিস্তান) সম্ভ্রান্ত শিখ পরিবারে মিলখা সিংয়ের জন্ম। তাঁর ১৫ ভাই-বোনের আট জন দেশভাগের আগেই মারা যান। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার আবহে ছড়িয়ে পড়া দাঙ্গায় মিলখার বাবা-মা, ভাই ও দুই বোনকে হত্যা করা হয়েছিল। এক লহমায় অনাথ হয়ে যাওয়া কিংবদন্তি অ্যাথলিট কিশোর বয়সে হত্যালীলা চাক্ষুস করে অনেক পরিণত হয়ে গিয়েছিলেন। কোনও ভাবে প্রাণ বাঁচিয়ে একাই দিল্লির শরণার্থী শিবিরে ঠাঁই খুজে নিয়েছিলেন মিলখা সিং। কিছুদিন বিবাহিত দিদি পরিবারে জীবন কেটেছিল তাঁর। এই সময়ে অবস্থার প্রেক্ষাপটে কার্যত দস্যুবৃত্তিতেও নেমে পড়েছিলেন ভারতীয় তারকা। বিনা টিকিটে ট্রেনে ওঠার অপরাধে তিহার জেলেও একরাত কাটাতে হয়েছিল মিলখাকে।
সেনাবাহিনীতে সুযোগ এবং উত্থান
শৈশবেই অভিভাবকহীন হওয়া মিলখা সিং ভারতীয় সেনায় ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। ১৯৪৯ সালে প্রথমবার ভারতীয় সেনায় ভর্তির পরীক্ষা দিয়েছিলেন মিলখা। অকৃতকার্য হয়েছিলেন। ১৯৫০ সালেও ব্যর্থ হয়েছিল তাঁর প্রচেষ্টা। এরপর রবার কারখানায় কাজ করতে শুরু করেছিলেন মিলখা। অনেক কষ্ট করে ১৯৫২ সালে পরিশেষে ভারতীয় সেনায় চাকরি পেয়েছিলেন কিংবদন্তি। শুরুতে ৩৯ টাকা ৮ আনা বেতন পেতেন প্রয়াত অ্যাথলিট। ভারতীয় সেনাতেই তাঁর প্রতিভা বিকশিত হয়েছিল। তিনি জাতীয় মোকাবিলার জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। শুরু হয়েছিল ট্রেনিং। সফল অ্যাথলিট হওয়ার যাত্রা সেখান থেকেই শুরু করেছিলেন মিলখা সিং।
মিলখা সিংয়ের আন্তর্জাতিক কেরিয়ার
১৯৫৬ সালের মেলবোর্ন অলিম্পিক্সে প্রথমবার আন্তর্জাতিক ট্র্যাকে নেমেছিলেন মিলখা সিং। গেমসের ২০০ এবং ৪০০ মিটার ইভেন্টে অংশ নিলেও দুই ক্ষেত্রেই প্রথম রাউন্ড থেকে তিনি ছিটকে গিয়েছিলেন। সেখানেই ৪০০ মিটার ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের অলিম্পিক্স চ্যাম্পিয়ন চার্লস জেনকিনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল। মার্কিন কিংবদন্তির পরামর্শ এবং প্রশিক্ষণ কৌশলে তাঁর জীবন পাল্টে গিয়েছিল বলে জানিয়েছিলেন মিলখা সিং। ১৯৫৮ সালে কটকে অনুষ্ঠিত হওয়া জাতীয় গেমসের ২০০ ও ৪০০ মিটার ইভেন্টে তিনি রেকর্ড গড়েছিলেন। ১৯৫৮ সালের কার্ডিফ কমনওয়েলথ গেমসে সোনা জিতেছিলেন মিলখা। ওই বছরের টোকিও এশিয়ান গেমসের ২০০ ও ৪০০ মিটার ইভেন্টে তিনি প্রথম হয়েছিলেন। ১৯৬২-এর জাকার্তা এশিয়ান গেমসেও দুটি সোনা জিতেছিলেন মিলখা সিং। ১৯৬০ সালের রোম অলিম্পিক্সের ৪০০ মিটার ইভেন্টে চতুর্থ হলেও নিজেরই জাতীয় রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিলেন কিংবদন্তি।
মিলখা বনাম খালিক
সেই সময় পাকিস্তানের কিংবদন্তি অ্যাথলিট আব্দুল খালিকের যশ এবং খ্যাতি ছিল আকাশ ছোঁয়া। ১৯৫৮ সালের এশিয়ান গেমসের ১০০ মিটার ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড থেকে সোনা জিতেছিলেন ওই প্রাক্তন পাকিস্তানি তারকা। সেই ব্যক্তিকে ওই এশিয়ান গেমসের ২০০ মিটার ইভেন্টে হারিয়ে ইতিহাস রচনা করেছিলেন মিলখা সিং। দুই অ্যাথলিটের ঘোষিত শত্রুতা শুরু হয়েছিল সেখান থেকেই। ভারত-পাকিস্তান মৈত্রীর পরিবেশ বজায় রাখতে দুই দেশের রাষ্ট্রনেতার উদ্যোগে ১৯৬০ সালে এক স্পোর্টস মিট আয়োজন করা হয়েছিল। লাহোরে হওয়া ওই প্রতিযোগিতায় শত্রু আব্দুল খালিককে ফের হারিয়ে দিয়েছিলেন মিলখা সিং। ভারতীয় অ্যাথলিটের দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে 'উড়ন্ত শিখ' নামে সম্বোধন করেছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট তথা সেনাপ্রধান জেনারেল আয়ুব খান। যদিও পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত হওয়া ওই প্রতিযোগিতায় অংশই নিতে চাননি মিলখা। যেখানে তাঁর বাবা-মাকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছিল, সে দেশ তাঁর কাছে দুঃস্বপ্ন বলে জানিয়েছিলেন ভারতীয় কিংবদন্তি। শেষে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর কথায় তিনি ওই প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে রাজি হয়েছিলেন। ১৯৬৪ সাল তিনি ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডকে বিদায় জানিয়েছিলেন।
পুরস্কার ও ব্যক্তিগত জীবন
১৯৫৯ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন মিলখা সিং। নিজের কৃতিত্বের বলে ভারতীয় সেনার ক্যাপ্টেন পদাধিকার পেয়েছিলেন। ১৯৬৩ সালে দেশের প্রাক্তন ভলিবল খেলোয়াড় নির্মল কৌরের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন মিলখা সিং। করোনা ভাইরাসের জেরে যে জীনবসঙ্গীকে হারানোর পাঁচ দিনের মধ্যেই না ফেরার দেশে চলে গেলেন কিংবদন্তি অ্যাথলিটও। তিন কন্যা ও এক পুত্রের (জীভ মিলখা সিং) বাবা মিলখার শেষ জীবন চণ্ডীগড়ে কেটেছে। তাঁর পালিত পুত্র ভারতীয় সেনার হাভিলদার বিক্রম সিং কারগিলের যুদ্ধে শহিদ হয়েছিলেন। খেলা ছাড়ার পর একাধিক সরকারি পদে আসীন ছিলেন ভারতীয় কিংবদন্তি। মিলখা সিংয়ের জীবনীর ওপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া হিন্দি সিনেমা বক্স অফিসে সাড়া ফেলে দিয়েছিল।