টোকিও অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ জিতে ইতিহাস গড়া সিন্ধুর সঙ্গে সাইনার দ্বন্দ্ব ফের প্রকাশ্যে
প্রথম মহিলা ভারতীয় তথা দ্বিতীয় ভারতীয় ক্রীড়াবিদ হিসেবে অলিম্পিকে দুটি পদক জিতেছেন পিভি সিন্ধু। ২০১৬ সালের রিও অলিম্পিকে জিতেছিলেন রুপো, এবার ব্রোঞ্জ। ইতিহাস গড়ার পরেও সামনে চলে এল পিভি সিন্ধুর সঙ্গে অপর অলিম্পিয়ান শাটলার সাইনা নেহওয়ালের প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব। সোশ্যাল মিডিয়াতে তো বটেই, সিন্ধুকে অভিনন্দন জানানোর প্রয়োজনই বোধ করেননি ২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিকে ব্রোঞ্জজয়ী সাইনা।
সাইনার সঙ্গে দূরত্ব
পিভি সিন্ধু আজ ভার্চুয়াল সাংবাদিক বৈঠকে এক প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছেন, জাতীয় ব্যাডমিন্টন কোচ পুল্লেলা গোপীচাঁদ তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে বার্তা পাঠিয়েছেন। তবে সাইনার কোনও বার্তাই তাঁর কাছে আসেনি। সিন্ধু বলেন, আমি এখনও সোশ্যাল মিডিয়া সেভাবে দেখার সুযোগ পাইনি। তবে ধীরে ধীরে সকলকেই প্রত্যুত্তর দেব। কিন্তু সাইনার থেকে কোনও মেসেজ পাইনি। আমাদের মধ্যে খুব বেশি কথাও হয় না আজকাল।
প্রশংসা থেকে বিরত
সাইনা নেহওয়াল যে সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব সক্রিয় সেটা নয়। তবে আজ একটি বিষয় সকলেরই নজরে এসেছে। ভারতীয় মহিলা হকি দলের সেমিফাইনালে ওঠার ভিডিও দিয়ে পি কাশ্যপ একটি টুইট করেছিলেন। সেটিকে সাইনা রিটুইট করেছেন। ফলে তিনি ইচ্ছা করলে আজও সেই রিটুইটের আগে বা পরে সিন্ধুকে সোশ্যাল মিডিয়াতেই অভিনন্দন জানাতে পারতেন। কিন্তু সেটা তিনি করেননি। ভারতীয় ব্যাডমিন্টনে সিন্ধুর সঙ্গে সাইনার ইগোর লড়াই বা সম্পর্ক তলানিতে ঠেকা নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। তবে যেটা সবচেয়ে বেশি শোনা যায় তা হল, বেঙ্গালুরুতে প্রাক্তন ভারতীয় কোচ বিমল কুমারের কাছে প্রশিক্ষণের পর সাইনা ফের গোপীচাঁদের কাছে প্রশিক্ষণ নিতে ২০১৭ সালে ফিরে আসতেই সাইনা ও সিন্ধুর দূরত্ব বাড়ে।
ইগোর লড়াই?
সাইনা অলিম্পিকে একটি অলিম্পিক পদক পেয়েছেন। সিন্ধুর আবার একটি রুপো-সহ দুটি অলিম্পিক পদক ঝুলিতে রয়েছে। আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টেও সিন্ধুর সাফল্য ছাপিয়ে গিয়েছে সাইনাকে। হতে পারে এতেই বেড়়েছে ইগোর লড়াই। তবে অলিম্পিয়ান তথা ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের আয়রন লেডি বলে পরিচিত মধুমিতা বিস্ত ওয়ানইন্ডিয়া বেঙ্গলিকে বলেছিলেন, দুজনের মধ্যে তুলনা করা ঠিক নয়। এটা মানতেই হবে সাইনার জন্যই বেশ কয়েক বছর পর ভারতীয় মহিলা ব্যাডমিন্টন আলোকিত হয়, আকর্ষণ বাড়ে। বরং বলা ভালো, সাইনার উত্তরাধিকার বহনেরই দায়িত্ব সিন্ধুর হাতে। উল্লেখ্য, এবার বিভিন্ন টুর্নামেন্ট করোনার কারণে বাতিল হওয়ায় সাইনা অলিম্পিকের যোগ্যতা অর্জনেই ব্যর্থ হন। কিন্তু তারপরও সিন্ধুর সঙ্গে তাঁর দূরত্ব যেভাবে সামনে এল তা যথেষ্ট দৃষ্টিকটু এবং ভারতীয় ক্রীড়াক্ষেত্রের পক্ষেও যথেষ্ট অশোভন। অলিম্পিকের আগে অনুরাগ ঠাকুরের শুভেচ্ছাবার্তা-সমৃদ্ধ টুইট রিটুইটের পর আজ হকি ম্যাচের পর কাশ্যপের টুইট সাইনা রিটুইট করেছেন। এমনকী মীরাবাঈ চানু, লাভলিনা বরগোঁহাই, সিন্ধুদের অভিনন্দন জানানোর সময়ই পাননি তিনি!
গোপীর অভিনন্দন-বার্তা
করোনা পরিস্থিতিতে বেশ কয়েক মাস অনুশীলন ব্যাহত থাকার পর মাস তিনেকের জন্য লন্ডনে চলে গিয়েছিলেন সিন্ধু। তখন ব্যাডমিন্টন মহলে শোরগোল পড়ে যায় গোপীচাঁদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হতেই সিন্ধু লন্ডনে গিয়েছেন। এরপর দেশে ফিরেও গোপীচাঁদের আকাদেমিতে নয়, গাচ্চিবৌলি ইনডোর স্টেডিয়ামে পার্ক তাই-সুংয়ের কাছে অলিম্পিকের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন সিন্ধু। ভারতীয় দলের চিফ ব্যাডমিন্টন কোচ গোপীচাঁদের সঙ্গে মনোমালিন্যের জেরেই এই সিদ্ধান্ত বলে জল্পনা শুরু হয়। ভারতীয় পুরুষ দলের কোচ আগাস সান্তোসো, যিনি বি সাই প্রণীতকে কোচিং করাচ্ছিলেন, তিনি যাতে টোকিওয় যেতে পারেন সে কারণে গোপী অলিম্পিকে যাননি। কিন্তু গতকাল সিন্ধুর জয়ের পর তিনি সিন্ধুর প্রশংসা করে বিবৃতিও দেন, সিন্ধুকে মেসেজও করেন।
পার্কের স্বপ্নপূরণ
অলিম্পিকের আগে সিন্ধু প্রশিক্ষণ নেন দক্ষিণ কোরিয়ার পার্ক তাই-সুংয়ের কাছে। গতকালও সিন্ধুর ব্রোঞ্জ জয়ের পর পার্কের আবেগ ছিল লক্ষ্যণীয়। ২০১৯ সালে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের পরই চলে গিয়েছিলেন কোচ কিম জি হিয়ন। ফলে ভারতীয় পুরুষ শাটলারদের প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে এলেও শেষে সিন্ধুর কোচিংয়ের ভার পড়ে পার্কের উপর। সিন্ধুর সাফল্যে উচ্ছ্বসিত বছর ৪২-এর পার্ক বলেন, আমার কোচিংয়ে কেউ অলিম্পিক পদক পেয়েছেন ভেবে ভালো লাগছে। ২০০৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার হয়ে এথেন্স অলিম্পিকে খেলা পার্ক নিজের দেশের জাতীয় দলের কোচও ছিলেন। পার্ক বলেন, আমি যখন সিন্ধুকে কোচিং করাতে শুরু করি তখন তিনি অলিম্পিকের তারকা। এতে আমি চাপও অনুভব করছিলাম। আমার কোরিয়ান প্লেয়াররা অলিম্পিক পদক পাননি। তাই আমি চেয়েছিলাম সিন্ধু যাতে সোনা পান। সেটা হয়নি। তবে মনে রাখতে হবে ব্রোঞ্জও কিন্তু কম বড় পদক নয়।
উত্তেজনার কারণ
সিন্ধুর খেলা চলাকালীন পার্ককে বেশ কিছুটা উত্তেজিত লাগছিল, দিচ্ছিলেন নানা পরামর্শ। সেমিফাইনালে হারের পর সিন্ধুকে পার্ক বলেছিলেন, আরও একটি ম্যাচ তোমার হাতে রয়েছে, সেটায় ফল ভালো করতে হবে। সিন্ধু আস্থার মর্যাদা দেওয়ায় তৃপ্ত পার্ক বলেন, সিন্ধু শুধু নন, অনেক খেলোয়াড়কেই দেখা যায় ভালো পয়েন্ট পাওয়ার পরের পয়েন্টটাই হাতছাড়া করতে। তাই পরিকল্পনামতো সিন্ধু না খেলতেই আমি চেঁচিয়ে উঠছিলাম। তাঁকে বলি, চাপ নিও না। খেলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত শান্ত থেকে ভালো ফল করতে হবে। সিন্ধুকে পদক জিতিয়ে এবার নিজের তিন বছরের কন্যাসন্তানের সঙ্গে সময় কাটাতে মুখিয়ে রয়েছেন পার্ক। তিনি বলেন, গত বছর ফেব্রুয়ারি থেকে মাত্র ১৩ দিনের জন্য পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে পেরেছি। এখন দেশে ফিরতে পারব ভেবে ভালো লাগছে। তবে কোরিয়াতেও করোনা সংক্রমণ রয়েছে। ভারত থেকে গেলে নিভৃতবাসেও থাকতে হবে। তবু পরিবারের কাছেই এখন দ্রুত পৌঁছাতে চান পার্ক।