বিশ্ব ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়নশিপ: তিন দশকের খরা কাটিয়ে সিন্ধু-সাইনা’র হাত ধরে এগিয়ে চলেছে ভারত
এক দশকেরও বেশি সময় বিশ্ব ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়নশিপের মঞ্চ আলোকিত করে রেখেছে ভারতীয় শাটলার'রা। ২০১১ থেকে যে সাফল্যে পথ চলা শুরু হয়েছিল তা এখনও অক্ষূন্য। জ্বালা গুট্টা এবং অশ্বিনি পোনাপ্পার জু'টি সে বছর ব্রোঞ্জ এনে দিয়েছিল ভারত'কে।
জ্বালা এবং অশ্বিনি'র এই জয় ছিল দীর্ঘ প্রতিক্ষার ফসল। যেমনটা চাতক পাখি এক ফোঁটা জলের জন্য আকাশের দিকে চেয়ে থাকে ঠিক তেমনই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে পদক পাওয়ার জন্য প্রায় তিন দশক অপেক্ষা করেছিল গোটা দেশ। প্রথম ভারতীয় হিসেবে ১৯৮৩ সালে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের মঞ্চ থেকে পদক নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন প্রকাশ পাড়ুকন।
তবে, জ্বালা গুট্টা এবং অশ্বিনি পোনাপ্পা ভাঙা গাঙে যে জোয়াড় এনেছেন তা আজও বর্তমান। এর পরবর্তী ছয়টি সংস্করণে কমপক্ষে একটি করে পদক হলেও ঢুকেছে ভারতের ঝুলিতে, যা ঐতিহ্যের প্রতিযোগীতায় ভারতের মেডেল ট্যালি'র সংখ্যা বাড়িয়ে করেছে ১০।
এই দশটি পদকের মধ্যে পাঁচটি পদকই এসেছে পিভি সিন্ধু'র হাত ধরে। এই পাঁচটি পদকের মধ্যে সিন্ধুর সংগ্রহ একটি সোনা, দু'টি রূপো এবং দু'টি ব্রোঞ্জ। সিন্ধু ছাড়া বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের মঞ্চ থেকে দু'টি মেডেল এনেছেন সাইনা নেহওয়াল এবং বি সাই প্রণীত।
এক নজরে দেখে নিন ভারতের মেডেল ট্যালি:
১৯৮৩ - প্রকাশ পাড়ুকন (ব্রোঞ্জ):
কিংবদন্তি ভারতীয় শাটলার ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে আয়োজিত এই প্রতিযোগীতায় স্বপ্নের ছন্দে ছিলেন। সেমিফাইনালে পৌঁছনোর রাস্তায় চারটি ম্যাচ স্ট্রেট গেমে জেতেন প্রকাশ। শেষ চারের লড়াইয়ে ইন্দোনেশিয়ার প্রতিপক্ষ ইকুক সুগিয়ার্তো'র মুখোমুখি হন প্রকাশ। হেভিওয়েট প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রথম গেম জিতলেও পরের দু'টি গেমে হেরে যান তিনি। সেমিফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জনের সঙ্গে ব্রোঞ্জ পদক নিশ্চিত করেন প্রকাশ। একই সঙ্গে প্রথমবারের জন্য বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের মঞ্চে কোনও পদক আসে ভারতের ঝুলিতে।
২০১১- জ্বালা গুট্টা এবং অশ্বিনি পোনাপ্পা (ব্রোঞ্জ):
বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের উনবিংশ সংস্করণের আসর বসেছিল লন্ডনে। গুট্টা এবং পোনাপ্পা-ই মহিলাদের ডবলস ইভেন্টে ভারতের বাজি ছিল। অবাছাই এই জুটি ঝড় তোলে একটি গেমও না হেরে প্রবেশ করে তৃতীয় রাউন্ডে। এই জুটি'র সামনে দ্বিতীয় রাউন্ডে হারতে হয়েছিল প্রতিযোগীতার দ্বিতীয় বাছাই চেং ওয়েন-সিন এবং চিয়ান ইউ-চিন জুটিকে। কোয়ার্টার ফাইনালে প্রথম গেমে হারলেও পরের দু'টি সেমিফাইনালে জায়গা করে নেন ভারতীয় জুটি। পঞ্চম বাছাই চিনা জুটি'র কাছে হারলেও মার্কি ইভেন্টে ২৮ বছরের খরা কাটিয়ে ব্রোঞ্জ নিয়ে দেশে পারি দিয়েছিলেন জ্বালা-অশ্বিনি।
২০১৩ - পিভি সিন্ধু (ব্রোঞ্জ):
দ্বিতীয় রাউন্ডেই জাপানি প্রতিযোগী কাওরি ইমাবেপুর বিরুদ্ধে কঠিন লড়াইয়ে পড়তে হয় সিন্ধু'কে। তিনটি হাড্ডাহাড্ডি গেম জিতে পরবর্তী রাউন্ডের টিকিট অর্জন করেন সিন্ধু। কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছনোর লড়াইয়ে সিন্ধু স্ট্রেট গেমে হারান টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় বাছাই ওয়াং ইহান'তে। কোয়ার্টারের সিন্ধুর স্বপ্নের ফর্ম অব্যহত থাকে। সপ্তম বাছাই ওয়াং সিশিয়ান'কে হারিয়ে সেমিফাইনালের রাস্তা পাকা করার সঙ্গেই ব্রোঞ্জ নিশ্চিত করেন তিনি। সেমিফাইনালে রাতচানোক ইন্থাননের কাছে হারলেও প্রথম ভারতীয় হিসেবে মহিলাদের সিঙ্গলসে পদক জয়ের কৃতিত্ব অর্জন করেন তিনি।
২০১৪ - পিভি সিন্ধু (ব্রোঞ্জ):
এই সংস্করণে তৃতীয় রাউন্ডে এবং কোয়ার্টার ফাইনালে বেশ চাপে পড়তে হয় সিন্ধু'কে। দু'টি ম্যাচেই প্রথম গেম হেরে যান সিন্ধু। কিন্তু পরবর্তী দু'টি গেম জিতে নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকেন। সেমিফাইনালে ক্যালোরিনা মারিনের কাছে হেরে যাত্রা শেষ হয় সিন্ধুর। তবে, এই সংস্করণের নিজের দ্বিতীয় ব্রোঞ্জটি অর্জন করেন ভারতীয় শাটলার।
২০১৫ - সাইনি নেহওয়াল (রূপো):
দ্বিতীয় বাছাই হিসেবে এই সংস্করণে অংশ নিয়েছিলেন সাইনা। হংকং-এর প্রতিদ্বন্দ্বী চিয়ুং এন ওয়াই'কে ২১-১৩ এবং ২১-৯ ব্যবধানে হারিয়ে নিজের অভিযান শুরু করেন তিনি। কোয়ার্টার ফাইনালে ওয়াং ইয়ং'কে তিনটি গেমের দুরন্ত লড়াইয়ে হারিয়ে সেমিফাইনালে জায়গা অর্জন করেন সাইনা। শেষ চারের লড়াইয়ে স্ট্রেট গেমে লিন্ডাউনি ফেনেত্রি'কে হারান সাইনা। তাঁর পক্ষে খেলার ফল ছিল ২১-১৭ এবং ২১-১৭। সোনার আশায় গোটা যখন বুক বাঁধছে তখনই সাইনা'র ছন্দপতন। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ক্যারোলিনা'র কাছে হেরে রূপো নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাঁকে।
২০১৭ - পিভি সিন্ধু (রূপো):
বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের শুরু থেকেই ছন্দে পাওয়া যায় সিন্ধু'কে। দ্বিতীয় রাউন্ডে সিন্ধুর দ্যুতিতে ঝলসে যান কিম হো-মিন। তৃতীয় রাউন্ডে তিন গেমের লড়াইয়ে চুয়াং গান-ই'কে প্রতিযোগীতার বাইরের রাস্তা দেখান সিন্ধু। সান ইউ'কে স্ট্রেট গেমে হারিয়ে সেমিফাইনালে পৌঁছন তিনি। ২১-১৪ এবং ২১-৯ ব্যবধানে দু'টি গেম জিতেছিলেন সিন্ধু। সেমিফাইনালে সিন্ধু সামনে হার স্বীকার করতে হয় চেন ইউফেই'কে। প্রথমবার ফাইনালে পৌঁছে ঝড়ের গতিতে শুরু করেন সিন্ধু। ১৯-২১ ব্যবধানে নোজোমি ওকুহারার কাছে প্রথম গেম হেরে গেলেও ২২-২০ ব্যবধানে দ্বিতীয় গেম জিতে ম্যাচে সমতা ফিরিয়ে আনেন। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই শেষে তৃতীয় গেমে সিন্ধু পরাস্থ হন ২০-২২ ব্যবধানে। এটাই ছিল বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সিন্ধুর প্রথম রূপো।
২০১৭ - সাইনা নেহওয়াল (ব্রোঞ্জ):
সিন্ধুর মতো সাইনাও আশা জাগিয়ে দারুণ ভাবে শুরু করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেমিফাইনালের বেশি এগতে পারেননি। ওকুহারার বিরুদ্ধে হেরে ব্রোঞ্জ নিয়ে দেশে ফিরতে হয় তাঁকে।
২০১৮ - পিভি সিন্ধু (রূপো):
সোনা জয়ের লক্ষ্য নিয়ে এই প্রতিযোগীতায় অংশ নেওয়া সিন্ধু কোনও প্রতিপক্ষ'কেই দাঁড়াতে দেননি। ফিটরিয়ানি এবং সুং জি-হুন'কে হারিয়ে স্ট্রেট গেমে কোয়ার্টার ফাইনালে মধুর প্রতিশোধ নেন ওকুহারার বিরুদ্ধে। সেমিফাইনালে আকানে ইয়ামাগুচি'র বিরুদ্ধে ২১-১৬ ব্যবধানে সহজেই প্রথম গেম পকেটে পুরলেও দ্বিতীয় গেমে নামের প্রতি সুবিচার করে সিন্ধুর সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন জাপানি প্রতিপক্ষ। তবে, ইয়ামাগুচির দারুণ লড়াই কাজে আসেনি ২৪-২২ ব্যবধানে জিতে ফাইনালের টিকিট নিশ্চিত করেন সিন্ধু। ফাইনালে স্প্যানিশ ক্যারোলিনা'র বাধা টপকাতে পারেননি সিন্ধু। বরং এই ম্যাচ জিতে প্রথম মহিলা শাটলার হিসেবে তিনটি বিশ্ব খেতাব জেতার নজির গড়েন ক্যারোলিনা।
২০১৯ - বি সাই প্রণীথ (ব্রোঞ্জ):
বেসিলে প্রতিযোগীতা শুরু আগে দারুণ ছন্দে ছিলেন প্রণীথ। প্রথম এবং দ্বিতীয় রাউন্ড সহজে জেতার পর তৃতীয় রাউন্ডে তিনি স্ট্রেট গেমে হারান প্রতিযোগীতার ষষ্ঠ বাছাই অ্যান্তোনি গিনটিং-কে। ২১-১৯ এবং ২১-১৩ ব্যবধানে গিনটিং-কে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হন চতুর্থ বাছাই জোনাথন ক্রিস্টি'র। শেষ আট থেকে শেষ চারে পৌঁছতে বেশি ঘাম ঝড়াতে হয়নি এই তারকা'কে। ২৪-২২ এবং ২১-১৪ ব্যবধানে ক্রিস্টি'র বিরুদ্ধে জয় তুল নিয়ে সেমিফাইনালে প্রবেশ করেন সাই প্রণীথ। শেষ চারের ম্যাচে জাপানের কেন্টো মোমোতা'র কাছে হেরে দ্বিতীয় ভারতীয় পুরুষ শাটলার হিসেবে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ জেতেন তিনি।
২০১৯ - পিভি সিন্ধু (সোনা)
দু'টি ব্রোঞ্জ এবং দু'টি রূপো জেতা সিন্ধু বদ্ধপরিকর ছিলেন এই সংস্করণে হলুদ ধাতুর মেডেলটি গলায় ঝোলানোর বিষয়ে। বেসিলে সেটাই রানীর মতো করে দেখান সিন্ধু। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের ওই সংস্করণে পাঁচটি ম্যাচে মাত্র একটি গেমে পরাজিত হন সিন্ধু। খেতাবি লড়াইয়ে নোজোমি ওকুহারা'কে এক তরফা ম্যাচে ২১-৭ এবং ২১-৭ গেমে হারিয়ে দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সোনা জেতেন সিন্ধু। প্রথম ভারতীয় হিসেবে বিশ্ব চ্যাম্পিয়শিপের মঞ্চে সোনা জয়ের কৃতিত্ব অর্জন করেন তিনি।