অবিশ্বাস্য হলেও বাস্তব, শ্রীলঙ্কার জন্ম বাংলার সিঙ্গুর থেকে
অবিশ্বাস্য হলেও বাস্তব, শ্রীলঙ্কার জন্ম বাংলার সিঙ্গুর থেকে
আজকের
পশ্চিমবঙ্গের
হুগলির
সিঙ্গুর
থেকে
বেরিয়ে
ঝড়ঝঞ্ঝা
পেরিয়ে
ভারতের
পূর্ব
উপকূল
ধরে
ছুটে
চলেছে
এক
বাঙালি
বীরের
সাতটি
জাহাজ।
প্রথমে
পুরুষদের
দল,
তারপর
মেয়েদের
দল
এবং
সবার
শেষে
রয়েছে
শিশুর
দল।
সাতটি
জলজাহাজে
মোট
যাত্রীর
সংখ্যা
৬৯৯
জন।
অবশেষে
একসময়
জাহাজগুলি
পৌঁছালো
দূর
সিংহল
দ্বীপে।
এই
অভিযানের
নায়ক
হুগলির
সিংহপুরের
রাজা
সিংহবাহুর
পুত্র
রাজকুমার
বিজয়সিংহ।
যিশুর জন্মের প্রায় পাঁচশো বছর আগের ঘটনা। এদিকে ভারতের কুশীনগরে গৌতম বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ ঘটছে, আর সেদিনই বিজয় সিংহ পা রাখছেন সিংহলে। সময়কাল: ৫৪৪ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের ২২ এপ্রিল।হুগলির সেদিনের "সিংহপুর" আজকের "সিঙ্গুর।"হুগলি জেলার সিংহরণ নদীর তীরে ছিল রাজা সিংহবাহুর রাজপাট। ওই স্থানের আরেকটি পুরোনো নাম ছিল "লাউরট্ট।"
লংকাবিজয়ী বীর বাঙালি বিজয় সিংহের পিতা সিংহবাহু পত্তন করেছিলেন "সিংহপুর" রাজ্যের। হুগলি জেলার সিঙ্গুর হলো অতীতের সিংহপুর।রাজা সিংহবাহু যে রাজপাটের "পত্তন" করেন, তা আজ হুগলির সিঙ্গুর ব্লকে "সিংহল পাটন" গ্রামনাম হিসেবে সাক্ষ্য দিচ্ছে। সিঙ্গুর ব্লকের উত্তরে প্রায় মাইল সাতেক দূরে দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ওয়ের ধারে কিছুটা পূর্বে এই "সিংহল পাটন" গ্রাম। এলাকাটি আগে ছিল নদীবেষ্টিত। পরে ধীরে ধীরে তা পরিণত হয়েছে উচ্চ ভূমিতে। "সিংহল পত্তন" অপভ্রংশে আজ "সিংহল পাটন।" রাজা সিংহবাহুর এই সিংহল পাটন থেকে সরস্বতী নদীপথে ব্যবসা-বাণিজ্য চলতো। একসময় সিঙ্গুরের পূর্বদিক দিয়ে বয়ে যেত সরস্বতী। সেই সরস্বতী এখন একটি মজা খাল মাত্র।
বৌদ্ধ
গ্রন্থ
"দীপবংশ"
অনুসারে,
ওজদ্বীপ,
বরদ্বীপ
ও
মণ্ডদ্বীপ-
এই
তিনটি
দ্বীপকে
একত্রে
বলা
হতো
"লংকাদ্বীপ।"
বৌদ্ধ
গ্রন্থ
"দীপবংশ"
ও
"মহাবংশ"
-এ
বিজয়
সিংহের
কথা
আছে।
আর
বিজয়সিংহ
যে
বাঙালি
ছিলেন,
সিংহলরাজ
নি:
শঙ্কমল্লর
শিলালিপি
তার
সাক্ষী।
বিজয়সিংহের
সিংহল
বিজয়ের
ছবি
এঁকেছেন
দুর্গাদাস
লাহিড়ী
তাঁর
"পৃথিবীর
ইতিহাস",
৪র্থ
খণ্ডে:
সাগরতীরে
জাহাজ
থেকে
নামছে
হাতির
দল।
তার
সঙ্গে
নামছে
সৈন্যরা।
সব
মিলিয়ে
বাঙালির
নৌবল,
বাহুবল
ও
যুদ্ধ
জাহাজ
পরিচালনার
এক
সার্থক
ছবি।
ঋষি
পুলস্ত্যর
পুত্র
বিশ্বশ্রবা
ও
তাঁর
পুত্র
কুবের-
এঁদের
নিয়েই
শ্রীলঙ্কার
ইতিহাস
শুরু।
মাঝে
ফাঁক।
আবার
গৌতম
বুদ্ধের
ধর্মপ্রচার
এবং
বাংলা
থেকে
বিজয়সিংহের
সিংহল
বিজয়
দিয়ে
নতুন
করে
এই
দ্বীপরাষ্ট্রের
ইতিহাস
শুরু
হয়।
অবশ্য
লংকা
ও
সিংহল
দুটি
আলাদা
দ্বীপ।
এর
মধ্যে
সিংহল
দ্বীপ
ছিল
দক্ষিণ
দিকে:
লংকাধিপতি
রাবণ
নিজেই
ছিলেন
ব্রাহ্মণ।
লংকায়
যাগ-যজ্ঞের
প্রচলন
ছিল।
রাবণপুত্র
মেঘনাদকে
আমরা
নিকুম্ভিলা
যজ্ঞাগারে
দেখি।
ভারতের
জম্বুদ্বীপের
মোট
৮
টি
উপদ্বীপের
মধ্যে
দুটি
ছিল
সিংহল
ও
লংকা।
মোট
৮
টি
উপদ্বীপ
হলো,
১)
স্বর্ণপ্রস্থ,
২)
চন্দ্রশুক্ল,
৩)
আবর্ত্তন,
৪)
রমণক,
৫)
মন্দহরিণ,
৬)
পাঞ্চজন্য,
৭)
সিংহল
ও
৮)
লংকা।
বিজয়সিংহ
প্রথমে
সিংহল
দ্বীপ
জয়
করেন।
পরে
লংকা
জয়
করে
পুরো
এলাকার
নাম
পিতা
সিংহবাহুর
নামে
রাখেন
"সিংহল।"বিজয়সিংহ
সিংহলে
৩৮
বছর
রাজত্ব
করেন।
কোনো
পুত্র
সন্তান
ছিল
না
বিজয়ের।
তাই
তিনি
শেষ
বয়সে
তাঁর
ছোট
ভাই
সুমিত্রকে
সিংহলের
শাসনভার
নিতে
ডেকে
পাঠান।
কিন্তু
তিনিও
বয়সের
ভারে
এই
দায়িত্ব
না
নিয়ে
সিংহলে
পাঠালেন
তাঁর
ছোট
ছেলে
পাণ্ড্যুবাসুদেবকে।
এরপর
বিজয়সিংহের
ভাইপো
এই
পাণ্ড্যুবাসুদেব
সিংহলে
৩০
বছর
রাজত্ব
করেন।বিজয়সিংহ
সিংহলে
ভারতীয়
রীতি
মেনে
সেখানে
মন্ত্রীমণ্ডলী
গঠন
করেছিলেন।
তিনি
নিজে
দক্ষিণ
ভারতের
পাণ্ড্য
রাজকুমারীকে
বিয়ে
করেন।
এই
বৈবাহিক
সম্পর্কের
ফলে
ভারত
ও
সিংহলের
মধ্যে
এক
নিবিড়
আত্মীয়তা
গড়ে
ওঠে।
বিজয়সিংহের
উদ্যোগে
বন্যার
কবল
থেকে
রক্ষা
পেতে
সিংহলে
কৃষির
উন্নতির
জন্য
গড়ে
ওঠে
প্রয়োজনীয়
কৃত্রিম
বাঁধ
ও
জলাধার।
কৃষিতে
সমৃদ্ধ
হয়
সিংহল।
এককথায়
বলতে
গেলে
বিজয়সিংহের
সুশাসনে
অচিরেই
প্রকৃত
অর্থেই
সিংহল
হয়ে
ওঠে
এক
সমৃদ্ধশালী
দেশ।
আর্য
সভ্যতা
ও
সংস্কৃতির
পরিপূর্ণ
বিকাশ
ঘটে
সিংহলে।
কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের
সিংহলি
ভাষার
অধ্যাপক
শীলানন্দ
এখানকার
বিদগ্ধ
পণ্ডিত
দীনেশচন্দ্র
সেনকে
জানিয়েছিলেন,
সিংহলবাসীদের
চিরাচরিত
বিশ্বাস,
তাঁরা
বাঙালি।
বাঙালিদের
সঙ্গে
সিংহলের
জনগণের
চেহারার
মিল
সে
কথাই
মনে
করিয়ে
দেয়।
বাংলার
বাইরে
বাঙালির
হাতে
গড়া
সিংহল
উপনিবেশের
ইতিহাস
আজও
দু'
টি
দেশকে
বেঁধে
রেখেছে
বন্ধনহীন
গ্রন্থিতে।
দ্বীপবংশ ও মহাবংশ নামক প্রাচীন বৌদ্ধ পুরাণ গ্রন্থে পালি ভাষায় যে কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে তা অন্যরকম , তাহলে বলতে হয় যে এ ইতিহাস বাঙালীর শৌর্য-বীর্যের ইতিহাস। কাহিনীটা একটু বলা যাক। বঙ্গদেশের রাজার সুসীমা নামের এক কন্যা ছিল। রাজকুমারী ছিলেন সুন্দরী ও স্বাধীনচেতা। তাই রাজ-অন্তঃপুরের শাসন তাঁর সহ্য হল না। তিনি পলায়ন করলেন। একদল নাবিক সেসময় বঙ্গদেশ থেকে মগধে যাচ্ছিলেন। পথে রাঢ়দেশে এক সিংহ তাঁদের তাড়া করলে তাঁরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। রাজকুমারী সেসময় সিংহের প্রতি কামাতুর হয়ে সিংহকেই ভজনা করলেন।
গুহার মধ্যে সিংহ ও রাজকুমারীর মিলন হল। রাজকুমারীর একটি পুত্রসন্তান ও একটি কন্যাসন্তান হল। পুত্রের নাম সিংহবাহু ও কন্যার নাম সিংহসিবলী। পুত্রের হাত ও পায়ের গঠন সিংহের মত বলেই তাঁর নাম সিংহবাহু রাখা হয়। ষোল বছর স্বামীর সাথে থাকার পর রাজকুমারী স্বামীর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। পুত্রও আপন পরিচয় পেয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। সিংহকে ফেলে রেখে তাঁরা পালিয়ে গেলেন।
বঙ্গ ও রাঢ় দেশের সীমানা অঞ্চল তখন বঙ্গাধিপতির একজন সেনাধ্যক্ষের দ্বারা শাসিত হত। তাঁর নাম ছিল অনুর। সেই সেনাপতি সিংহবাহু, তাঁর বোন ও মাতাকে আশ্রয় দিলেন। এদিকে স্ত্রী ও পুত্র-কন্যাকে হারিয়ে সিংহ ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন। পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো সিংহের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। বঙ্গের সম্রাট সেই সিংহকে ধরার জন্য পুরষ্কার ঘোষণা করলেন। সেই সংবাদ সিংহবাহুর কানেও পৌছল। মাতার অমত সত্ত্বেও সিংহবাহু বেরিয়ে পড়লেন সেই সিংহের অন্বেষণে। তীরের আঘাতে আপন পিতাকে হত্যা করলেন।
বঙ্গের রাজার রাজসভায় তিনি বীরের মর্যাদা পেলেন। রাজার কোন উত্তরাধিকারী না থাকায় সিংহবাহুই হয়ে উঠলেন মহারাজা। কিন্তু তিনি ফিরে গেলেন তাঁর জন্মস্থানে। জঙ্গল কেটে গড়ে তুললেন জনপদ। নতুন রাজধানীর নাম দিলেন 'সিংহপুর'। রাজা সিংহবাহুর তাঁর বোন সিংহসিবলীকেই রাণীরূপে গ্রহণ করলেন। ১৬ বার গর্ভধারণে রাণী প্রত্যেকবার যমজ সন্তান প্রসব করেন। বড় ছেলে বিজয় সিংহ যুবরাজ পদে অভিষিক্ত হন। কিন্তু যুবরাজ খুবই দুশ্চরিত্র হয়ে উঠলেন। সঙ্গীসাথী নিয়ে রাজ্যময় দুষ্কর্ম করে বেড়াতে লাগলেন। প্রজারা অতিষ্ঠ হয়ে রাজা সিংহবাহুর কাছে নালিশ জানালে সিংহবাহু বিজয় সহ তাঁর অনুগামীদের অদ্ভুত শাস্তির ব্যবস্থা করলেন। বিজয় ও তাঁর সাথীদের মাথা ন্যাড়া করে স্ত্রী পুত্রকন্যাসহ দ্বীপে নির্বাসিত করা হল।
বিজয় যে দ্বীপে গেলেন তার নাম সুপ্পারক। সেখান থেকেও বিতাড়িত হয়ে বীর বিজয় সিংহ দলবল নিয়ে লঙ্কাদ্বীপে অবতীর্ণ হলেন। মহাবংশে লিখিত আছে যে তথাগত বুদ্ধ যে সময়ে নির্বাণপ্রাপ্তির প্রহর গুনছিলেন সে শময়ই বিজয় লঙ্কাদ্বীপে অবতীর্ণ হন। লঙ্কাদ্বীপে যক্ষরাজ্য অধিকার করে বিজয় শেখানে রাজত্ব শুরু করলেন। তাঁর নাম অনুসারে ঐ দ্বীপের নাম হল সিংহল দ্বীপ। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট যে সিঙ্গুর থেকেই সিংহল তৈরি হয়। এসব কথাই জানা গিয়েছে সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের সংগ্রহশালা ও তাদের চর্চা করা ইতিহাস মারফৎ।