রাজ্যে পঞ্চায়েত মনোনয়ন দাখিলে ফের মহিলা সাংবাদিক সহ ৩ জনকে অপহরণ দুষ্কৃতীদের
পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন দাখিলকে কেন্দ্র করে সোমবারও রাজ্য জুড়ে এক মহিলা সাংবাদিক-সহ দু'জনকে অপহরণের ঘটনা ঘটল।
রাজ্যে সাংবাদিকদের বিপন্নতা কিছুতেই ঘুচছে না। পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন দাখিলকে কেন্দ্র করে সোমবারও রাজ্য জুড়ে এক মহিলা সাংবাদিক-সহ দু'জনকে অপহরণের ঘটনা ঘটল। আর এক সাংবাদিককে অপহরণের চেষ্টা করা হয়। দুই সাংবাদিকদের অপহরণের ঘটনা খোদ কলকাতার বুকে আলিপুর প্রশাসনিক ভবনে। অন্য ঘটনাটি দুর্গাপুরে।
এই আলিপুর প্রশাসনিক ভবনই প্রথম দফায় পঞ্চায়েত মনোননয়নের সময় সর্বভারতীয় ইংরাজি এক সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকের অপহরণের ঘটনাকে প্রত্যক্ষ করেছিল। ৯ এপ্রিল সেই চিত্র সাংবাদিককে আলিপুর প্রশাসনিক ভবনের চৌহদ্দিতে বেধড়ক মারধরের পর তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আলিপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের পিছনে একটি বস্তিতে। সেখানে তিন ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে তাঁকে নগ্ন করে মারধর করা হয়। এমনকী পিস্তল বের করে প্রাণনাশেরও হুমকি দেওয়া হয়েছিল। নগ্ন করে সেই চিত্র সাংবাদিকের ভিডিও ফেসবুকে আপলোড করে দেওয়ারও হুমকি দেওয়া হয়। পরে অনেক কষ্টে সেই চিত্র সাংবাদিককে উদ্ধার করেছিলেন তাঁর কয়েক জন সহকর্মী।
সেই ঘটনারই যেন পুনরাবৃত্তি ঘটল ২৩ এপ্রিল। ঘটনাচক্রে ৯এপ্রিল দিনটিও ছিল সোমবার। আর ২৩ এপ্রিল যখন আলিপুর প্রশাসনিক ভবনে এক মহিলা সাংবাদিক-সহ দুই সাংবাদিককে অপহরণ করা হল সেই দিনও সোমবার।
কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশের পর রাজ্য নির্বাচন কমিশন মনোনয়ন জমা দেওয়ার অতিরিক্ত একদিন হিসাবে ২৩ তারিখকেই বেছে নিয়েছিল। সেই মোতাবেক সমস্ত রাজনৈতিক দলকেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
আলিপুর প্রশাসনিক ভবনের সামনে মনোনয়নের খবর সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন আকাশ আট-এর মহিলা সাংবাদিক প্রজ্ঞা সাহা এবং আনন্দ বাজার পত্রিকার আর্যভট্ট খান। দু'জনেই আলিপুর প্রশাসনিক ভবনের গেটের সামনে তৈরি করে রাখা দুষ্কৃতীদের ব্যারিকেডের ফাঁক গলে ভিতরে যেতে সমর্থ হয়েছিলেন।
ভিতরে ঢুকতেই প্রজ্ঞা সাহাকে ঘিরে ধরে একদল দুষ্কৃতী। তাঁকে তুলে একটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হয় বলে জানা গিয়েছে। অন্ধকার সেই ঘরে ২ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে প্রজ্ঞাকে আটকে রাখা হয় বলে অভিযোগ। আরও অভিযোগ, যে আটকে রাখার সঙ্গে সঙ্গে দুষ্কৃতীরা অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে। মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে ফরম্যাট করে দেওয়া হয়।
অন্য়দিকে আর্যভট্ট খানকে ঘিরে ধরে একদল দুষ্কৃতী বেধড়ক মারধর করে বলে অভিযোগ। যাতে অন্য কেউ এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে না পারে তার জন্য আর্যভট্ট খানকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রশাসনিক ভবনের অন্য এক খোলা স্থানে। তাঁর পেটে, মুখে ঘুষি মারা হয় বলে অভিযোগ। সেইসঙ্গে অকাতরে চলে চড়-থাপ্পড়। তাঁর হাতের ঘড়ি ও মোবাইল ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ঘণ্টা দুয়েক ধরে তাঁর উপরে এই অকথ্য অত্যাচার চলে।
আর্যভট্ট খানের সঙ্গে থাকা চিত্র সাংবাদিক আনন্দ বাজার অফিসে ফোন করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে খবর দেন। এরপরই পুলিশ দুষ্কৃতীদের ঘেরাটোপ থেকে আর্যভট্ট খান ও প্রজ্ঞা সাহাকে উদ্ধার করতে তৎপর হয়। অভিযোগ, আর্যভট্ট খান ও প্রজ্ঞা সাহাকে দুষ্কৃতীরা অপহরণ করেছে এই ঘটনা জানাজানি হতেই পুলিশের হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু, নীরব দর্শকের মতোই পুলিশ ঘণ্টা দুয়েক ধরে দাঁড়িয়েছিল বলে অভিযোগ। পরে উদ্ধার হওয়ার পর পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন তিনি। কাউকে কিছু বলা যাবে না এই শর্তে মুক্তি দেওয়া হয় প্রজ্ঞা সাহাকে।
এদিকে, দুর্গাপুরেও বিকাশ সেন বলে এক সাংবাদিককে অপহরণের চেষ্টা করা হয়। দুষ্কৃতীদের প্রহারে গুরুতর আহত হন বিকাশ। তাঁকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনে মনোনয়নে যে বেনজির সন্ত্রাসের আবহ তৈরি হয়েছে তাতে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সঙ্গে শিকার করা হচ্ছে সাংবাদিকদেরও। রাজ্য সরকারের শীর্ষে বসা থাকা এবং শাসক দলের শীর্ষ নেতারা ফ্রিডম অফ প্রেস বলে জোর সওয়াল করেন। কিন্তু সেই আচার-আচরণের কোনও প্রতিফলন পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়নে দেখা মিলছে না। কয়েক বছর আগে দিল্লিতে সাংবাদিকদের নিরাপত্তায় এক সমাবেশে সামিল হয়ে জোর আওয়াজ তুলেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন দাখিলে মূলত আলিপুর প্রশাসনিক ভবনে দুষ্কৃতী জমায়েতে বিরোধীরা তৃণমূল কংগ্রেসের দিকেই আঙুল তুলছে। সন্দেহ নেই ২৩ এপ্রিল আলিপুর প্রশাসনিক ভবনে দুই সাংবাদিক নিগ্রহের ঘটনায় দায় রাজ্য সরকারকেই আপাতত নিতে হবে। প্রশাসনিক ভবনের প্রবেশের দরজায় পুলিশের বদলে দুষ্কৃতীরা কী ভাবে দখল নিল সে প্রশ্নও বড় করে উঠতে বাধ্য।