
বিলুপ্তির পথে লৌকিক সংস্কৃতি, হারিয়ে যাচ্ছে আকাশ-প্রদীপ
বিলুপ্তপ্রায় হাওড়া জেলার লৌকিক সংস্কৃতি আকাশ-প্রদীপ। কার্তিক মাস পড়লেই সন্ধেবেলায় হাওড়ার ঘরে ঘরে জ্বলে উঠত আকাশ প্রদীপ। হেমন্তের বুক ঝিম করা ভাব, মন কেমন, উত্তরে হাওয়ার কাছে আসতে থাকা, দিন ছোট হয়ে আসা, ভোর বেলা ঘাসের আগায় জমে থাকা শিশির, এসবের সঙ্গে মিশে আছে অতীতের স্মৃতি। দিন ফুরোলে বাড়ির চাল অথবা ছাদের ওপর বাঁশের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া একটা প্রদীপ। আকাশ প্রদীপ যার নাম।

আশ্বিন মাসের অমাবস্যায় মহালয়ার দিন পূর্ব পুরুষকে উদ্দেশ্য করে তর্পণ করা হয়। তার পরের একটা মাস মৃত পূর্ব পুরুষেরা ধরাধামে আসেন। কালী পূজার অমাবস্যায় তাঁদের ফিরে যাওয়ার পালা। ফিরে যাবেন পরলোকে। কে পথ দেখাবে তাঁদের? তাই সাঁঝবেলায় জ্বালিয়ে রাখা হতো আকাশ প্রদীপ।
আধুনিক সময়ে অতীতের সঙ্গে যোগ কমছে। স্মৃতির সঙ্গে বাড়ছে দূরত্ব। হেমন্তের সন্ধেয় আর জ্বলে না আকাশ প্রদীপ। বিস্মৃতিতেই সুখী আমরা। অতীতের সঙ্গে, ঐতিহ্যের সঙ্গে কমে আসছে টান। সাঁকোটা দুর্বল হচ্ছে। ভেঙ্গে পড়ছে একটু একটু করে।ফিকে হয়ে আসছে আকাশ প্রদীপ।
ষাট- সত্তরের দশকেও কলকাতার বহু জায়গায় আকাশ প্রদীপ জ্বলতে দেখা যেত। আশ্বিনের শেষ দিন থেকে কার্তিক মাসের শেষ দিন পর্যন্ত একমাস কেন আকাশে আলো জ্বালানো হয় ?
ঋতু হেমন্ত, মাস আশ্বিন সংক্রান্তি। আশ্বিনের শেষ দিনে জলবিষুব সংক্রান্তি পালনের উদ্যোগ চলে বহু পরিবারে ।এই জলবিষুব সংক্রান্তি থেকে ষড়শীতি সংক্রান্তি বা কার্তিক মাসের শেষ দিন পর্যন্ত চলবে ব্রত-উৎসব। বিষ্ণুভক্ত ব্রাহ্মণ্যজীবনের যা এক অবশ্য কর্তব্যও বটে।
সৌর কার্তিক মাসের এই ব্রত পালনের তাৎপর্য যে এই প্রদীপ আসলে দেহেরই প্রতীক। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম- এই পঞ্চভূতে যেমন তৈরি হয় এই নশ্বর শরীর, মাটির প্রদীপটিও তাই! ক্ষিতি বা মাটি তার কায়া তৈরি করে। অপ বা জলে তা আকার পায়। তেজ বা আগুন আত্মার মতোই স্থিত হয় তার অন্তরে। মরুৎ বা হাওয়া সেই আগুনকে জ্বলতে সাহায্য করে। আর ব্যোম বা অনন্ত শূন্য জেগে থাকে তার গর্ভে।
পন্ডিতদের মতে কার্তিক মাস ধরে এই প্রদীপ দেওয়া তো বিষ্ণুকে স্মরণ করতেই। এই পৃথিবীকে পালন করেন তিনি, মৃত্যুর পরেও মানুষের উপরে রয়েছে তাঁরই অধিকার। তাই আকাশপ্রদীপ দেওয়ার সময় উচ্চারণ করা হয় মন্ত্র- ''আকাশে সলক্ষ্মীক বিষ্ণোস্তোষার্থং দীয়মানে প্রদীপঃ শাকব তৎ।'' আকাশে লক্ষ্মীর সঙ্গে অবস্থান করছেন যে বিষ্ণু তাঁর উদ্দেশে দেওয়া হল এই প্রদীপ।
এছাড়া আবাহন করা হয় পিতৃলোকে, প্রেতলোকে থিতু হওয়া পূর্বপুরুষদেরও। যাতে তাঁরা সেই আলোয় পথ চিনে আশীর্বাদ দিতে আসতে পারেন উত্তরসূরীদের। আকাশপ্রদীপ আশ্বিন সংক্রান্তি থেকেই তার আকাশ আলো করার কথা। কিন্তু, তিল তেল বা ঘিয়ের প্রদীপ কে সময় খরচ করে দেবে? তাই কর্তব্য সারা হতো বিদ্যুতের আলোতেই।
বাঁশের ডগায় লাল টুনি জ্বলবে। সেই আলোতেই পথ চিনে, শীতের হাত ধরে একে একে গৃহে উপস্থিত হবেন পূর্বপুরুষরা। সেই আলোর নিশানা ধরে রাতের আঁধার পাড়ি দেবে পরিযায়ীরাও। বিষ্ণুর সৃষ্টি করা পৃথিবীর জীবনের চাকাটি ঘুরতে থাকবে নিজের নিয়মে।
সেই আলোও অবশ্য কমে এসেছে ক্ষীণ হতে হতে। হেমন্ত জুড়ে থাকা কার্তিকে আকাশপ্রদীপের বৈদ্যুতিন আলোও এখন আর বড় একটা চোখে পড়ে না। আস্তে আস্তে সবই প্রাচীন প্রথা আজ বিলুপ্তির পথে।
লোকভাবনায় লক্ষ্মী, শ্যামপুরের গ্রামের পাঠাগারে অভিনব লোক-প্রদর্শনীশালা