বঙ্গদেশের দুর্দশা: বাঙালির চন্ডীমণ্ডপের সমাজ-রাজনীতি আচমকা বে-আব্রু হয়ে যাওয়াতেই এই বিপত্তি
এক মন্ত্রী দুর্নীতির কারণে সিবিআই-এর জালে ধরা পড়লেন আর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী রাস্তায় নেমে পড়লেন দলবল নিয়ে এই গ্রেফতারের বিরোধিতা করতে | রাজ্যের বহু বিদ্দ্বজনকেও দেখা গেল এই বিরোধিতার অংশীদার হতে | বলা হতে লাগল যে যে বাঙালি অন্যকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে ঠাট্টা করত এতদিন, সে নিজেই এখন বেকায়দায় পড়ে মুখ লুকোতে ব্যস্ত |
তবে কি বাঙালির মানসিকতায় সত্যি পরিবর্তন দেখা দিল? সেও কি গান-বাজনা-পড়াশোনা-সংস্কৃতি ছেড়ে নির্লজ্জ বিত্তপ্রেমে মনোনিবেশ করল? অধ্যাপক আশিস নন্দী যে বলেছিলেন বাংলা সবথেকে কম দুর্নীতিগ্রস্ত, তবে কি তা ভুল প্রমাণিত হলো?
এটা ভাবার কিন্তু কোনও কারণ নেই যে বাঙালি দৈবিক আশির্বাদে দুর্নীতির উর্ধ্বে | পাশের বাড়ির এক ছটাক জমি কায়দা করে নিজের নাম করে নেওয়া বা বাপ-জ্যাঠার সম্পত্তি বে-আইনি ভাবে দখল করা বঙ্গদেশে আকছার ঘটে থাকে| সামাজিকভাবে তাই বাঙালি যে শত শতাংশ সততার প্রতীক, তা কখনই বলা চলে না |
কিন্তু রাজনৈতিকভাবে বাঙালির সততার একটা ইমেজ আগাগোড়া ছিল, তার কারণ তার রাজনীতির নেতৃত্বে থাকত এক ভদ্রলোক শ্রেণী | সাদা পাঞ্জাবি-ধুতি কিংবা পাঞ্জাবি-পায়জামা (সততার শুভ্রতা আর কী) পরিহিত এই শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, ধর্মনিরপেক্ষ শ্রেণীটি বাঙালির রাজনৈতিক পরিচয়টিকে সবসময়েই এক নির্ভেজাল মূল্যবোধ-বিশিষ্ট মোড়কে ঢেকে রাখত, অন্তত জনসমক্ষে | আর এই মোড়কটির আড়ালে লুক্কায়িত থাকত বাঙালির সামাজিক এবং রাজনৈতিক জীবনযাত্রার হতদরিদ্র চেহারাটি |
হতদরিদ্র কিরকম?
বাঙালির সামাজিক জীবনের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হলো তার সীমাবদ্ধতা | চন্ডীমন্ডপের পিদিমের নিভু-নিভু আলোয় বাঙালির সমাজজীবনের সর্বোচ্চ রূপ প্রকাশ পায় আগাগোড়াই | ব্যক্তির অধিকার এবং পরিচয়কে দমিয়ে রেখে দল কিংবা গোষ্ঠীর স্বরকেই প্রাধান্য দেওয়া হয় এই চন্ডীমন্ডপের সংকীর্ণ সংস্কৃতিতে |
বহির্জগতের প্রতি একধরনের ফোবিয়া বরাবরই নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে বাঙালির মননকে | নামে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাবশিষ্য হলেও আপামর বাঙালির আসল অবস্থান কিন্তু তাঁর আন্তর্জাতিকতাবাদ-ধর্মী দর্শনের সম্পূর্ণ উল্টো দিকে | আর বাঙালির এই প্রান্তিক এবং অন্তর্মুখী চারিত্রিক গঠনের সুবিধা নিয়ে একপেশে রাজত্ব করে গিয়েছে ওই সাদা পোশাক পরিহিত ভদ্রলোক শ্রেণী |
তাঁরা বেশ বুঝেছেন যে স্টেটাস কুও-প্রেমী বাঙালির ভোটটি ধরে রাখতে চন্ডীমন্ডপের স্থবিরতা ধরে রাখাটাই যথেষ্ট | কোনও সমস্যা হলে 'আমরা বঞ্চিত' স্লোগান তুলে কেন্দ্রকে তুলোধোনা কর যাতে দেশীয় রাজনীতিতে নেতাজীর 'হেরে যাওয়ার' ঘা টা আবার দগদগে হয়ে ওঠে আর নিজের রাজ্যপাট চালিয়ে যাও | কেউ এই জমিদারিতে ওস্তাদি করতে আসবে না আর এলেও হালে পানি পাবে না | আদর্শবাদ, ভৈরব-বাহিনী, রাজনৈতিক কর্তৃত্ববাদ ইত্যাদি নানাবিধ ঘেরাটোপে বাঙালির রাজনৈতিক সংস্কৃতি তখন সুরক্ষিত |
বামফ্রন্ট-এর ধবধবে সাদা পোশাকের শিক্ষিত নেতারা এই ফর্মুলাটি ভালো রপ্ত করেছিলেন | একদিকে 'কেন্দ্র আমাদের ঠকিয়েছে' বাণী, অন্যদিকে প্রবল সাংগঠনিক জোরে অপশাসন টিকিয়ে রাখা এবং বিরোধীদের পঙ্গু করে দেওয়া আর সবার উপরে, বাঙালির বহির্জগতের প্রতি নাক-উঁচু ভাব এবং বদলের প্রতি অনীহা --- এই তিনটি জোরদার কারণে পশ্চিমবঙ্গের ভদ্রলোক শাসকগণ সত্তরের দশকের শেষ লগ্ন থেকে এই রাজ্যটিকে জাতীয় রাজনীতি এবং সমাজ থেকে বিছিন্ন করতে সফল হয়েছিলেন |
"দুর্নীতি আমাদের এখানে হয় না, আমরা বাকিদের মত নই" --- বাঙালির এই গর্বের কারণ ছিল একটাই, তাঁর রাজনৈতিক নেতৃত্ব বছরের পর বছর ধরে একটি মিথ্যে প্রাচীর তৈরী করেছিল পশ্চিমবঙ্গ এবং বাকি ভারতের মধ্যে | এই প্রাচীর তৈরির উপাদান ছিল আদর্শ, সংগঠন এবং অবশ্যই বাঙালির উন্নাসিকতা |
কিন্তু ২০১১-র পর এই হিসেব সম্পূর্ণ গুলিয়ে যায় | বামপন্থী শাসকদের পরাজয়ের পর যে জগাখিচুড়ি শক্তি ক্ষমতায় আসে (জগাখিচুড়ি কারণ দলটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক অথচ তার তথাকথিত আদর্শ বামপন্থী), তারা তাদের জয়ের লাগামহীন উল্লাসে তাদের পূর্বসূরীর তৈরী করা সেই অদৃশ্য প্রাচীরটিকেই ভেঙ্গে খান খান করে ফেলে |
এই প্রাচীর মেরামত করার এক সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময়ে যখন তৃণমূল কংগ্রেস বুদ্ধি করে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারত | মোদি বেশ কয়েকবার তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা ব্যানার্জীকে আকারে ইঙ্গিতে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েও দিয়েছিলেন কিন্তু নেত্রীর রাজনৈতিক অহংবোধ এতটাই ধংসাত্মক রূপ নেয় যে সহজ পরিস্থিতিকে জটিল করে তোলেন উনি নিজেই | সংখ্যালঘুদের মসিহা হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা ছিল সেটা হয়ত কিন্তু সারদা কেলেঙ্কারী এবং বর্ধমানে জঙ্গিবাদের উপস্থিতি ম্যাডাম বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের গনেশটিই উল্টে দেয় | শক্ত হয় মোদি এবং তাঁর দলের হাত |
এই পর্যন্ত তাও না হয় লড়াইটা হচ্ছিল রাজনৈতিক | কিন্তু সারদাকাণ্ডে মদন মিত্রকে সিবিআই-এর ডেকে পাঠানো বা পরে তাঁর গ্রেফতার হওয়ার পরে খেলাটা হয়ে গেল দুনিয়ার সামনে বাঙালির বেইজ্জত হওয়ার | বাংলার মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যে খিস্তি-খেউর করা শুরু করলেন আর তাঁর ভৈরব-বাহিনী শুরু করল তাণ্ডব | ওনাকে বলতে শোনা গেল: "অমুক চোর? তমুক চোর? আমি চোর?" সেই উন্নাসিকতার ছোঁয়া দেখতে পাওয়া গেল যেন |
কিন্তু এই উন্নাসিকতা কোনও কাজে লাগার নয় কারণ ইতিমধ্যেই বাঙালির সেই শ্বেত-শুভ্র রাজনৈতিক মোড়ক আলগা হয়ে গিয়েছে, বে-আব্রু হয়ে গিয়েছে তাঁর হতদরিদ্র মনন যা আজকাল চুরির দায়ে অভিযুক্তদের জন্যেও কেঁদে-কঁকিয়ে ওঠে প্রকাশ্যে | সারদা কেলেঙ্কারী একদিকে যেমন ভদ্রলোক শ্রেণীর সততার ট্রাডিশনকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে, খাগড়াগড় কাণ্ডে ভূলুন্ঠিত হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতার জয়ধ্বজা |
বামপন্থীদের উত্তরসূরী যাঁরা ক্ষমতায় এসেছেন আজ তাঁরা ৩৪ বছরের অপশাসনের মন্ত্রেই দীক্ষিত কারণ চন্ডীমন্ডপের আবছা আলোয় তাঁরা আর কিছু দেখতে বা শিখতে পাননি | কিন্ত সমস্যা হচ্ছে রমরমিয়ে চলা মিডিয়ার এই যুগে দুর্বল সংগঠন নিয়ে 'বিচ্ছিন্নতাবাদী ' মানসিকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া এককথায় অসম্ভব | ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে | যত তৃণমূল চেয়েছে কেন্দ্রের দোষ দেখাতে, ততই খসে গিয়েছে তাঁর স্বপ্নমহলের পলেস্তারা |
চন্ডীমন্ডপের মন্ত্র-শিক্ষা দিয়ে এই ক্রমশ বড় হতে থাকা লড়াইয়ে ফিরে আশা প্রতিদিন আরও দুরূহ হয়ে উঠছে মমতাদেবীর দলবলের কাছে | গালিগালাজ করা কিংবা উদ্ভট কারণের মিছিলের ডাক দিয়ে জনসাধারণের পিছনে লুকোনো ছাড়া এই বে-আব্রু হয়ে যাওয়া বঙ্গজ রাজনীতিকদের আজ আর কিছুই করণীয় নেই |
এই পরিনাম যে কারোরই হতে পারত, তা কংগ্রেস হোক বা সিপিএম | মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুর্ভাগ্য, বঙ্গীয় রাজনীতির এই কাছা খোলার দিনে উনিই সমকালীন লক্ষণ সেন |