'এ যেন মা-কে হারানো', গিরিজা দেবীর প্রয়াণে স্মৃতি চারণায় সরোদিয়া দেবজ্যোতি বসু
এক অদ্ভুত মমত্ব আর স্নেহের ডোরে সকলকে বেঁধে নিতেন তিনি। এহেন গিরিজা দেবীর সঙ্গে কাটানো কিছু মুহূর্ত ওয়ান ইন্ডিয়া বাংলার সঙ্গে শেয়ার করলেন সরোদিয়া দেবজ্যোতি বসু।
সেই ছোটবেলা থেকে পেয়েছেন গিরিজা দেবীর সাহচর্য। পেয়েছিলেন তাঁর মমত্ব। ঋদ্ধ হয়েছিলেন গিরিজা দেবীর সঙ্গীত প্রতিভায়। তাই আজ মন ভারাক্রান্ত সরোদিয়া দেবজ্যোতি বসুর। স্মৃতি চারণায় উপর করলেন বহু অজানা গল্পের ঝাঁপি।
[আরও পড়ুন:সংসারের ঘেরাটোপেও এক সাধিকার সাধন সঙ্গীত, গিরিজা দেবী প্রয়াণে শ্রদ্ধার্ঘ]
'গিরিজা দেবী-কে আমরা বুয়াজি বলেই ডাকতাম। আমার বাবার গুরু ছিলেন পণ্ডিত কণ্ঠে মহারাজ। আবার দাদার গুরু ছিলেন পণ্ডিত কিসান মহারাজ। এরা সকলেই বারাণসীর। গিরিজা দেবীও ছিলেন বারাণসীর। পণ্ডিত কিসান মহারাজকে তিনি দাদা বলে মানতেন। রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও গিরিজা দেবী একদম সত্যিকারের বোনের মতোই পণ্ডিত কিসান মহারাজকে সম্মান করতেন। তাঁর জন্য ব্রত রাখতেন। তাই পণ্ডিত কিসান মহারাজের সূত্র ধরেই গিরিজা দেবীকে আমরা বুয়াজি বলতাম।
সেই ছোটবেলা থেকেই দেখতাম গিরিজা দেবীর মধ্যে অঢেল স্নেহ, মমতা। সকলকে যেন হাসিমুখে আপন করে নিতে পারতেন। আমাদেরকেও সেই স্নেহ আর মমতায় বেঁধে ফেলেছিলেন গিরিজা দেবী। তাই তাঁর সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই বহু দুঃখ-কষ্ট ভাগ করেছি। নিজের মা-এর মতোই সম্মান করেছি তাঁকে। পূরবি রাগের ঠুমরি হোক বা দাদরা, কাজরি- সমস্ত কিছু অকাতরে তিনি আমাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছেন।
১৯৯৫ সালে আমি প্রথম মিউজিক তৈরি করি। তলাশ নামে একটি হিন্দি সিরিয়ালের জন্য এই মিউজিক তৈরি করেছিলাম। সিরিয়ালের নেম কাস্টিং-এ আমি গিরিজা দেবীর একটি ঠুমরি ব্যবহার করেছিলাম। তাও আবার তাঁকে না জানিয়েই। কারণ, সিরিয়ালটি ছিল বারাণসীর প্রেক্ষাপটে। গিরিজা দেবীর সঙ্গে দেখা হতেই এই ঠুমরি ব্যবহারের কথা বলেছিলাম। রাগ তো দূরস্ত বরং খুশি মনেই বলেছিলেন- যো হ্যায় বেটা ওসব তু ঝ লোগো কায়ি হ্য়ায়, যো ভি চায়ে লে লে। গিরিজা দেবীর মতো একজন বড় মাপের শিল্পী এত সহজে এই কথা বলবেন তা বুঝতে পারিনি। আসলে গিরিজা দেবীর সবচেয়ে বড় যে গুণটি ছিল তা হল সিমপ্লিসিটি। এই গুণই তাঁর বিশাল শিল্পী প্রতিভাকে কোনওদিনই আত্ম অহংকার তৈরি হতে দেয়নি।
পুতুল খুব ভালবাসতেন বুয়াজি। শুধুই পুতুল কিনতেন। এমনকী, বিদেশ সফরে গেলেও নানা ধরনের পুতুল কিনে আনতেন। আর পরে সেই সব পুতুল তিনি আমাদেরকে দেখাতে বড় ভালবাসতেন। আমার মেয়ের অন্নপ্রাশনের যাবতীয় তদারকি করেছিলেন। নিজের হাতে আমার মেয়েকে ভাত খাইয়ে দিয়েছিলেন।
এমনই সব টুকরো টুকরো স্মৃতি এখন বারবার ফিরে আসছে মনে। কত বছর ধরে তিনি বারাণসী ছেড়ে কলকাতারই বাসিন্দা হয়ে গিয়েছিলেন তা ভাবতেও মাথা চুলকোতে হয়। বারাণসীতে মাঝে-মধ্যে যাওয়া ছাড়া গিরিজা দেবীর সঙ্গীত সাধরনার পীঠস্থানই হয়ে গিয়েছিল কলকাতা। টালিগঞ্জে সঙ্গীত রিসার্চ অ্য়াকাডেমির ক্যাম্পাসে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সঙ্গীত শিক্ষার্থীদের হাসিমুখে শিখিয়ে যেতেন পূরবি রাগের খুটি-নাটি। কলকাতার বুকে তাঁর সাহচর্যে এতগুলো বছর কাটানো সত্যিকারে এক অসামান্য অভিজ্ঞতা। কিন্তু, সেই মানুষটাকে আর দেখতে পাব না, এটা ভাবতে পারছি না। এ যেন সত্যি সত্যি মা-কে হারিয়ে ফেলা। '