'স্বপ্নের ফেরিওয়ালা', এক নতুন সম্ভাবনার আলো জ্বেলেছেন অম্লান, জানুন তাঁর কাহিনি
আসলে অম্লানকে যদি বলা যায় স্বপ্নের ফেরিওয়ালা তাহলে অত্য়ুক্তি হয় না। বাস্তবের রুক্ষ মাঠিতে দাঁড়িয়ে স্বপ্নেরই ফেরি করেন তিনি। স্বপ্ন দেখান নতুন আলোর, নতুন সম্ভাবনার।
বড়র মধ্যেই ছোটকে খুঁজে ফেরেন অম্লান। কারণ তাঁর স্থীর বিশ্বাস বড়-র মধ্যে যে ছোট লুকিয়ে থাকে তারমধ্যে থাকে সম্ভাবনার সেরা বীজ। যা আমাদের কাছে নিত্য প্রকাশিত, যাতে চোখ সওয়া তার মাঝেই এক অন্য স্বপ্ন বুনে চলেন অম্লান। আর তার সেই স্বপ্ন বোনার জালে যে কত মণি-মুক্তো উঠে আসছে সে গল্প অবশ্যই সকলের জানা উচিত।
আসলে অম্লানকে যদি বলা যায় স্বপ্নের ফেরিওয়ালা তাহলে অত্য়ুক্তি হয় না। বাস্তবের রুক্ষ মাঠিতে দাঁড়িয়ে স্বপ্নেরই ফেরি করেন তিনি। স্বপ্ন দেখান নতুন আলোর, নতুন সম্ভাবনার। যার পথে চললে জীবনের পাওনাটা ষোল-আনা। যারা অম্লানের ডাক শুনেছেন তাঁরা জানেন এটা কতটা সত্যি। ওয়ান ইন্ডিয়া বাংলার মুখোমুখি প্রয়াসমের মেন্টর অম্লানকুসুম গঙ্গোপাধ্য়ায়।
ওয়ান ইন্ডিয়া বাংলা- মাত্র ৪ মাস। আর তাতেই তৈরি হয়ে গেল আট-আটটা শর্ট ফিল্ম। এত কম সময়ে কী ভাবে সম্ভব হল এই বিশাল কর্মযজ্ঞ?
অম্লান- আসলে 'ব্যাড অ্য়ান্ড বিউটিফুল ওয়ার্ল্ড'- বলে একটি শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল পাঁচ বছর আগেই প্রয়াসম থেকে শুরু করা হয়েছিল। বলা যেতে পারে এটা ছিল একটা উদ্য়োগ। এই বছর এই বিবিডবলডু-র পষ্ণম বর্ষ। তাই সকলের উপরেই চাপ ছিল। আর সারা বছরই আমাদের কর্মকাণ্ড চলে। সময়ের সঙ্গে আমাদের দৌড়তে হয়েছে। তবে, এত অল্প সময়ের মধ্যে এতগুলো সিনেমা সত্যি সত্যি যে তৈরি হয়ে গিয়েছে তার জন্য যাবতীয় কৃতিত্ব প্রাপ্য টিম প্রয়াসমের।
ওয়ান ইন্ডিয়া বাংলা- এই শর্টফিল্মগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অধিকাংশ ছেলে-মেয়েদের সেভাবে প্রথাগত সিনেমা তৈরির শিক্ষা নেই। এই অসম্ভবকে সম্ভব করা গেল কী ভাবে?
অম্লান- প্রয়াসম চাইল্ড এডুকেটর তৈরি করা এবং তাদের নিয়ে এক সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য প্রায় দু'দশক ধরে কাজ করে চলেছে। এই চলার পথে আমাদের অন্যতম একটা পদক্ষেপ ছিল অডিও-ভিসুয়াল মাধ্যমে সমাজের ছবিটাকে তুলে ধরা। ফলে প্রয়াসমের ছেলে-মেয়েরা বহুদিন ধরেই অডিও-ভিসুয়াল মিডিয়াম নিয়ে কাজ করছে। দরকার ছিল এই উদ্যোগকে একটা পেশাদারি মোড়কে মোড়া। সেই কাজটি করেছে সেলিম-মণীশ-সুজিত-গোপালদের মতো প্রয়াসম সদস্যরা। যারা এক বছর ধরে আমেরিকায় সিনেমা তৈরি এবং প্রোডাকশন নিয়ে পড়াশোনা করেছে। সেখানকার বিখ্যাত কিছু প্রোডাকশন হাউসে অ্য়াপ্রেন্ট্রিস হিসাবেও কাজ করেছে। প্রয়াসমের বাকি সদস্যদের পেশাদার শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে এরাই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সপ্তর্ষী, প্রশান্ত, মিলি, মৌমিতা, পিয়ালিদি-দের উদ্যোগ। সবমিলিয়ে আজ আমি বলতে পারি প্রয়াসমের ছেলে-মেয়েরা আজ জানে কীভাবে একটা উন্নতমানের ছবি তৈরি করতে হয়। এর জন্য কী কী ব্যবস্থা করতে হয়। কনটেন্ট কতটা গুরুত্বপূর্ণ। বলতে গেলে সিনেমা তৈরির এ টু জেড পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার জ্ঞানটা লাভ করে ফেলেছে প্রয়াসমের ছেলে-মেয়েরা। এবার চাই এই মানসিকতার উন্নয়ন। যা তাদের-কে আন্তর্জাতিক স্তরে প্রতিযোগীতায় অংশ নিতে সাহায্য করবে।
ওয়ান ইন্ডিয়া বাংলা- মানুষ সাধারণত যখন শর্টফিল্ম তৈরি করে তখন এক ভিন্ন ধারার ছবি তৈরি করার চেষ্টা করে। কিন্তু এই আটটি শর্ট ফিল্মে যে বিষয় বাছা হয়েছে তার সঙ্গে বাঙালির নস্টালজিয়া রয়েছে। বর্তমান সময়ে বসে এমনভাবে এক নিখাদ আটটি ভালবাসার গল্প বলার চেষ্টা- দুঃসাহসিক নয় তো?
অম্লান- গল্প। বাঙালি এটাই ভালবাসে। আধুনিকতার ধুয়ো তুলে বাংলা ছবির মানস থেকে এই গল্প বলার চলটাই হাওয়া হয়ে গিয়েছে। অধিকাংশ ছবি মানেই সেখানে যৌনতার খুল্লমখুল্লা প্রদর্শন বেশি করে থাকতে হবে। এখনকার যে কোনও ধারার বাংলা ছবি বড্ড বেশি 'বডিলি'। আমার ছেলে-মেয়েরা তুলে ধরেছে আটটি ভিন্ন স্বাদের নিখাদ ভালবাসার সম্পর্কের গল্প। যা ডানা মেলেছে এই বর্তমান সময়ে, এই শহরের বুকে। এই ভালবাসার গল্পে যেমন আছে মানব-মানবীর সম্পর্কের কথা, তেমনি স্থান পেয়েছে পিতা-মাতা-র সঙ্গে সন্তানদের সম্পর্কের কথাও।
ওয়ান ইন্ডিয়া বাংলা- আটটি ছবির গল্পের মূল উপজীব্য নারী। ভালবাসার নিখাদ গল্পকেই যখন আনা হল তাহলে পুরুষদের কেন সেকেন্ডারি করে রাখা হল?
অম্লান- অবশ্যই এই প্রশ্ন মনে আসা উচিত। কারণ, আটটি ছবি- ফেরা, অসময়, ডুয়েল, অভিসার, সখা, ঢপ, পারমিশান, চেকমেট- এর প্রত্যেকটিতেই নারীকে মূল কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। আসলে এই আটটি শর্ট ফিল্মের নায়িকারা কেউ কারোর থেকে আলাদা নয়। কোথা না কোথাও তাঁদের একে অপরের সঙ্গে যোগ রয়েছে। এরা মানসিকভাবে যেমন কোথাও না কোথাও এক, আবার কোথাও না কোথাও আশাবাদী এবং একে অপরের পরিপূরক। একসঙ্গে যদি সবকটি নারীচরিত্র বেঁধে দেওয়া হয় তাহলে মনে হবে এদের উত্থান একস্থানেই। শুধু পরিস্থিতির পার্সপেক্টিভের সঙ্গে সঙ্গে এদের রূপের পরিবর্তন হচ্ছে। তবে, ফেরা ছবিটি এক বাবা ও ছেলের সম্পর্ক নিয়ে। সেই সম্পর্কের গভীরতা আবিষ্কার করতে ছেলেকে যে সাহায্য করে সে তাঁরই স্ত্রী।
ওয়ান ইন্ডিয়া বাংলা- কাজে এত পেশাদারিত্বের ছোঁয়া। ছেলে-মেয়েরা দিনরাত খেটে চলেছে। এমন এক প্রয়াসে যাঁরা এই আটটি শর্ট ফিল্মে অভিনয় করেছে তাঁরা সকলে নন-অ্যাক্টর! এত বড় ঝুঁকি নিলেন কী করে।
অম্লান-
বিখ্যাত
হলিউড
অভিনেত্রী
মেরিল
স্ট্রিপ-কে
এই
প্রসঙ্গে
টানতেই
হচ্ছে।
কারণ,
তাঁর
মতে
নন-অ্যাক্টররা
সেরা
অভিনেতা।
নন-অ্য়াক্টররা
অভিনয়
করেন
না,
তাঁরা
যেটা
করেন
সেটা
সত্যি
সত্যি
করেন।
অভিনেতা-অভিনেত্রীদের
মতো
তাঁর
দায়
নেই
যে
অভিনয়টা
অমুকের
মতো
হতে
হবে।
ফলে
নন-অ্যাক্টরদের
অভিনয়
অনেকবেশি
ন্যাচারাল
হয়।
এই
কারণে
এই
শর্ট
ফিল্মগুলিতে
নন-অ্য়াক্টরদের
নেওয়া
হয়েছে।
এঁদেরকে
আমরা
আমাদের
মতো
করে
শিখিয়ে-পড়িয়ে
নিয়েছি।
এদের
কেউ
রিটায়ার্ড
আইএএস,
আবার
কেউ
গৃহবধূ
তো
কেউ
আর
জে,
সাংবাদিক,
ছাত্র
বা
অন্য
কোনও
পেশার
সঙ্গে
যুক্ত।
আমাদের
অভিনেতা-অভিনেত্রীরা
যথেষ্টই
সহযোগিতা
করেছেন।
নতুবা
এই
প্রজেক্টটা
করাই
যেত
না।
ওয়ান ইন্ডিয়া বাংলা- কলকাতা শহরে দিনে অন্তত শ'খানেক শর্ট ফিল্মের শ্যুটিং চলছে। কিন্তু, অধিকাংশ শর্ট ফিল্মগুলিতে যে সমস্যাটা সবচেয়ে বড় সেটা হল কনটেন্ট। এখানে কনটেন্টকে কীভাবে সামলানো হয়েছে?
অম্লান- আমরা আগে যত শর্ট ফিল্ম করেছি তাতে কনটেন্টের প্রতি জোর দিয়েছি। কিন্তু, এবার আমরা কনটেন্টকে আরও উন্নত করার চেষ্টা করেছি। গভীরভাবে কনটেন্টকে ভাবা হয়েছে। যেমন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কোজের 'লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা'-র কাহিনিকে এই শহরের বুকে স্থাপন করে একটি ছবি বানানো হয়েছে। বলতে গেলে গল্প, চিত্রনাট্য, সংলাপ নিয়ে এবার যে লেভেলের কাজ হয়েছে তা যে কোনও ছবি করিয়ের কাছেই শিক্ষণীয়। সবচেয়ে বড় কথা প্রত্যেকে এতবড় কর্মযজ্ঞকে সফল করার জন্য যে ডেডিকেশন, ইনভলমেন্ট দেখিয়েছে তার জন্য সত্যি গর্ব হচ্ছে। তবে, এই প্রসঙ্গে সেই সব মানুষদেরও আমি শ্রদ্ধা জানাতে চাই যারা আমাদের শ্যুটিং-এর জন্য তাঁদের বাড়ি, ফ্ল্য়াট একদম নিঃস্বার্থভাবে ছেড়ে দিয়েছেন। ধন্যবাদ জানাই সেই সব রেস্তোরাঁ থেকে হাসপাতাল, কাফেটেরিয়া কর্তৃপক্ষ ও তাদের কর্মীদের যারা আমাদের পাশে সারাক্ষণ থেকেছেন।
ওয়ান ইন্ডিয়া বাংলা- সল্টলেকের বাসিন্দা, এটা বললেই নন-সল্টলেক রেসিডেন্টরা ভুরু বাঁকান। কিন্তু, শর্ট ফিল্মের শ্যুটিং-এর জন্য সল্টেলেকের বহু বাসিন্দাই নিজের ঘর-বাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন! এটা কীভাবে সম্ভব হল?
অম্লান- সল্টলেক মানেই একটা স্টিরিও-টাইপ ধারনা যে এরা কারোর সঙ্গে মেশে না, কারোর খোঁজ রাখে না। প্রচণ্ড সেলফ সেন্ট্রিক। প্রয়াসমের শর্ট ফিল্ম তৈরির সময় এই ধারনা ভুল বলেই প্রমাণিত হয়েছে। সল্টলেকের বহু মানুষ নিজে থেকে আমাদের দফতরে ফোন করেছেন। তাঁরা বিনামূল্যে আমাদেরকে তাঁদের বাড়ি-ঘড় ছেড়ে দিয়েছেন শ্যুটিং-এর জন্য। এমনও হয়েছে যে বাড়ির লোকেরা কাজে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আমাদেরকে চাবি দিয়ে দিয়েছেন শ্যুটিং করতে। সল্টলেকের বহু বাড়িতেই আমারা কখনও শ্যুটিং করেছি গভীর রাতে, কখনও ভোরের বেলায়, কখনও সাত সকালে। এমনকী, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আমাদের শ্যুটিং চলায় কোনও গৃহস্থের রান্নাঘর আটকে থেকেছে। কিন্তু, কেউ একফোঁটা বিরক্ত হননি। সকলেই হাসিমুখে আমাদের সহযোগিতা করেছেন। একটা এলাকার মানুষের মধ্যে যদি আন্তরিকতা না থাকে তাহলে এটা কী করে সম্ভব হল? তাই বলব সল্টলেক মানেই যে কিছু সেলফ সেন্ট্রিক মানুষের বাস- এই ধারনাটা হয়তো ঠিক নয়।
(অম্লান কুসুম গঙ্গোপাধ্যায়- পেশাদার কেরিয়ারটা শুরু হয়েছিল ক্রাইম ল'ইয়ার হিসাবে। কিন্তু মানুষের অসহয়তা তাঁকে ছুঁয়ে যেত। ১৯৯৬ সালে আইনজীবীর পেশা ত্যাগ করে পুরোপুরি স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ১৯৯৯ সালে কয়েক জন বন্ধুকে নিয়ে তৈরি করেন 'প্রয়াসম'। প্রান্তিক এলাকার ছোট-ছোট ছেলেমেয়েকে সমাজ উন্নয়নে ব্রতী করার কাজ শুরু করেন অম্লান। তাঁর এই মডেল আজ বিশ্বজুড়ে সমাদৃত হচ্ছে। অম্লানের দেওয়া মডেলকে গ্রহণ করেছে ইউনিসেফ থেকে শুরু করে মার্কিন সরকার, দক্ষিণ আফ্রিকা, কেনিয়া. নরওয়ে-সহ বিশ্বের আরও কিছু দেশ। অশোকা ফেলো-তে হয়েছেন সম্মানিত। পেয়েছেন ফোর্ড ফেলোশিপ। রকফেলার ফাউন্ডেশন তাঁকে বিশেষভাবে সম্মানিত করেছে। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি তাঁকে নিয়ে তৈরি করেছে 'রেভিলিউশানারি অপটিমিস্ট' নামে তথ্যচিত্র। যা গ্র্য়ামির জন্যও মনোনিত হয়েছিল। )