তুলির আঁচড়ে ফুটে উঠেছে অক্ষর, কলকাতায় বুকে ডানা মেলল হিব্রু-র অঙ্কণ শৈল
সজ্জার তো অনেক ধরণ আছে। ফুল দিয়ে সজ্জা থেকে শুরু করে রঙ-তুলি, পোশাক-আশাক সব কিছু দিয়েই তো সেজে ওঠা যায়। কিন্তু, অক্ষর যখন হয়ে ওঠে সজ্জার বিন্যাস!
সজ্জার তো অনেক ধরণ আছে। ফুল দিয়ে সজ্জা থেকে শুরু করে রঙ-তুলি, পোশাক-আশাক সব কিছু দিয়েই তো সেজে ওঠা যায়। কিন্তু, অক্ষর যখন হয়ে ওঠে সজ্জার বিন্যাস! তখন তা কেমন লাগে দেখতে। অনেকেই হয়তো এই শুরুর কটা লাইন দূর্বেধ্য বলে বোধ করছেন। এমন হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ, অক্ষর দিয়েও যে সেজে ওঠা যায় এবং তা দিয়েও যে একটা অঙ্কণ শৈল্য তৈরি হয় তার খোঁজ ক'জন রাখেন।
'ক্য়ালিগ্রাফি আর্ট' নিয়ে চর্চা বহু পুরনো। সেই ক্য়ালিগ্রাফি আর্ট-এর ব্যপ্তি এখন ক্রমশই ছড়িয়ে পড়ছে জীবনের নানা দিকে। বিশেষ করে দেওয়ালের শোভা বর্ধন থেকে শুরু করে ক্য়ালিগ্রাফি দিয়ে আরও নানা ডেকোরেশনের বিষয়গুলিতে এখন গুরুত্ব পাচ্ছে। আর এই ক্যালিগ্রাফি আর্ট এখন হাজির হয়েছে কলকাতার উপকন্ঠে সল্টলেক নগরীতে। একদল তরুণ ছেলে-মেয়ের নেতৃত্বে ডানা মেলেছে দুরন্ত ক্য়ালিগ্রাফি।
এই ক্য়ালিগ্রাফি-র শৈলি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে হিব্রু-র অক্ষরকে ভিত্তি করে। হিব্রু হল ইহুদিদের ভাষা। এই ভাষায় প্রাচীন বাইবেলেরও খোঁজ মেলে। ২২ বর্ণে সজ্জিত হিব্রু-র ইতিহাস যথেষ্টই ঐতিহ্য়ের। খ্রিস্টেরও জন্মের কয়েক শ'বছর আগেও এই ভাষার অস্তিত্ব মেলে। সেই হিব্রু-র বর্ণেই সল্টলেকে প্রয়াসমে-র চৌহদ্দি সেজে উঠেছে। লম্বা-লম্বা স্ট্রোকে হিব্রু বর্ণের সজ্জার একটা আকর্ষণও আছে। হিব্রু-র এই বর্ণ-কেই সাদা ব্য়াকগ্রাউন্ডে কালো রঙে সাজিয়ে তুলেছে একদল তরুণ-তরুণী। যাদের সেভাবে ক্য়ালিগ্রাফি আর্ট-এর কোনও অভিজ্ঞতাও ছিল না। মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁরা আস্ত একটা আর্ট প্যাটার্নকে মস্তিষ্কের মধ্য়ে ঢুকিয়ে নিয়ে কাজে নেমে পড়েছিলেন।
'ক্য়ালিগ্রাফ আর্ট'-এর সীমা এখন শুধুই খাতায়-কলমে বা ক্যানভাসে সীমাবদ্ধ নয়। বিভিন্ন ধরনের গ্রাফিতি-তেও এখন 'ক্য়ালিগ্রাফি আর্ট' ডেকরশনের মাধ্যম হিসাবেও ব্যবহার হচ্ছে। কথা হচ্ছিল প্রয়াসমের মেন্টর অম্লানকুসুম গঙ্গোপাধ্য়ায়ের সঙ্গে। 'ক্যালিফোর্নিয়া-তে গিয়ে এই ক্যালিগ্রাফি আর্ট-এর মার্ধুর্য প্রথম প্রত্যক্ষ করি। বিভিন্ন স্থানে যেভাবে ক্যালিগ্রাফি ইনস্টলেশন হয়েছিল তা অবাক করেছিল। ক্যালিগ্রাফি দিয়ে যে এমন করে ডেকরেশন হয় এবং কোনও একটা অনুষ্ঠান- সেটা ফ্যাশন শো হোক বা অপেরা, কোনও কিছু ব্যাক ড্রপ-কে অসামান্যভাবে সাজানো যায় তা প্রথম চাক্ষুষ করি। আর তখনই ঠিক করি এই ক্য়ালিগ্রাফি-কে কলকাতায় নিয়ে আসার।'
রেটেনা নামে এক যুবক এই ক্যালিগ্রাফি আর্ট-কে একটা অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। আমেরিকায় সেই রেটেনার বিভিন্ন কাজ সংগ্রহ করেন অম্লান। ইউটিউবে রেটেনার একাধিক ভিডিও রয়েছে। কলকাতায় ফিরে এসে প্রয়াসম-এর 'অনট্র্য়াক'-এর ছেলে-মেয়েদের সেই সব ভিডিও দেখান অম্লান। ক্যালিগ্রাফি আর্ট-এ রেটেনার কাজ সব হিব্রু-তে। কারণ, হিব্রু-র অক্ষরের লম্বা-লম্বা স্ট্রোক আলাদা একটা শিল্প-শৈলি-র জন্ম দেয়, যা অন্যন্য। তাই অম্লান প্রয়াসম-এর 'অনট্র্য়াক'-এর ছেলে-মেয়েদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় এই হিব্রু অক্ষরকেই ভিত্তি করেন।
মাত্র ৭২ ঘণ্টা। আর তারমধ্যেই অন্তত ৫০ জন ছেলে-মেয়ে-কে 'ক্যালিগ্রাফি আর্টিস্ট' বানিয়ে দিয়েছেন অম্লান। সল্টলেকে প্রয়াসম-এর দফতরেই একটা অংশে এবার কাজ শুরু করেছে 'কলাঞ্জলি'। মূলত একটা ওপেন থিয়েটার কলাঞ্জলি-তেই এবার বসেছে প্রয়াসম-এর বর্ষ শেষে-র অনুষ্ঠান 'প্রণাম'। প্রণাম-এর এই মঞ্চ সাজানোর কাজেই অম্লান-এর নেতৃত্বে একদল তরুণ ছেলে-মেয়ে আমেরিকার সেই ক্য়ালিগ্রাফ আর্ট-কে ফুটিয়ে তুলেছেন। 'প্রণাম'-এর জন্য তৈরি হওয়া মঞ্চের চারপাশ জুড়ে দেওয়ালে দেওয়ালে ফুঁটে উঠেছে হিব্রু-তে লেখা এই ক্যালিগ্রাফি আর্ট। হিব্রু-তে সারা দেওয়াল জুড়ে লেখা হয়েছে 'ইউ সি মি, আই সি ইউ'।
'প্রতিদিন প্রয়াসম প্রণাম' শেষ হচ্ছে ৩১ ডিসেম্বর। ১০ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে এই অনুষ্ঠান। দিনভর নানা অনুষ্ঠান যেমন 'প্রতিদিন প্রয়াসম প্রণাম'-এ দেখা যাচ্ছে, তেমনি এই ইভেন্ট-কে একটা অন্যমাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে 'ক্যালিগ্রাফি আর্ট'। কলকাতা বা সল্টলেক শুধু নয়, ভারতবর্ষে এর আগে এমন 'ক্যালিগ্রাফি আর্ট'-এর ইনস্টলেশন হয়নি। অম্লান জানিয়েছেন, তাঁর লক্ষ্য এই 'ক্য়ালিগ্রাফি আর্ট'-এর মাধ্যমে এক আন্তর্জাতিক শৈল্পিক শৈলি-কে ভারতের বুকে আরও বেশি করে জনপ্রিয় করে দেওয়া। আর এর জন্য প্রয়াসম-এর অনট্র্যাক-এর বেশকিছু ছেলে-মেয়েকে ভবিষ্যতের কথা ভেবে 'ক্যালিগ্রাফি আর্ট'-এ পারদর্শী করে তোলার ভাবনা হাতে নেওয়া হয়েছে। 'অনট্র্য়াক'-অন্তত এমন একটা টিম আপাতত তৈরি করে দেওয়া গিয়েছে যারা বড়-বড় ফ্যাশন শো বা যে কোনও ধরনের ইভেন্টে ক্য়ালিগ্রাফ আর্ট ইনস্টলেশন-এর কাজ করতে পারে। আগামী দিনে বাংলা বা ইংরাজি অক্ষরেও এমন কাজ যাতে করা যায় তারও চেষ্টা চলছে।
আসলে গতে বাঁধা জীবনের ছক-টাকে ভেঙে ফেলতেই বেশি পছন্দ করেন অম্লান। তুলির আঁচড় যে এই ছক ভাঙার কাজটা খুব ভালো করে করতে পারে তা জানেন তিনি। সেই কারণে তুলির প্রতিটি আঁচড়ে এক শিল্প শৈলি-কে ফুটিয়ে তুলতে একদল ছেলে-মেয়ে-কে উদ্ভুদ্ধ করতে পেরেছেন। হিব্রু-র অক্ষর বিন্যাসে তাই সল্টলেক কলাঞ্জলি-তে ডানা মেলেছে আন্তর্জাতিক মানের এক ডেকরেশন, যা মানুষ-কে দিচ্ছে এক নতুন ভাবনা আর সৌন্দর্যের রসদ। তাই দেরি না করে শুধুমাত্র এই ক্যালিগ্রাফি আর্ট-কে প্রত্যক্ষ করতে চলে যান সল্টলেকে প্রয়াসমের ক্যাম্পাসে।