‘রোদ্দুর’ ছড়িয়ে চলে গেলেন ‘কলকাতার যিশু’ নীরেন্দ্রনাথ, একাকীত্ব ঘোচালেন রমাপদের
‘অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল’ -তাঁর অমরসৃষ্টি আর শুধু কবিতার লাইনেই সীমাবদ্ধ নেই। অচিরেই তা রূপান্তরিত হয়েছিল বাংলা প্রবাদে। আর আজ তিনি সকলের স্মৃতিপটে নিজেই রোদ্দুর হয়ে গেলেন।
'অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল' -তাঁর অমরসৃষ্টি আর শুধু কবিতার লাইনেই সীমাবদ্ধ নেই। অচিরেই তা রূপান্তরিত হয়েছিল বাংলা প্রবাদে। আর আজ তিনি সকলের স্মৃতিপটে নিজেই রোদ্দুর হয়ে গেলেন। 'কলকাতার যিশু' নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী যিশুর জন্মদিনেই পাড়ি দিলেন অসীম-লোকে। বাংলা সাহিত্য জগতের মহীরূহ পতন হল বড়দিনে।
১৯২৪ সালের ১৯ অক্টোবর তাঁর জন্ম অবিভক্ত ভারতের ফরিদপুরে। পাঠশালা থেকে তাঁর গঠন শুরু হয়েছিল। ১৯৩০-এ কলকাতায় এসে মিত্র ইনস্টিটিউশন, বঙ্গবাসী ও সেন্ট পলস কলেজে তাঁরা পড়াশোনা। কর্মজীবনে প্রবেশ ১৯৫১ সালে। আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরি নেন নীরেন্দ্রনাথ। ছোটবেলা থেকেই ছড়া লিখতেন। শিশু সাহিত্য থেকে শুরু করে সাহিত্যজগতের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সাফল্যের শিখরে পৌঁছেছিলেন তিনি।
একাধারে তিনি ছিলেন শিশু সাহিত্যিক, ছড়াকার, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, গোয়েন্দা-গল্পকার, ভ্রমণ কাহিনি লেখক, অন্যদিকে সম্পাদক আবার বানান বিশেষজ্ঞও। সাহিত্যের অলিন্দে তাঁর জ্যোতির বিচ্ছুরণ সর্বস্তরে। একটা সময় দীর্ঘদিন 'আনন্দমেলা' পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন। বানান নিয়ে তাঁর গবেষণা এক আলাদা মাত্রা পায় সাহিত্যজগতে। তাঁর লেখা বই রয়েছে- 'কী লিখব, কেন লিখব'।
১৯৫৪ সালে তাঁর লেখা প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। 'নীল নির্জন' তাঁর প্রথম কবিতার বই। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩০। তারপর আর থেমে থাকেননি নীরেন্দ্রনাথ। একে একে 'অন্ধকার বারান্দা', 'নিরক্ত করবী', 'নক্ষত্র জয়ের জন্য', 'আজ সকালে'- এমন বহু কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পায়। সাহিত্যে অ্যাকাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন তিনি।
তাঁর লেখা ছোটগল্পও 'দেশ' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আর তাঁর 'অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল', আর 'রাজা তোর কাপড় কোথায়'- বাংলায় প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়েছিল কবিতার বেড়াজাল ছাড়িয়ে। আসলে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কাছে কবিতা ছিল মাতৃভাষা। তিনি নিজেই বলতেন, কবিতা থেকে সময় চুরি করে আমি গদ্যকে দিচ্ছি।
আবার তিনি এমনও বলতেন কবিতা লেখায় আমার কল্পনার জোর তত নেই। আমি চার পাশে যা দেখি, যা শুনি, যা অভিজ্ঞতা হয়, তা-ই আমার কাছে কবিতা হয়ে উঠেছে। তার সহজ-সরল বাস্তব-ব্যাখ্যায় কবিতা প্রাণ পেত বাঙালি কবিতাপ্রেমীদের কাছে। তাঁর লেখনিতে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল 'উলঙ্গরাজা', 'কলকাতার যিশু', 'বাতাসি'-র মতো চরিত্র।
সাহিত্য ছাড়া নীরেন্দ্রনাথ, আর নীরেন্দ্রনাথ ছাড়া বাংলা সাহিত্য ভাবা যায়নি বিগত প্রায় সাত দশক। তিনি যে সৃষ্টি রেখে গেলেন, তা ভাবা যাবে না আগামী দিনেও। এ বছরই ২৯ জুলাই বাংলা সাহিত্যে আর এক নক্ষত্রের পতন হয়েছিল। প্রয়াত হয়েছিলেন রমাপদ চৌধুরী। দীর্ঘদিনের বন্ধু ছিলেন নীরেন্দ্রনাথের। বয়সে দু-বছরের বড়। বন্ধুর স্মৃতিচারণায় দেশ পত্রিকায় তিনি লিখেছিলেন- 'আমারও আর দেরি নেই। রমাপদকে বেশিদিন একা থাকতে হবে না।'। কথা রাখলেন নীরেন্দ্রনাথ। শিগগিরই তিনি চলে গেলেন অসীম-পারে।