মিতার মৃত্যু রহস্যের কিনারা অধরা, মৌনমিছিল আর সোশ্যাল মিডিয়ায় মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দাবি
কলকাতা ও হাওড়া, ১৭ অক্টোবর : উলুবেড়িয়ার কুশবেড়িয়ায় শ্বশুরবাড়িতে গৃহবধূ মিতা মণ্ডলের মৃত্যু রহস্যের জট কাটল না চারদিনেও। অভিযোগ নথিভুক্তির পর কেটে গিয়েছে চারদিন, তবু এখনও অধরা মৃতার শাশুড়ি ও দেওর। মিতার শ্বশুরবাড়িতে ঝুলছে তালা, বাপের বাড়ির লোক প্রতীক্ষায় মেয়ের খুনিরা কবে শাস্তি পাবে। মেয়ের এই করুণ পরিণতিতে সুবিচার চেয়ে মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দাবি করলেন বাবা-মা। মিতার সহপাঠীরার সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রী-শিক্ষামন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাইলেন।
মিতার রহস্যমুত্যুতে ন্যায়বিচারের দাবিতে রবিবার এক মৌনমিছিলের আয়োজন হল গড়িয়ায়। সেই মিছিলে দুরু দুরু বুকে হাঁটলেন মিতার শোকগ্রস্ত বাবাও। তাঁর একটাই দাবি, মেয়ের খুনিরা যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়। মিতার বাপের বাড়ির সদস্যদের অভিযোগের ভিত্তিতে বধূ-হত্যায় স্বামী-শ্বশুর গ্রেফতার হলেও এখনও অধরা শাশুড়ি-দেওর। তাঁদের খোঁজে তল্লাশি চলছে। তবে এখনও মিতার মৃত্যু খুন না আত্মহত্যা, তা নিয়ে ধন্দে পুলিশ। এখনও অধরা প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজে পাননি তদন্তকারীরা।

মিতার শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের দাবি, মিতা আত্মঘাতী হয়েছেন। তাহলে প্রশ্ন, মিতার শরীরে একাধিক গভীর আঘাতের চিহ্ন এল কোথা থেকে? মৃতার স্বামী রানার বয়ান, রাতে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করার সময় পড়ে গিয়ে মিতার শরীরে ওই আঘাত লাগে। কপাল ফুলে যায়। তদন্তকারীদের কথায়, দেহ পড়ে গিয়ে কখনও ওইরকম গভীর ক্ষত হতে পারে না। যদি মেনেও নেওয়া যায় পড়ে গিয়ে মিতার কপালে আঘাত লেগে ফুলে যায়, তার নাক দিয়ে ওই পরিমাণ রক্ত বের হল কী করে? শরীরের অন্যান্য অংশেই বা কেন আঘাত? উত্তর নেই।
কেনই বা ঘটনার প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল তাঁকে? কেনই বা এত আঘাত সত্ত্বেও হাসপাতালের রিপোর্টে লেখা হল শ্বাসরোধেই মৃত্যু মিতার? তবে কি মৃতার স্বামী ওই হাসপাতালের কর্মী বলেই তাকে ও তার পরিবারকে আড়াল করতেই হাসপাতালের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে তা। ওই রিপোর্টে কি প্রভাব খাটানো হয়েছে, তা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। কেন মৃত্যুর আগে দশ-দশবার ফোন করা সত্ত্বেও মিতার ফেন তুললেন না রানা?
তিনদিন পরে থানায় অভিযোগ নথিভুক্ত করা হয় তাঁদের মেয়েকে পিটিয়ে খুন করা হয়েছে। অভিযোগ করতে তিনদিন দেরি হলেও, তাঁদের অভিযোগ একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এবার পুজোর আগে গড়িয়ার সোনারপুরের শান্তিনগরে বাপের বাড়িতে গিয়ে বাবার কাছে এক লক্ষ টাকা চেয়েছিলেন মিতা। বলেছিলেন, বিএড পড়তে অনেক খরচ, অত টাকা শ্বশুরবাড়ির লোক বন্দোবস্ত করতে পারবে না।
সেই কারণ দেখিয়ে ১ লক্ষ টাকা চাওয়া হয়। না পেয়ে অন্তত হাজার পাঁচেক টাকা দিতে মায়ের কাছে আবদার করেছিল মিতা। বলেছিল, না হলে বাপের বাড়িতে গিয়ে কথা শুনতে হবে। প্রশ্ন এখানেও, তবে বিএড পড়া কি গৌন, শ্বশুর বাড়ির চাপেই ওই টাকা বাবার কাছে চেয়েছিলেন মিতা?
মাত্র ছ'মাস আগে গড়িয়ার মিতার সঙ্গে বিয়ে হয় ফুলেশ্বর বেসরকারি হাসপাতালের কর্মী রানার। সেই বিয়েতে মিতার রাজমিস্ত্রি বাবার প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ টাকা খরচ হয়। বিয়ের পর থেকেই মিতার উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হত। প্রিতিদিন নিয়ম করে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরত রানা। তারপর স্ত্রীর উপর চলত নির্যাতন।
দু'বছর আগে রানার সঙ্গে পরিচয় হয় মিতার। তারপর প্রেম থেকে পরিণয়। কিন্তু বিয়ের পরই উধাও হয়ে যায় সমস্ত প্রেম। শেষপর্যন্ত পরিণতি হয় ভয়াবহ।
এদিকে মিতার এই করুণ পরিণতির সুবিচার চেয়ে মুখ্যমন্ত্রী থেকে শিক্ষামন্ত্রী, উপাচার্য ও রেজিস্টারের কাছে সোশ্যাল মিডিয়ায় চিঠি লিখেছেন তাঁর সহপাঠীরা। প্রথম দিন থেকেই তাঁরা মিতার এই রহস্য-মৃত্যুর ঘটনায় সরব হয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়াকে হাতিয়ার করেই এই যুদ্ধে নেমে পড়েছেন তাঁরা। তবু আদতে মিতার মৃত্যু-রহস্য এখনও আটকে সেই একই জায়গায়। এপ্রিলে বিয়ে. আগস্টে অ্যাবরশন, অক্টোবরে মৃত্যু মিতার- এটাই এখন সার কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে মিতার জীবন-সারণীতে।