লাগামছাড়া ডোনেশন ও মাত্রাহীন ফি বৃদ্ধি নিয়ে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে হুঁশিয়ারি মমতার
স্বাস্থ্যের পর বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। একই দাওয়াইয়ে মুখ্যমন্ত্রী লাগাম পরাতে চাইছেন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে।
স্বাস্থ্যর দাওয়াইয়েই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির বেপরোয়া মনোভাবের লাগাম টানতে পদক্ষেপ নিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবার টাউন হলে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি সাফ জানালেন, শিক্ষা হল সাধনা। স্কুলগুলি মানুষ তৈরির কারখানা। সেখানে ডোনেশানের নামে অসাধু ব্যবসা বরদাস্ত করা যাবেনা ।
রাজ্যের তরফে স্কুলগুলিকে এদিন কড়া বার্তা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই জন্য তিনি গঠন করে দিলেন সেলফ রেগুলেটরি কমিশনও। এখন থেকে স্বাস্থ্যের ধাঁচেই শিক্ষাক্ষেত্রে লাগাম পরাতে এই কমিশন রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করবে।
এদিন মুখ্যমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন রাজ্য সরকার কোনওভাবেই হস্তক্ষেপ করবে না বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডে। পাশাপাশি একথাও মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, লাগামছাড়া ডোনেশন, মাত্রাছাড়া ফি বৃদ্ধিও চলতে দেওয়া যাবে না। সেই কারণে তিনি সেল্ফ রেগুলেটরি কমিশন গড়ে এর দাওয়াইয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এই কমিশনে থাকবেন শিক্ষা সচিব।
থাকবেন সাউথ পয়েন্ট, সেন্ট জেভিয়ার্স, লা মার্টস, লরেটো, হেরিটেজ, ডিপিএস, সেল্ট লরেন্সের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতিনিধিরা। থাকবেন দুই আর্চ বিশপ। থাকবেন প্রতিটি জেলার একজন করে প্রতিনিধিও। এবং অবশ্যই থাকবেন কলকাতা পুলিশের একজন উচ্চপদস্থ আধিকারিক। প্রতি চারমাস অন্তর কমিশনমের রিভিউ মিটিং হবে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এদিন বলেন, বাংলার মেধা বিশ্বমানের। পয়সা দিয়ে মেধার বিচার হয় না। মেধা থাকলেই টাকা থাকবে, এমন নয়। বহু মেধাবীর বেশি টাকা নেই। তাঁরা ভর্তির জন্য ২ লক্ষ ৪৭ হাজার টাকা দিয়ে তিনি ভর্তি হবেন কী করে? স্কুলের খরচ আছে জানি, তা বলে যা ইচ্ছা টাকা নেওয়া ঠিক নয়। শুধু মাত্রাছাড়া ভর্তি ফি, লাগামছাড়া ডোনেশন নয়, বিভিন্নভাবে টাকা নেওয়া হয়। রাজ্যে সব স্কুলের পরিকাঠামোও ঠিক নেই বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, সামার ক্যাম্পের জন্য টাকা, পরিবহণ-স্কুলবাসের জন্য টাকা, স্কুল সংস্কারের জন্য টাকা। এভাবে এত খাতে টাকা দেওয়া সম্ভব নয়। এই সব অভিযোগ উঠছে কিছু নামী স্কুলের বিরুদ্ধে। খুব কম সংখ্যক স্কুলের বিরুদ্ধে বদনাম, কিন্তু বদনাম হচ্ছে পুরো ব্যবস্থার। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে খরচ বেশি। কীভাবে সেইসব স্কুলে মেধাবী ছেলেমেয়েদের পড়াবেন অভিভাবকরা? প্রশ্ন তুলে দেন মুখ্যমন্ত্রী। ডোনেশনের নামে অসাধু ব্যবসা চলতে দেওয়া যাবে না বলেও সাফ জানিয়ে দেন তিনি।
এদিন লা মার্টস কর্তৃপক্ষকে তোপ দাগেন মুখ্যমন্ত্রী। সরাসরি লা মার্টসের প্রতিনিধিকে তাঁর প্রশ্ন, কেন তারা এত বেশি টাকা নেয়? কেন ভর্তি ফি, সেশন ফি আলাদা। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, সবথেকে বেশি টাকা নেন আপনারা। ভর্তির জন্য ২ লক্ষ ৪৭ হাজার টাকা! ভর্তি হতেই এত টাকা নেন কেন? তারপরও ডোনেশন কেন? এমনকী আপনাদের নামে পুলিশেও মামলা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর সাফ কথা ডোনেশন যেন না নেওয়া হয়। স্টেশনারি সামগ্রী কেন স্কুলেই কিনতে হবে? সেই প্রশ্নও তোলেন মুখ্যমন্ত্রী।
এর পাশাপাশি লা মার্টস কর্তৃপক্ষকে তাঁর দাওয়াই আপনাদের স্কুলে কার্যত একটা চক্র চলছে। স্কুলের নামে বদনাম হচ্ছে। যদি আপনাদের নামে কেউ এই চক্র চালায়, তবে আপনাদেরই তো তা দেখা দরকার। লা মার্টস কর্তৃপক্ষ এর পরিপ্রেক্ষিতে জানায়, আমরা কোনও ডোনেশন নিই না। তখন মুখ্যমন্ত্রী জানান, তবে সবাইকে বলে দিই- নো ডোনেশন। লা মার্টস কর্তৃপক্ষ তাতে সহমত পোষণ করেন। কোন কোন স্কুলে এই চক্র চলছে তারও খোঁজ নিতে বলেন মুখ্যমন্ত্রী।
ডিপিএসের তিনটি স্কুলে এক জানালা নীতি নয় কেন? কেন তিনটি স্কুলে তিন ধরনের ফিজ স্ট্রাকচার? এটা কীভাবে হতে পারে? আলাদা বোর্ড হলেও এটা ঠিক নয়। তাই তা বন্ধ করতে নির্দেশ জারি করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, হেরিটেজ স্কুলের রেজাল্ট ভালো। কিন্তু লা মার্টসের পরে আপনাদের স্কুলেই সবথেকে বেশি ভর্তি ফি। হেরিটেজে বছরে ১ লক্ষ ৮৫ হাজার টাকা নেওয়া হয়। খাওয়া, বাসের খরচ নেওয়া হয়। তাহলে আবার ডোনেশন কেন? বাবা-মায়েরা এর ফলে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। শুরুতেই পুরো খরচ করতে বলা হয় কেন? তা নিয়েও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিনিধিদের এক হাত নেন মুখ্যমন্ত্রী।
সাউথ পয়েন্টে বছরে তিন থেকে তার শতাংশ হারে বৃদ্ধি পায় বেতন। প্রশ্নের মুখে মডার্ন হাইও। শ্রী শিক্ষায়তনকেও তোপ দাগেন মুখ্যমন্ত্রী। আপনাদের স্কুলে নেতাদের বক্তৃতা শোনানো হয়। একজন ম্যাডাম এটা করেন। আমার কাছে নির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। তবে এই স্কুলের খরচ ঠিক আছে বলে জানান মমতা।
সেন্ট জেভিয়ার্সকে উদ্দেশ্য করে তাঁর তোপ, আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অত্যধিক খরচ। তখন তা অস্বীকার করে কর্তৃপক্ষ জানায়, ফি কাঠামো জানিয়েই ভর্তি নেওয়া হয়। মাসকমে ৫ লক্ষ টাকা ভর্তি ফি কেন? কেন এত খরচ হবে? ৫ লাখ টাকায় মানুষের জীবন চলে। সাউথ পয়েন্ট গার্ডন হাইকেও প্রশ্নে বিদ্ধ করেন মমতা। তাঁর প্রশ্ন, এত ফি হলে বাচ্চারা পড়বে কী করে?
এদিন ফের বাংলা পড়ার উপর জোর দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ইচ্ছেমতো পড়ার অধিকার সবার আছে। তা বলে মাতৃভাষা পড়বে না, তা হতে পারে না। ইংরেজি পড়ান, হিন্দি পড়ান, সেইসঙ্গে বাংলাও পড়তে হবে। বাংলা হোক তৃতীয় ভাষা। অবাঙালিরাও বাংলা শিখলে ক্ষতি কী! বাংলায় থেকে বাংলা পড়ব না এ আবার কেমন কথা!