আক্রান্ত কবি শ্রীজাত-কে নিয়ে সরব তৃণমূল, অম্বিকেশ মামলায় ভিন্ন অবস্থান, উঠছে প্রশ্ন
শিলচরে কবি শ্রীজাত-র উপরে হওয়া আক্রমণে রীতিমতো সরব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়েও রাজ্য সরকার এবং তৃণমূল বা তৃণমূলপন্থীদের অবস্থানও সকলের নজর কাড়ছে।
শিলচরে কবি শ্রীজাত-র উপরে হওয়া আক্রমণে রীতিমতো সরব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়েও রাজ্য সরকার এবং তৃণমূল বা তৃণমূলপন্থীদের অবস্থানও সকলের নজর কাড়ছে। কিন্তু, ২০১২ সালে অম্বিকেশকাণ্ডে মানবাধিকার কমিশনের সুপারিশ-ই হেলায় উড়িয়ে দিয়েছে মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়ের সরকার। যাতে রীতিমতো ক্ষুব্ধ কলকাতা হাইকোর্ট। অম্বিকেশকাণ্ডে মানবাধিকার কমিশনের সুপারিশ যেভাবে রাজ্য সরকার হেলায় উড়িয়ে দিয়েছে তাতে সোমবাবার রীতিমতো ভর্ৎসনা বর্ষণ করেছে আদালত। একটা আপিল মামলা-কে নানা টালবাহানায় যেভাবে ৩ বছর ধরে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাতে ক্ষুব্ধ অম্বিকেশ মহাপাত্রও।
২০১২ সালের ১২ এপ্রিল যাদবপুর থানার পুলিশ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র-কে গ্রেফতার করেছিল। একই সঙ্গে অম্বিকেশের প্রতিবেশী সুব্রত সেনগুপ্ত-কেও গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। এই মামলায় সুয়ো-মুটোর ভিত্তিতে রাজ্য মানবাধিকার কমিশন তদন্ত করে এবং মানবাধিকার কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় ২ পুলিশ কর্তা-সহ মোট চারজন পুলিশের বয়ান নথিবদ্ধ করেন। এই ২ পুলিশ কর্তার মধ্যে ছিলেন সে সময় কলকাতা পুলিশের কমিশনার আর কে পচনন্দা এবং অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার সুধীর মিশ্র। এছাড়াও ছিলেন যাদবপুর থানার তৎকালীন আইসি সঞ্জয় বিশ্বাস এবং অতিরিক্ত ওসি মিলন দাস।
মানবাধিকার কমিশন থেকে রাজ্য সরকারকে একটি রিপোর্টও পাঠানো হয়। এই রিপোর্টে যাদবপুর থানার ২ পুলিশ কর্মীর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের ব্যাবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল। একই সঙ্গে অম্বিকেশ মহাপাত্র ও সুব্রত সেনগুপ্তর সম্মানহানির জন্য ৫0,০০০ টাকা করে জরিমানাও ধার্য করেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অশোক গঙ্গোপাধ্যায়। কিন্তু, রাজ্য সরকার এই সুপারিশ অস্বীকার করে।
এরই প্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন অম্বিকেশ মহাপাত্র ও সুব্রত সেনগুপ্ত। শুনানি শেষে ২০১৫ সালে ১০ মার্চ রায়ে মানবাধিকার কমিশনের সুপারিশকেই কার্যকর করার কথা বলেন বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত। এমনকী, মামলার খরচ বাবদ অম্বিকেশ ও সুব্রতকে অতিরিক্ত ৫০,০০০ টাকার ক্ষতিপূরণ দিতেও নির্দেশ দেন বিচারপতি।
রাজ্য সরকার এই নির্দেশও মানতে অস্বীকার করে। ফলে মামলা গড়ায় কলকাতা হাইকোর্টের এক নম্বর ডিভিশন বেঞ্চে। সেখানে এই নিয়ে আপিল মামলা দায়ের হয়। কিন্তু একবার শুনানি হওয়ার পর নানা কারণ দেখিয়ে সরকারি কৌঁসুলি শুনানিতে হাজির না হওয়ায় তা থমকে থাকে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর থেকে এই মামলা ৪ নম্বর ডিভিশন বেঞ্চে চলে যায়। সোমবার মামলার শুনানিতেই সরকারি কৌঁসুলির বক্তব্য শুনে যারপরনাই বিরক্ত দুই বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় ও শুভ্রা ঘোষ। কেন অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে সময় নষ্ট করা হচ্ছে তার জন্য ধমকও দেন বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়। মানবাধিকার কমিশনের সুপারিশ কেন কার্যকর করা হয়নি তার জন্যও রাজ্য সরকারকে ভর্ৎসনা করেন বিচারপতি। 'বেকার লোকেদের কোনও কাজ নেই বলে যে তাঁদের কোনও উচ্চপদে বসিয়ে রাখা হয়েছে এমনটা নয়। এমন ব্যক্তিদের কোনও উচ্চপদে বসিয়ে রাখার পিছনে নিশ্চয় কোনও গুরুত্ব আছে। আর সেই লোকেদেরই সুপারিশ অস্বীকার করা হচ্ছে।' এই মন্তব্য করে রাজ্য সরকারে ভূমিকায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৫ জানুয়ারি এই মামলায় ফের শুনানি রয়েছে।
গোটা বিষয়ে অবশ্য নিজের হতাশা গোপন করছেন না অম্বিকেশ মহাপাত্র। মত প্রকাশের স্বাধীনতায় যে ভাবে তাঁকে রাজ্য সরকার তার সমস্ত শক্তি দিয়ে হেনস্থা করেছে তাতে তিনি প্রবলই ক্ষুব্ধ। কিন্তু, সরকার যেভাবে মানবাধিকার কমিশনের মতো একটি উচ্চ ন্যায়ালয়ের সুপারিশ-কেও পাত্তা দিতে রাজি নয় তা গণতন্ত্রের উপরে একটা আঘাত বলেই মনে করছেন। এমনকী একটা সাধারণ আপিল মামলাকেও যেভাবে ৩ বছরের বেশি সময় ধরে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাতে সাধারণ মানুষ কোনও আশা নিয়ে থাকবে তা নিয়েও আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন অম্বিকেশ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপকের মতে, ' কথা-তেই আছে জাস্টিস ডিলেড, জাস্টিস ডিনায়েড, বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতায় এখন আমারও সেই বোধ হচ্ছে।'
রাজ্য সরকার মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সম্মান দেয়। একথা খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়ও বারবার বলেছেন। অথচ, শুধু অম্বিকেশ নন, মত প্রকাশের স্বাধীনতায় তৃণমূল জামানায় অনেকেই সরকারী দমন-পীড়নের শিকার হয়েছেন। দিন কয়েক আগে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা নিয়েও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর দল বিজেপি-সহ বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনকে নিশানা করেছেন। অথচ, এই কবি শ্রীজাত যখন রাজ্য সরকারের দেওয়া সম্মান নিতে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তখন তাঁকে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের রোষের মুখে পড়তে হয়েছিল। শিলচরে কবি শ্রীজাত-র অনুষ্ঠানে হামলা আসলে মত-প্রকাশের স্বাধীনতায় হামলা বলেই মনে করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর দল। কিন্তু, অম্বিকেশকাণ্ডে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার কোনও দমন-পীড়ন করেনি বলেই দাবি করা হচ্ছে। একই ইস্যুতে পরিবর্তনের সরকারের এই দুই ভিন্ন অবস্থান এক দ্বিচারিতার ছবিকেই স্পষ্ট করে তুলেছে বলেছে অনেকে দাবি করছেন।